পুরনো সংবাদ-মাধ্যমগুলোর সঙ্গে ট্রাম্প ও তার সহযোগীদের যুদ্ধ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার পর থেকে এ পর্যন্ত নানা বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন। সংবাদ-মাধ্যম ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তার যুদ্ধ ঘোষণা এইসব বিতর্কের অন্যতম। সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের এক হাত নিতে ভুলছেন না তিনি।
ক্ষমতায় বসার প্রথম দিনই ট্রাম্প সংবাদ-মাধ্যমগুলোকে মিথ্যাবাদী ও সাংবাদিক বা গণমাধ্যম-কর্মীদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসৎ বলে অভিহিত করেছেন। এই একই ট্রাম্প প্রায় প্রতি দিন সকাল শুরু করেন টুইটারে বিতর্কিত কিছু বার্তা দিয়ে। তার এসব বার্তার সংখ্যা কখনও কখনও দুই অংকের সংখ্যায় পৌঁছে যায়। দুই কোটিরও বেশি ইউজার ট্রাম্পের এইসব বার্তা দেখার জন্য তার ব্যক্তিগত পেইজে ঢু মারছেন।
ট্রাম্প তার বার্তায় ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করছেন এবং নানা দেশ ও আন্তর্জাতিক চুক্তির বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছেন। এমনকি গাড়ি নির্মাতা ফোর্ড কোম্পানিকেও হুমকি দিয়েছেন। ট্রাম্প খুব বেশি মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার ব্যবহার করছেন বলে অনেকেই এ বিষয়ে তার নিন্দা করেছেন। এর জবাবে ট্রাম্প ফ্যাক্স নিউজকে বলেছেন, ‘টুইট করতে আমার ভালো লাগে না, আমার অন্য অনেক কাজও আছে। কিন্তু গণমাধ্যমগুলো খুবই মিথ্যাবাদী। আর টুইটই হচ্ছে (ওদের মোকাবেলায়) আমার প্রতিরোধের একমাত্র হাতিয়ার। যখন আমার নামে মিথ্যা কিছু ছাপানো হয় বা প্রচার করা হয় তখন আমি টুইটের মাধ্যমে জবাব দিতে পারি ও এভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। যদি মিডিয়াগুলো সৎ হতো তাহলে আমি কখনও টুইট করতাম না। কিন্তু মিডিয়াগুলো তো সৎ নয়।
ট্রাম্প মিডিয়াগুলোর ওপর হামলা শুরু করেছিলেন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় থেকেই। তিনি বলেছিলেন, আমি তো হিলারির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি না, বরং গণমাধ্যমগুলোর সঙ্গেই লড়ছি।
ট্রাম্প অনেকবার বড় বড় মার্কিন মিডিয়াগুলোর ওপর চড়াও হয়েছেন। মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসও তার হামলার শিকার হয়েছে। তিনি একবার বলেছিলেন, দেউলিয়া হতে যাচ্ছে-এমন এক দৈনিকের কথা বলতে চাই। এ দৈনিক খুব শিগগিরই অস্তিত্ব হারাবে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় এ দৈনিকে প্রকাশিত নানা জনমত-জরিপের ফলাফলকেও প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন তিনি।
ট্রাম্প এ দৈনিকের সংবাদ-সূত্রগুলোর আদৌ কোনও অস্তিত্ব নেই বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কয়েক দিন আগে ট্রাম্প বলেছেন, আশা করছি একজন যোগ্য ও চিন্তাশীল ব্যক্তি এসে সবচেয়ে নিচু স্তরের এই হতভাগা ও মিথ্যাবাদী নিউইয়র্ক টাইমসকে কিনে নেবেন অথবা এটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করবেন কিংবা সম্মানজনকভাবে পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দেবেন!
ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিকো, ওয়াশিংটন পোস্ট ও হাফিংটন পোস্টের মত বিখ্যাত মিডিয়াগুলোকেও অনির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন।
তিনি সিএনএন টেলিভিশন সম্পর্কে বলেছেন, ‘সিএনএন ঘৃণা-ব্যঞ্জক। আপনারা জানেন যে এই মিডিয়ার জনপ্রিয়তা ক্রমেই খুব দ্রুত নিচের দিকে নামছে। তাই আমি এই টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হইনি। সি এনএন হচ্ছে দুর্নীতিবাজ ও পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যম।’
বাস্তবতা হল খুব কম রাজনীতিবিদই সাংবাদিক মহল বা গণমাধ্যমের সামনেই গণমাধ্যম-বিরোধী এ ধরনের কথা বলেন এবং প্রকাশ্যেই মিডিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ উগরে দেন।
ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজে প্রবেশের আগে মার্কিন মিডিয়াগুলোর নির্বাহী ও সম্পাদকদের সঙ্গে ট্রাম্প টাওয়ারে বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকে মিডিয়ার কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে বলেছেন: আমরা এখন এমন এক হলে রয়েছি যে স্থানটি মিথ্যাবাদী লোকে ভরা। তিনি সিএনএনএ’র অভিজ্ঞ উপস্থাপক উলফ ব্লিৎজারকে সম্বোধন করে বলেছেন: চুপ করুন! বেআদবি করবেন না! আপনি এক ভুয়া সংবাদ সংস্থা।
ট্রাম্প নির্বাচনের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সিএনএন-এর বিশেষ প্রতিবেদক জিম কাস্তাকে বলেছেন: চুপ কর! আমি তোকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেব না। তোদের খবর হল ভুয়া।
সিএনএন-এর সাংবাদিক ট্রাম্পকে বললেন, আপনি যখন আমাদের সংবাদ সংস্থাকে আক্রমণ করছেন তখন আমাদেরকে অন্তত প্রশ্ন করার সুযোগ দিন। ট্রাম্প তখন বললেন, তোমাদের সংবাদ সংস্থা মিথ্যা খবর প্রচার করে। তাই তোমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেব না। তোমাদের সংস্থাটি খুবই ভয়ানক। সাংবাদিক আবারও একই অনুরোধ জানালে ট্রাম্প বলেন: চুপ কর! বেয়াদবি করবি না!
