রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকার সীমাহীন নির্লিপ্ত: ফখরুলের অভিযোগ
-
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের সেনাসমাবেশে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের 'নতজানু পররাষ্ট্রনীতি'র নিন্দা জানিয়েছে বিরোধী দল বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ দলীয় চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরে মির্জা ফখরুল তার লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তের অন্তত তিন পয়েন্টে মিয়ানমার সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে গণহত্যা শুরুর সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঠিক একইভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সৈন্য সমাবেশ করেছিল। এ অবস্থায় নতুন করে শুরু হওয়া সেনাসমাবেশের কারণে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ও মিয়ায়নমারের রাখাইনে আবদ্ধ রোহিঙ্গাদের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেন, বিনা উসকানিতে রোহিঙ্গা অধুষিত আন্তর্জাতিক সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ ধরনের সমাবেশ শুধু যে মিয়ানমারের নৃতাত্ত্বিক রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জন্য আতঙ্কের বিষয় তাই নয়; একই সাথে এ তৎপরতা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিএনপি’র এ নেতা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেন, গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তিন বছর পূর্তির প্রাক্কালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ ধরনের তৎপরতা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিক ফলাফলমাত্র।
“প্রায় ১২ লক্ষাধিক (গণমাধ্যমে প্রকাশিত) শরণার্থী সমস্যা সমাধানে যে ধরনের সমন্বিত বহুমুখী তৎপরতা নেয়া অত্যাবশ্যক ছিল ২০১৭ সালের আগস্টে সর্বশেষ রোহিঙ্গা সমস্যার সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন ও জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন অবৈধ সরকার তা নিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রাণলয়ের সর্বাধিক অগ্রাধিকার হওয়া সত্ত্বেও লাগাতার কুটনৈতিক ব্যর্থতায় তারা এখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তির অংশ হিসেবে গত বছরের ২২ আগস্ট তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সীমাহীন নির্লিপ্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে।“

মির্জা ফখরুল বলেন, “বাংলাদেশের গণবিচ্ছিন্ন বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার শুরু থেকে দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে সমস্যাকে জটিল থেকে জটিল করে তুলেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এ সমস্যাকে দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে এডহক ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানে কার্যত মিয়াননামের পাতা ফাঁদে পা দেয়া। অথচ ইতোপূর্বে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মিত্রদের যুক্ত করে বাংলাদেশ দুই-দুইবার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করেছে। সরকারের সামনে সমস্যা সমাধানে এ ধরনের ঐতিহ্যগত পররাষ্ট্রনীতির সফলতা থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণে তারা ব্যর্থ হয়েছে।“
এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যাকে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা বিবেচনাপূর্বক আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়ে সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু একনায়কসুলভ ও একগুয়ে মনোভাবাপন্ন এই অবৈধ সরকার আমাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চরম নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার মাধ্যমে বৈশ্বিক নৃজাতিগোষ্ঠীগত রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেবলমাত্র বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মূলতঃ এই চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে রাজনৈতিকভাবে অধিকারহীন করা হয়েছে। এমনকি, সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় রোহিঙ্গাদের একজন প্রতিনিধিকেও কখনোই রাখা হয়নি। অর্থাৎ যাদের নিয়ে এই সংকট এবং যারা গণহত্যা ও নৃশংসতার শিকার, তাদের কণ্ঠস্বর আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাতেই শোনা যায়নি, বা মিয়ানমারের পরিকল্পনামতো নতজানু বাংলাদেশ সরকার শুনতে দেয়নি।“
“শুধু তাই নয়, চুক্তি সম্পাদনে আরেকটি বড় ব্যর্থতা ছিল বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের চুক্তি বাস্তবায়নে গ্যারান্টর হিসেবে আন্তর্জাতিক কোনো পক্ষকেই যুক্ত করতে না পারার কুটনৈতিক ব্যর্থতা। একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তার প্রতি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার চরম সংকট। ফলশ্রুতিতে এধরনের সরকারের বৈদেশিক মিশনগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের অধিক সময় ব্যয় হয় এই অবৈধ গণবিচ্ছিন্ন সরকারের টিকে থাকার স্বার্থকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। আর এর ভয়াবহ প্রভাব প্রতিফলিত হয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা সমাধানে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন পেতে সুদৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করতে না পারায়।“
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের 'কুটনৈতিক ব্যর্থতা'র ব্যাখ্যা করে মির্জা ফখরুল আরো বলেন, “২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়ে যে প্রস্তাব পাস হয়, তার পক্ষে মোট ভোট পড়েছিল ১৩৪ এবং বিপক্ষে ৯। ভোটদানে বিরত ছিল ২৮টি দেশ। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটের অধিকতর কুটনৈতিক বিশ্লেষণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতার চরম হতাশাজনক চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে। আমাদের জন্য অত্যন্ত হতাশার বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধ, সহিংসতার নিন্দা এবং নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাবেও আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন আদায় করতেও ব্যর্থ হয়েছি। যেমনটা ব্যর্থ হয়েছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আর্থিক বিচারে আমাদের প্রধান উন্নয়ন অংশীদার জাপান ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার (আঞ্চলিক জোট আসিয়ানভুক্ত) দেশগুলোরপ্রস্তাবটিতে সমর্থন আদায়ে। চীন ও রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের কুটনৈতিক ব্যর্থতায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এ অঞ্চলের অন্যতম আঞ্চলিক ফোরাম হিসেবে পরিচিত আসিয়ানকেও নূন্যতম কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি।“
এ অবস্থায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আবারো আহবান জানানো হয়েছে, “রোহিঙ্গা সমস্যা দূর করতে হলে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিন, গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করুন, বহির্বিশ্বে দেশের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করুন।“ #
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।