বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট কেন?
'বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের পেছনে ব্যবস্থাপনার ক্রটি ছিল'
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্যাপক মাত্রায় লোড শেডিং হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা বক্তব্য দিয়েছেন। তো বিদ্যুৎ খাতের সমস্যা নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত।
তিনি বলেছেন, একশ শতাংশ ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার যে অঙ্গীকার সরকারের ছিল সেখানে মনে হয় একটি সংকটের মধ্যে পড়েছে। বিদ্যুৎ সংকটের নানা কারণ থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে দেশের বিদ্যুৎ খাত একটা বড় সংকটের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মনে হয় যে কোথাও একটা ব্যবস্থাপনার ক্রুটি ছিল। আমরা অনেক বেশি আমদানি নির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর যে জোর দিয়েছি। সে বিষয়ে মনে এখন পুর্নবিবেচনা করার সময় এসেছে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: মি. শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশে বিদ্যুত খাতে বিরাট সাফল্যের দাবি সত্বেও হঠাৎ করেই বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সামজিক মাধ্যমগুলোতে অনেকেই শ্রীলংকা পরিস্থিতির আশংকা করছেন। কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
শ্যামল দত্ত: দেখুন, বাস্তবতা হচ্ছে এটাই যে বাংলাদেশে গত কয়েকদিন লোড শেডিংএর পরিমাণ বেড়েছে। একশ শতাংশ ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার যে অঙ্গীকার সরকারের সেখানে মনে হয় সরকার একটি সংকটের মধ্যে পড়েছে।
এরজন্য অনেকগুলো কারণ দায়ী। সরকারের পক্ষ থেকে এজন্য নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক এলাহি সাহেব ব্রিফিং করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংকট থাকবে বলে আশঙ্কা করছি। আর এর প্রধান কারণ হিসেবে বারবার বলা হচ্ছে- এলএনজির অভাব। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে যে জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে সেটিকে মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ সংকটের পেছনে এর বাইরেও অনেক কারণ রয়েছে বলে অনেকে মতামত প্রকাশ করেছে।
রেডিও তেহরান: জ্বি শ্যামল দত্ত আপনি বিদ্যুৎ ঘাটিতির কারণ নিয়ে আপনি কথা বলছিলেন। বেশ কিছু কারণ আপনি তুলে ধরলেন। তো এর বাইরে অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতাই দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের বড় কারণ। দৈনিক প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে এই বক্তব্য সামনে এনেছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
শ্যামল দত্ত: দেখুন, বাংলাদেশে যারা জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের কয়েকজনের বক্তব্য সম্প্রতি টেলিভিশিন এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখেছি। তারা মনে করছেন যে, দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি উৎপাদনের বিষয়ে নজর দেয়া উচিত ছিল। আমরা অনেক বেশি আমদানি নির্ভর জ্বালানির উপর নির্ভর করেছি যে কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বর্তমানে একটা সংকটের মধ্যে পড়েছে। তবে বাস্তবতা এটাই দেশের বিদ্যুৎ খাত একটা বড় সংকটের দিকে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন যে, আমাদের জ্বালানি সাশ্রয়ী হতে হবে। লোড শেডিং করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া কয়েকজন মন্ত্রী এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। বিশেষ করে তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনলাম। তিনি বলেছেন, অষ্ট্রেলিয়া জাপানসহ বিভিন্ন দেশে জ্বালানি সাশ্রয় করা হচ্ছে, লোড শেডিং করা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জ্বালানির দাম বেড়েছে। এটা সত্য। কিন্তু ব্যাপারটি হচ্ছে যে বাংলাদেশে মনে হয় যে কোথাও একটা ব্যবস্থাপনার ক্রুটি ছিল। আমরা অনেক বেশি আমদানি নির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর যে জোর দিয়েছি সে বিষয়ে মনে এখন পুর্নবিবেচনা করার সময় এসেছে।
রেডিও তেহরান: শ্যামল দত্ত, অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতার কারণের পাশাপাশি প্রথম আলোর এ প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, দেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মুজদ থাকা সত্ত্বেও গ্যাস স্বল্পতার কথা বলে ২০১৫ সালে তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই ইলাহি চৌধুরী ইচ্ছে করে দেশকে এলএনজি আমদানির দিকে নিয়ে গেছেন। এ অভিযোগ সম্পর্কে কী বলবেন আপনি?
