আপোষ আলোচনার ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণার প্রভাব (এক)
(last modified Sat, 23 Dec 2017 12:01:04 GMT )
ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭ ১৮:০১ Asia/Dhaka

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘটনায় মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়েছে।

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘটনায় মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ট্রাম্প সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এই ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, নিজের স্বার্থে আমেরিকা কোনো ধরনের আইন-কানুন বা রীতিনীতির তোয়াক্কা করে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ পদক্ষেপের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে অপমান করেছেন এবং হাজার বছরের পুরনো ও ধর্মীয় মূল্যবোধে সমৃদ্ধ মুসলিম বিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রকারান্তরে এই ঐতিহাসিক শহরের ওপর ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ট্রাম্পের এই ঘোষণার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আমরা তিন পর্বের একটি ধারাবাহিক আলোচনা প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ট্রাম্প এমন সময় জেরুজালেম সম্পর্কে এই বিতর্কিত ঘোষণা দিয়েছেন যখন ইহুদিবাদী ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে তার আগ্রাসী নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় এই দখলদার শক্তির পক্ষ নিয়ে আমেরিকার যেকোনো পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে ভয়াবহ সংকটের জন্ম দিতে পারে। ট্রাম্প আসলে তার এ ঘোষণার মাধ্যমে পুরনো ক্ষত উস্কে দিয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করা সম্ভব হলে ইহুদিবাদী সরকার নিজের অবস্থান আগের চেয়ে আরো বেশি মজবুত করতে পারবে। কাজেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য তেল আবিব এখন মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধ উস্কে দিতে পারে যাতে এসব দেশ জেরুজালেমকে বাদ দিয়ে নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি তার একাধিক বক্তৃতায় আরব দেশগুলোর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক থাকার কথা প্রকাশ করে দিয়ে মুসলিম বিশ্বের কাছে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যের একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।

মুসলিম চিন্তাবিদরা মনে করছেন, এ অবস্থায় জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে ইহুদিবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য এখনই মুসলিম বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং বায়তুল মুকাদ্দাসকে একবার ইসরাইলের অংশ বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায় করে ফেলতে পারলে এরপর এই শহর মুক্ত করা মুসলমানদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

এদিকে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এতটা ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক ছিল যে, মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প ও ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব পর্যন্ত এ ঘোষণার সমালোচনা করতে বাধ্য হয়েছে। একজন সৌদি কর্মকর্তা এ সম্পর্কে বলেছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের পরিণতি ভয়াবহ হবে এবং গোটা মুসলিম বিশ্ব উত্তাল হয়ে উঠবে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আমেরিকা এতদিন ফিলিস্তিনিদের অধিকার লঙ্ঘন করে বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য হলেও কথিত যে শান্তি প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছিল ট্রাম্পের এ ঘোষণার ফলে তা এগিয়ে নেয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে গেল।  

এদিকে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় তেল আবিবের ধৃষ্টতা এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম বিশ্ব ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে বায়তুল মুকাদ্দাস ও আল-আকসা মসজিদের মতো পবিত্র স্থানগুলোর জন্য হুমকি বলে মনে করছে। বিশ্বের দেড়শ’ কোটি মুসলমান ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।  মুসলমানরা এখন খুব সঙ্গত কারণেই মনে করছেন যে, মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি মধ্যপ্রাচ্য ও গোটা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

এদিকে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা বা পিএলও ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে আপোষ প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে এতদিন বহু ধরনের ছাড় দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পরও ট্রাম্পের ঘোষণাকে মেনে নিতে পারেনি। পিএলও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের ফলে আপোষ প্রক্রিয়ার মৃত্যু ঘটবে। ওয়াশিংটনে পিএলও দপ্তরের প্রধান হিসাম জুমলুত এ সম্পর্কে বলেছেন, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর আর তেল আবিবের সঙ্গে কোনো আলোচনা হতে পারে না। ট্রাম্পের এই বিতর্কিত ঘোষণার পর মুসলিম বিশ্বের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে মার্কিন সরকার ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ দমনের ক্ষেত্রে তেলআবিবকে ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিয়েছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স খবর দিয়েছে। বার্তা সংস্থাটি মার্কিন সরকারের একটি দলিলের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, আমেরিকা ইসরাইলকে বলেছে, “আমরা জানি যে, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণায় আপনারা খুশি হয়েছেন কিন্তু তারপরও ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকুন। ”

ওই দলিলে আরো বলা হয়েছে, “ট্রাম্পের এই ঘোষণার ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর এই ঘোষণার নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিরুদ্ধে এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লেবাননের হিজবুল্লাহ মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে কিছু আরব দেশের উদাসীনতার কারণে আমেরিকা এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পেয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা কিছুদিন পর আরব দেশগুলোর কাছ থেকে একথা শুনতে পাবো যে, ‘আমেরিকার এই ঘোষণাকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই। ’অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ‘বেলফোর’ ঘোষণার মাধ্যমে যেমন ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ট্রাম্প এই ঘোষণার পর জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।

সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ আরো বলেন, “আমেরিকার কাছে ইসরাইলের চেয়ে ঘনিষ্ঠ আর কোনো মিত্র নেই। যেসব আরব দেশ নিজেদেরকে আমেরিকার মিত্র বলে মনে করে ওয়াশিংটনের কাছে তাদের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। ইহুদবাদী ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করা ছাড়া আমেরিকার কাছে আর কোনোকিছুর মূল্য নেই।” হাসান নাসরুল্লাহ ট্রাম্পের ঘোষণাকে ‘দ্বিতীয় বেলফোর ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বাস্তবতা হলো- গত কয়েক দশক ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইল যে চেষ্টা চালিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল এবং তার জন্য অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প এক মুহূর্তের মধ্যে তেল আবিবের জন্য তা সম্ভব করে দিয়েছেন। এ বিষয়টি মুসলমানদের জন্য সত্যিকার হুমকি তৈরি করেছে। এ ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কাছে থেকে ফিলিস্তিনের বুক লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছেন। কারণ, জেরুজালেম হাতছাড়া হয়ে গেলে ফিলিস্তিন নামের আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব অবশিষ্ট থাকবে না।

মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের আত্মপরিচিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে ফিলিস্তিন যে ভূখণ্ডকে জেরুজালেম ছাড়া কল্পনা করা যায় না। এ কারণে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণ বাদ দিলেও ট্রাম্পের এ ঘোষণা মুসলমানদের জন্য আত্মসম্মান রক্ষা করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটি এখন আর ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমকে মুক্ত করার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।

আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্টরা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার আপোষ আলোচনার মাধ্যমে জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প সে চক্ষুলজ্জাবোধটিও হারিয়ে ফেলেছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের দেড়শ কোটি মানুষ জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী বলে মনে করে এবং এ প্রশ্নে তারা কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়।

তো বন্ধুরা, এরই সঙ্গে শেষ করছি ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণা সম্পর্কিত আলোচনার আজকের ১ম পর্ব। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/২১

ট্যাগ