ইয়েমেনের চলমান সংকট ও সংলাপে অচলাবস্থার কারণ
ইয়েমেনে চলমান সৌদি আগ্রাসন ১৭ মাস অতিক্রম করার পরও দেশটিতে সংকট অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের শিশু-ত্রাণ তহবিল সংস্থা ইউনিসেফসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা বলেছে, গত ১৭ মাসে সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোট ইয়েমেনে যা করেছে তা মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধ-অপরাধের স্পষ্ট দৃষ্টান্ত।
ইউনিসেফের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মে মাসের শেষ নাগাদ দুই কোটি ১১ লাখ ইয়েমেনি ত্রাণ সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে ৯৯ লাখই হচ্ছে শিশু। দেশটির ৫ বছরেরও কম বয়সী তিন লাখ ২০ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশটির ২২ লাখ শিশু। ৮০ লাখ ইয়েমেনি শিশুর জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে নানা ধরনের সামাজিক সহায়তা। আর এক কোটি ৪১ লাখ ইয়েমেনি শিশুর জন্য স্বাস্থ্য-সেবা প্রদান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এজেন্সি জানিয়েছে, ইয়েমেনের দুই-তৃতীয়াংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার হওয়ায় মৃত্যুর হুমকির মুখে রয়েছে।
ইয়েমেনের ২৭ লাখ নাগরিক দেশটির ভেতরেই শরণার্থী ও অর্ধেক সংখ্যক ইয়েমেনি, বিশেষ করে দেশটির ২২ প্রদেশের মধ্যে ১৯ প্রদেশের জনগণই খাদ্য-সংকটের শিকার।
ইয়েমেনে পদত্যাগী ও পলাতক সরকার-প্রধান মানসুর হাদিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট নানা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। হাদির অনুগত অনুচর-সেনা ও আলকায়দার মত নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা লড়াই করছে জনপ্রিয় আনসারুল্লাহ আন্দোলন ও এর সমর্থক সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে। আনসারুল্লাহর পাশাপাশি সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ’র পিপলস কংগ্রেস পার্টি এবং আনসারুল্লাহর সমর্থক স্বেচ্ছাসেবী গণবাহিনীও সৌদি নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট, মানসুর হাদি ও আলকায়দার পরোক্ষ সহযোগী হিসেবে কাজ করছে মার্কিন সরকার। সম্প্রতি ‘গ্লোবাল রিসার্চ’ও ইয়েমেনে আলকায়দার প্রতি মার্কিন মদদের কথা স্বীকার করেছে। সৌদি জোট, মানসুর হাদি ও আলকায়দার বিরুদ্ধে লড়াই করছে আনসারুল্লাহ, সরকারি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের অন্য কয়েকটি মিত্র পক্ষ। ইয়েমেনের কয়েকটি রাজনৈতিক দলও সৌদিকে সহযোগিতা দিচ্ছে। যেমন, আখ্যানই আল ইসলাহ ও ইয়েমেনের ওয়াহাবি সালাফি গোষ্ঠী। এ ছাড়াও আলআহমার গোত্রও সৌদি জোটের পক্ষে কাজ করছে।
ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রথমে জেনেভায় ও পরে কুয়েতে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এইসব আলোচনার পরও শান্তি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কুয়েত সরকারও আপোষ-রফার জন্য ৮ আগস্টের সময়সীমা ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও আপোষে উপনীত হতে পারেনি ইয়েমেন সংকট-সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। ফলে স্থগিত হয়ে আছে আপোষ আলোচনা। ইয়েমেনে শান্তি-প্রক্রিয়া বা আপোষ-আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পেছনে বড় বড় শক্তিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ ও বিশেষ করে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের কর্তৃত্বকামীতাকে দায়ী করছেন অনেকেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ নৌ-পথ বাবেল মান্দাব প্রণালীসহ নানা কারণে ইয়েমেনের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ইহুদিবাদী ইসরাইলসহ তার স্থানীয় অনুচরদের জন্য ইয়েমেনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। আর সাম্রাজ্যবাদীদের এই লক্ষ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। ‘বিশ্ব-ব্যবস্থায় সংকট’ শীর্ষক বইয়ের লেখক মাইকেল বার্চারও এমন অভিমতই প্রকাশ করেছেন।