শ্যামল দত্ত: দেখুন, এই অভিযোগটা আছে এবং এর বাস্তবতাও আছে। বিশেষ করে আমাদের নিজেদের দেশে যেসব জ্বালানি ক্ষেত্র আমরা যতটুকু জানি আমাদের সমুদ্র সীমা নির্ধারণের পর একটা উদ্যোগের কথা আমরা শুনেছিলাম যে সমুদ্রের নিচে যেসব তেল-গ্যাস আছে সেগুলোকে আমরা এক্সপ্লোর করব। কিন্তু সেই জায়গাটিতে আমরা খুব বেশি অগ্রসর হইনি। আমার মনে হয় এখানে কোথাও একটা পরিকল্পনার ঘাটতির কথা আমরা শুনছি। বিশেষ করে নৃতাত্ত্বিকরা একথাগুলো বলছেন যে, অবসরে যে ড্রিলিংগুলো হওয়া উচিত ছিল এবং যেসব কোম্পানির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছিল সেসব চুক্তিতে আমরা খুব একটা অগ্রসর হই নি। আমরা বরং বিভিন্ন পাওয়ার প্লান্ট তৈরিতে বেশি মনোযোগী ছিলাম এবং তার অধিকাংশই আমদানি নির্ভর জ্বালানির উপর বিদ্যুৎ তৈরির পদ্ধতি।
পাশাপাশি আমাদের দেশে আরেকটা সুযোগ ছিল সেটি হচ্ছে সোলার এনার্জি। সেগুলো কিন্তু আমরা করি নি। সরকারের কাছে অনেকগুলো সোলারের প্রকল্প পড়ে আছে যেগুলো গুরুত্ব পায় নি। বরং আমরা রেন্টাল ইউনিট, গ্যাস নির্ভর ও কয়লা নির্ভর বিদ্যুতের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। এসব থেকে মনে হয় আমাদের পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাব ছিল যার ফল আমরা এখন ভোগ করছি। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ হবে এমনটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যদি একক জ্বালানির ওপর বেশি জোর দেয়া হয় আর সেটি যদি সংকটে পড়ে তাহলে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাটা ভেঙে পড়ে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও সেরকমটি হয়েছে বলে আমার ধারনা।
রেডিও তেহরান: শ্যামল দত্ত আমরা সাক্ষাৎকারের শেষ প্রান্তে এসে গেছি। সবশেষে জানতে চাইব, বিদ্যুতের সংকটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, বিপনি বিতান, দোকানপাট, অফিস-আদালত এবং বাড়িঘরে আলোকসজ্জা না করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বানে কতটা সাড়া পড়তে পারে এবং কতটা লাভ হবে?
শ্যামল দত্ত: দেখুন, এটা খুব একটি উদ্যোগ কিন্তু এর বিপদ হচ্ছে এর সঠিক ব্যবস্থাপনা দরকার। কিন্তু আপনি যে পাড়ায় পাড়ায় বিদ্যুৎ বন্ধ করবেন, সামাজিক অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বন্ধ করবেন সেই ধরনের ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে করা খুবই কঠিন। আমি অতীতেও দেখেছি এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো খুব বেশি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি। তবে এটা করতে পারলে- আমরা যদি একটু কৃচ্ছতা সাধনের দিকে যাই, আমরা যদি নিজেরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে একটু মিতব্যয়ী হই তাহলে কিছুটা হবে। কিন্তু এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা হতে পারে না। সেক্ষেত্রে অলটারনেটিভ জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে। আরেকটি দুঃসংবাদ আছে। আমাদের মাননীয় জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী বললেন যে, জ্বালানি তেলের দামও বাড়বে। ফলে এটি মানুষকে কষ্টের মধ্যে ফেলবে। আমরা জানি যে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে। এলএনজির পাশাপাশি অন্যান্য জ্বালানির দামও বাড়ছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও কোনো কোনো দেশ ভালো ব্যবস্থাপনা করছে। যেমন ধরুন- ভারত এবং চীন রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানী তেল কিনছে। এক্ষেত্রে আমরা কি করব সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। বিশেষ করে রাশিয়ার তেলের ওপর আমেরিকার যে নিষেধাজ্ঞা-তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন এ ধরনের অবরোধ কার্যত মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ফলে আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রীর এটি একটি কঠিন দৃষ্টিভঙ্গি। সত্যিকারার্থে আমরা যদি দেখি সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী এমন মন্তব্যও করেছেন। সেক্ষেত্রে যদি বিকল্প চেইন তৈরি করতে হয় সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। আমি মনে করি সেটা দিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের সংকটের কিছু সমাধান হবে।#
রেডিও তেহরান: তো. মি. শ্যামল দত্ত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শ্যামল দত্ত: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৭