ট্রাম্প ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলোকেও এক হাত নিয়েছেন। এইসব সংবাদমাধ্যম ইউরোপে ইসলামপন্থীদের হামলার খবর যথেষ্ট মাত্রায় প্রচার করছে না এবং এ বিষয়ে উদাসীন ও কম-সক্রিয় বলে তিনি দাবি করেছেন। কিন্তু জার্মানির সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ফ্রাঙ্ক অ্যাভরাল বলেছেন, ট্রাম্প বাস্তবতার বিপরীতে এমন সব বিষয়কে জনসমক্ষে টেনে আনছেন যা তার দৃষ্টিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। অথচ কেউ যদি জার্মানিতে প্রকাশিত বিষয়গুলোর তালিকার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে নজর দেন তাহলে দেখতে পাবেন যে ট্রাম্প যা বলছেন তা পুরোপুরি অসার ও অর্থহীন। অবশ্য রাজনীতির ইতিহাস বিষয়ে অধ্যাপক অ্যালেন লিচম্যান মনে করেন মূলত ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা মিডিয়ার মাধ্যমেই বেড়েছে। তিনি কেবল বাহ্যিক দৃষ্টিতে এইসব সংবাদ মাধ্যমের নিন্দা করছেন। মিডিয়াগুলোর সুবাদেই ট্রাম্প মিডিয়ার ফসলে পরিণত হয়েছেন।
দৃশ্যত অনেকাংশে বাস্তব কথাই বলেছেন লিচম্যান। কারণ, ফক্স নিউজ ২০১৬ সালের মে মাসে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ফাঁস করে যে ট্রাম্প বেশ কয়েক বছর আগে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে ওয়াশিংটন পোস্ট যে ফাইলটি পেয়েছে তা ট্রাম্প নিজেই বাইরে প্রকাশ করেছেন। মার্কিন এই দৈনিক খবর দিয়েছিল যে এ বিষয়ে পাওয়া অডিও ফাইলে দেখা গেছে ট্রাম্প ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই দৈনিকের কাছে নিজেকে ট্রাম্পের মুখপাত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং এই পরিচয় দিয়ে ‘ট্রাম্প’-এর ব্যক্তিগত নানা তথ্য তাদের কাছে দিতেন। ভ্যানিটি ফেয়ার সাময়িকীর সাংবাদিক ফক্স নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ট্রাম্প জন মিলার ও জন ব্রাউনসহ নানা ছদ্মনামে সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং নিজ জীবনের নানা তথ্য তাদের দিতেন।
পিপল ম্যাগাজিনের সাবেক সাংবাদিক ‘সু কার্সওয়েল’ও টেলিফোনে ওই সাময়িকীর সঙ্গে ১৯৯১ সালে ট্রাম্পের যোগাযোগ প্রসঙ্গে বলেছেন, ট্রাম্প আবারও তার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিচয় গোপনের ব্যাপারে ক্ষমা চান এবং তাকে ও তার দুই সহকর্মীকে সন্তুষ্ট করার জন্য নৈশভোজের দাওয়াত দেন। কিন্তু পরে ট্রাম্প এই ঘটনা অস্বীকার করায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তার মতে ট্রাম্পের উচিত আবারও তার কাছে ক্ষমা চাওয়া। কারণ, ট্রাম্প ওই ঘটনা অস্বীকার করায় তিনি মিথ্যাবাদী সাংবাদিক হিসেবে সমাজে পরিচিত হলেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে বার বার ট্রাম্পের এ ধরনের আচরণ অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম দিনই ট্রাম্প সিআইএ’র অফিসে গিয়ে মিডিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলেছেন, আমি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছি। মিডিয়া-কর্মী বা সাংবাদিকরা হলেন বিশ্বের সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি।
কৌশলগত বিষয়ে ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা স্টিভেন বানোনও নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সংবাদ সংস্থাগুলো নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ভুল ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করে ইজ্জত হারিয়েছে। তাই এসব সংস্থার উচিত লজ্জিত হওয়া ও মুখ বন্ধ করে কেবল কান খোলা রাখা। আমাদের দেশে গণমাধ্যমই বিরোধী দল ডেমোক্রেট দল নয়।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যমগুলো মনে করে ট্রাম্প মিডিয়ার বিরুদ্ধে যা বলছেন তা কেবলই মিথ্যা অভিযোগ তথা অপবাদ। তাই সবগুলো মার্কিন সংবাদমাধ্যমের উচিত একযোগে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া। মার্কিন মিডিয়াগুলো বলছে, এখনও প্রতি তিন মার্কিন নাগরিকের মধ্যে দু’জনই তাদের সংবাদকে বিশ্বাস করে। তাই মিডিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বিষোদগার জনগণের ওপর প্রভাব ফেলবে না। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সোশাল মিডিয়ার তুলনায় প্রচলিত মিডিয়াগুলোর অনগ্রসরতার বিষয়টি বুঝতে পেরে কী এই নতুন মিডিয়াগুলোর ওপরই নির্ভর করতে চান?
নির্বাচন সম্পর্কে ভুল পূর্বাভাস দিয়ে পুরনো মডেলের মিডিয়াগুলো কী ক্ষমতা হারাচ্ছে নতুন মিডিয়াগুলোর কাছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দিনগুলোই বলে দেবে পুরনো ধারার সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ। #
পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/১৪