ইয়েমেন সংকটের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে ইয়েমেনের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে আগ্রহী দল ও গোষ্ঠীগুলোর জোট। অন্যটি সৌদি-কেন্দ্রিক জোট।
ইয়েমেনে আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ দেশটির সংকট অব্যাহত থাকার সবচেয়ে বড় কারণ। সৌদি সরকার ইয়েমেনে প্রায় দেড় বছর ধরে নির্বিচার বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। কোনো কোনো দিন দুই তিন-শতবার বিমান হামলা চালাচ্ছে রিয়াদ। আর নিহতদের বেশিরভাগই হল নারী ও শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক।
ইয়েমেনের বিগত ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক ও সামরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে আনসারুল্লাহ। এই দল ইয়েমেনের ওপর পাশ্চাত্য ও সৌদি সরকারের কর্তৃত্বের ঘোর বিরোধী। অন্যদিকে মানসুর হাদির গ্রুপ ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যেই পাশ্চাত্য এবং সৌদি সরকারের ওপর নির্ভরশীল।
সৌদি হামলায় স্কুল, হাসপাতাল, বাজার, কল-কারখানা এবং সব ধরনের অর্থনৈতিক স্থাপনাসহ ইয়েমেনের অবকাঠামো এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে রয়েছে। কোনো কোনো সময় একই পরিবারের সব সদস্য নিহত হচ্ছে সৌদি বোমা হামলায়। অসহায় নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সৌদি আগ্রাসনের কারণে। জাতিসংঘ সাম্প্রতিক সময়ে শিশু হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সৌদি সরকারকে ঘাতক সরকারগুলোর তালিকায় স্থান দিয়েছিল। কিন্তু পরে জাতিসংঘে সৌদি অর্থ সহায়তা বন্ধের হুমকির মুখে জাতিসংঘের মহাসচিব সৌদি সরকারকে এই তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান।
ইউনিসেফের হিসেবে অনুযায়ী ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত ১১২১ ইয়েমেনি শিশু সৌদি হামলায় নিহত ও ১৬৫০ শিশু আহত হয়েছে। ইউনিসেফের মুখপাত্র মনে করেন শিশু হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা এ বিষয়ে ইউনিসেফের রিপোর্টে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
ইয়েমেনে জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে গড়ে-ওঠা নতুন সরকারের মূল শক্তি হচ্ছে আনসারুল্লাহ। এই আনসারুল্লাহর কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারছে না সৌদি সরকার। ফলে ব্যর্থ হয়েছে কুয়েত-আলোচনা। অন্যদিকে দিনকে দিন বিস্তৃত হচ্ছে সামরিক সংঘাত। ইয়েমেনে যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে বলেই অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। ফলে দেশটি আবারও উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে; গাদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ার মত ইয়েমেনেও গড়ে উঠেছে তিনটি সরকার।
বর্তমানে ইয়েমেনের রাজধানী ও তার আশপাশের কিছু অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে আনসারুল্লাহ ও তার মিত্র পিপলস কংগ্রেস। অন্যদিকে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চল ও বিশেষ করে এডেন নিয়ন্ত্রণ করছে মানসুর হাদির অনুচর গোষ্ঠী। আর হাদরামাউত ও আবিন অঞ্চলে রয়েছে মূলত আলকায়দার কর্তৃত্ব।
ইয়েমেনে কথিত শান্তি আলোচনা হয়তো আবারও শুরু হবে। কিন্তু দেশটির সংকট-সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশী শক্তিশালী ও মূল পক্ষগুলো যতদিন ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে একটি রোডম্যাপ গঠনে একমত না হবে ততদিন এ ধরনের আলোচনা ইয়েমেনের সংকট হ্রাসে তেমন কোনো প্রভাব রাখবে না বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
ইয়েমেনে ইরাকের মত একটি ফেডারেল পদ্ধতির রাষ্ট্র-ব্যবস্থা চলমান সংকট হ্রাসের জন্য সহায়ক হতে পারে। কিন্তু রিয়াদ তার ক্রীড়নক মানসুর হাদি সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিচ্ছে। ফলে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে সংলাপ। #
পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/১৩