আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
বাংলা উপেক্ষিত সরকারি অফিস-আদালতে; বাংলায় রায় লেখার প্রচলন কম
বাংলাদেশে মহাসমারোহে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় এই ভাষার গৌরব ধরে রাখতে। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই মানুষ যেন সব ভুলে যায়। মুখের ভাষা হিসেবে আমরা বাংলাভাষা ব্যবহার করে থাকলেও আমাদের দেশে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে আইন-আদালতে বাংলাভাষার এখনো পুরোপুরি ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার দাপটে বাংলা ভাষা যেন অসহায়।
ভাবলে অবাক হয়, যে ভাষার জন্য আমাদের জীবন দিতে হয়েছে সে ভাষার ব্যবহার আজও আমরা সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে পারিনি। আর কিছু অফিস ও নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার হলেও প্রমিত বাংলা ভাষা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।
আমাদের দেশে ১৯৮৭ সালে “বাংলা ভাষা প্রচলন আইন” নামে একটি আইন পাস হয়। এই আইনে উল্লেখ করা হয়- বাংলাদেশের সবখানে অর্থাৎ সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিদেশের সাথে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইন বিষয়ক কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ করা হলেও দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে অধস্তন আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। উচ্চ আদালতে ২০১২ সালে হাইকোর্ট বিধিমালা ১৯৭৩ সংশোধনের মাধ্যমে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষা ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়। এখন ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় রায় লেখা শুরু হলেও সংখ্যায় অনেক কম। ১৯৯০ সালে উচ্চ আদালতে প্রথমবার তৎকালীন বিচারপতি এ আর এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী আদালত কার্যক্রম বাংলায় লিখেছিলেন।
১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ হওয়ার পর আদালত প্রাঙ্গণে হইচই পড়ে গিয়েছিল। আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করে রিট হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রায়ে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে কোনো বাধা থাকেনি। আশ্চর্যজনকভাবে সরকার ওই রিটের বিরুদ্ধে কখনো আপিল করেনি। যে বাংলা ভাষার জন্য মানুষ রক্ত দিয়েছে, সেই ভাষাকে সম্মান দেওয়ার জন্য আইনটিকে ধরে ওই রিটের বিরুদ্ধে এখন আপিল হওয়া উচিত। ওই রিট থেকে অব্যাহতি পেতে জনগণকে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সমাজের মনোভাব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ইংরেজিতে কথা বলা লোকদের ‘কুলীন’ মনে হয়। ভাষা বিশেষ প্রাধান্য পাওয়ার সুবিধা দিচ্ছে কি না, সেটাও দেখা দরকার।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩-এ উল্লেখ আছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এখানে প্রজাতন্ত্র বলতে মুলত বাংলাদেশের সমগ্র আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগকে একসাথে বোঝায়। কিন্তু তারও প্রকৃত বাস্তবায়ন নেই মাঠ পর্যায়ে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক মনে করেন, বাংলায় রায় দেয়ার বিষয়ে বিচারকদের নিজস্ব আগ্রহ উদ্যোগ খুব জরুরী। তিনি তার পেশাগত জীবনে প্রায় দুইশ’র বেশি রায় বাংলায় দিয়ে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন অনুজদের জন্যও। কিন্তু এখনো ধারার গতি প্রকৃতিতে আসেনি তেমন পরিবর্তন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ মনে করেন, জনস্বার্থে নতুন প্রজন্মকে বিশেষ করে আদালতে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতে কাজ করতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে।#
পার্সটুডে/বাদশাহ রহমান/আশরাফুর রহমান/২১