আপোষ আলোচনার ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণার প্রভাব (তিন)
(last modified Sat, 13 Jan 2018 14:18:44 GMT )
জানুয়ারি ১৩, ২০১৮ ২০:১৮ Asia/Dhaka

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোসহ সারাবিশ্ব থেকে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো অব্যাহত রয়েছে।

ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধিতা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পর্যন্ত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমেরিকা ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের বাকি সবগুলো দেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর একদিকে রয়েছে সারাবিশ্ব এবং অন্যদিকে রয়েছে শুধুমাত্র আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইল।

ট্রাম্পের জেরুজালেম সম্পর্কিত বিতর্কিত ঘোষণার প্রভাব নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক আলোচনার আজ রয়েছে তৃতীয় ও শেষ পর্ব।

মার্কিন কংগ্রেস ১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর ইসরাইলস্থ মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেম শহরে স্থানান্তরের প্রস্তাব পাস করে। কিন্তু তখন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার সাহস দেখাননি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারাভিযানের সময় জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচিত হলে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবেন।

ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর তার এই ঘোষণা বাস্তবায়ন না করার জন্য বিশ্বব্যাপী দাবি ওঠে। কিন্তু সেসব তোয়াক্কা না করে তিনি জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ট্রাম্পের আগ পর্যন্ত সব প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসে অনুমোদিত প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রতি ছয় মাস পরপর স্থগিত করে আসছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তা স্থগিত রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন।  আমেরিকার অভ্যন্তরীণ আইনে এই প্রক্রিয়া বৈধ হলেও আন্তর্জাতিক আইনে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা সম্পূর্ণ অবৈধ।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুযায়ী জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস ইসরাইল অধিকৃত একটি শহর হিসেবে গণ্য। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নিরাপত্তা পরিষদে পাস করা এক প্রস্তাবে বলা হয়, “১৯৬৭ সালে দখলীকৃত ভূখণ্ড ইসরাইল অধিকৃত ভূখণ্ড হিসেবে পরিচিতি পাবে; অবশ্য ফিলিস্তিন-ইসরাইল আলোচনায় কোনো সমঝোতা অর্জিত হলে এর ব্যতিক্রম করা যাবে।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ থেকে এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, দেশটি মধ্যপ্রাচ্য আপোষ আলোচনায় সব সময় ইহুদিবাদী ইসরাইলের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মধ্যপ্রাচ্য আপোষ প্রক্রিয়ায় মার্কিন ভূমিকাকে তিন অংশে ভাগ করেছেন। তিনি বলেন: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, মুসলিম দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সৃষ্টি করা এবং মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করা হচ্ছে আমেরিকার প্রধান কাজ। আর এখন মার্কিন সরকার জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করছে।

অবশ্য ট্রাম্পের ঘোষণার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছে। দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে আপোষ আলোচনায় ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে চরম নমনীয় আচরণ এবং ওয়াশিংটনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট থাকার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের প্রথম ক্বেবলাসমৃদ্ধ শহরের ব্যাপারে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘোষণা দেয়ার সাহস পেয়েছেন।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদার প্রকৃতি ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যকামী লক্ষ্যের কথা বিবেচনা করে মুসলিম বিশ্বকে কুদস দিবস পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি প্রতি বছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার এ দিবস পালনের ডাক দেন। তার এ আহ্বানের কারণে ফিলিস্তিন সংকট মুসলিম বিশ্বের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়। এ সম্পর্কে ইমাম খোমেনী (রহ.) তার এ ভাষণে বলেন, “কুদস দিবস শুধু ফিলিস্তিনিদের দিবস নয় বরং এটি এমন এক দিবস যেদিন পরাশক্তিগুলোকে একথা বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তারা আর কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালাতে পারবে না। ”

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীও সম্প্রতি এক ভাষণে আমেরিকা, ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তাদের তাবেদার সরকারগুলোকে ‘যুগের ফেরাউন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এসব শক্তির পক্ষ থেকে মুসলিম উম্মাহ’র মধ্যে মতবিরোধ ও যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কিছু মার্কিন রাজনীতিবিদ ইচ্ছায় হোক-অনিচ্ছায় হোক দাবি করেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলকে নিরাপদে রাখতে পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে রক্তাক্ত মুসলিম বিশ্ব অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারবে না।”

সর্বোচ্চ নেতা আরো বলেন, “মুসলিম বিশ্বের এক নম্বর রাজনৈতিক সমস্যা হচ্ছে ফিলিস্তিন সংকট। কাজেই ফিলিস্তিনি জাতিকে ইহুদিবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সবার চেষ্টা করা উচিত। ”

ইসলামের শত্রুরা জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে যে দাবি করছে সর্বোচ্চ নেতা তাকে শত্রুদের অক্ষমতা ব্যর্থতার ফল বলে বর্ণনা করেন। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, “নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্ব এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, ইহুদিবাদীরা এর মাধ্যমে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রিয় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত হবে।”

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এর আগেও ফিলিস্তিন সংকটকে ধামাচাপা দেয়ার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতনতামূলক ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ২০১৪ সালের নভেম্বরে দেয়া এক ভাষণে ফিলিস্তিনকে মুসলিম বিশ্বের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে মুসলিম বিশ্বকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “আমাদের প্রথম ক্বেবলা আল-আকসা মসজিদ, জেরুজালেম ও ফিলিস্তিন সংকটের কথা ভুলে যাবেন না। শত্রুরা আপনাদের মন থেকে এই বিষয়গুলোকে মুছে ফেলতে চায়। ”

মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশেষ করে উগ্র তাকফিরি জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশের তৎপরতা প্রমাণ করে, মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে একটি স্পর্শকাতর মুহূর্ত অতিক্রম করছে। এ অবস্থায় মুসলিম বিশ্বকে অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো শত্রুর ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকাংশে সফল হলেও চুপচাপ বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই।

জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বর্তমান স্পর্শকাতর মুহূর্তকে বেছে নেয়ায় বোঝা যায়, বিশ্ব ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্র মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে চায়। তারা আল-আকসা মসজিদ ও জেরুজালেম শহরের ইসলামি পরিচিতি ধুয়েমুছে ফেলতে চায়। আমেরিকা জানে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অশুভ লক্ষ্যগুলো চরিতার্থ করার জন্য ইহুদিবাদী ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়ার বিকল্প নেই।

অথচ মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের তৃতীয় পবিত্রতম এই স্থানকে রক্ষা করা মুসলিম বিশ্বের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। এখন আর মৌখিক নিন্দা জানানোর মাধ্যমে দায়িত্ব শেষ করার সুযোগ নেই। মুসলমানদের একথা প্রমাণ করে দিতে হবে, ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সব মুসলমানের বুকে আঘাত করেছেন।

তো বন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণা সংক্রান্ত আলোচনার তৃতীয় ও শেষ পর্ব।  আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/১৩

ট্যাগ