ইরানের সর্বোচ্চ নেতার হজবাণীর পূর্ণ বিবরণ
(last modified Fri, 08 Jul 2022 07:40:40 GMT )
জুলাই ০৮, ২০২২ ১৩:৪০ Asia/Dhaka

পবিত্র হজ উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হজরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী সারা বিশ্বের মুসলমান ও হজযাত্রীদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বাণী দিয়েছেন। তার পূর্ণাঙ্গ হজবাণী এখানে তুলে ধরা হলো:

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

ওয়ালহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মানিদিল মুস্তাফা ওআলিহিত তাহিরিন ওসাহবিহিল মুনতাজিবিন।

মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ'র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যিনি আবারও হজের বরকতময় মৌসুমে মুসলিম জাতিগুলোকে সমবেত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য এই অনুগ্রহ ও কল্যাণের পথ খুলে দিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহ এখন আবারও এই স্বচ্ছ ও চিরন্তন দর্পণে তাদের ঐক্য ও বন্ধন প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবে এবং বিভেদ ও অনৈক্যের পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে।

মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য হচ্ছে হজের দু'টি মৌলিক ভিত্তির একটি, আর অপর ভিত্তি হচ্ছে জিকির (আল্লাহকে স্মরণ) ও আধ্যাত্মিকতা। এই দুই ভিত্তি একত্রিত হলে তা মুসলিম উম্মাহকে সম্মান-মর্যাদা ও কল্যাণের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। একই সঙ্গে তা 'শক্তি-সম্মান তো আল্লাহরই এবং তাঁর রাসূল ও মুমিনদের'-এই কথার প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে। হজ্ব হচ্ছে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক এই দুই উপাদানের সংযুক্তি। আর পবিত্র ইসলাম ধর্ম হচ্ছে রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার এক গৌরবময় ও মহিমান্বিত মিশ্রণ।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে মুসলমানদের শত্রুরা আমাদের জাতিগুলোর মধ্যে এই দুই প্রাণসঞ্চারণী সুধা অর্থাৎ ঐক্য ও আধ্যাত্মিকতাকে দুর্বল করতে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছে। আধ্যাত্মিক-শূণ্যতা ও বস্তুবাদী সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে উদ্ভূত পশ্চিমা লাইফ স্টাইল বা জীবনধারার বিস্তার ঘটিয়ে তারা আধ্যাত্মিকতাকে দুর্বল করছে এবং ভাষা, বর্ণ, জাতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের মতো নানা পার্থক্যকে বড় করে তুলে ধরে ঐক্য ও বন্ধনকে হুমকিগ্রস্ত করছে।

মুসলিম উম্মাহর একটা ছোট্ট প্রদর্শন হচ্ছে হজের প্রতীকী অনুষ্ঠানমালা। এখানে সর্বশক্তি দিয়ে এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এর অর্থ হলো- একদিকে আল্লাহর স্মরণ, আল্লাহর জন্য কর্মসম্পাদন, আল্লাহর বাণীর বিষয়ে গভীর চিন্তা-ধ্যান এবং আল্লাহর  প্রতিশ্রুতির উপর আস্থাকে সবার চিন্তা-মননে জোরদার করতে হবে; আর অন্যদিকে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টির উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করতে হবে।

মুসলিম বিশ্ব তথা গোটা বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি এই মূল্যবান চেষ্টা-প্রচেষ্টার জন্য অনেক বেশি অনুকূল-এটা এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

এর কারণ হলো- প্রথমত: বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বরা এবং সাধারণ জনগণ তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের বিশাল ভাণ্ডারের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং এর গুরুত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান লিবারেলিজম ও কমিউনিজম এখন তাদের একশ ও পঞ্চাশ বছর আগের সেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। পশ্চিমা অর্থ-কড়ি ভিত্তিক গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন এবং পশ্চিমা চিন্তাবিদরা এটা স্বীকার করছেন যে, তারা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিশৃঙ্খলায় ভুগছেন।

মুসলিম বিশ্বের তরুণ-তরুণী, চিন্তাবিদ, জ্ঞান অন্বেষী ও ধর্মের অনুসারীরা এই পরিস্থিতি অবলোকন করে তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার এবং দেশে প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করছে। আর এটিই হলো ইসলামি জাগরণ যেটা সম্পর্কে  সবসময় বলে আসছি।

দ্বিতীয়ত: ইসলামি আত্ম-সচেতনতা মুসলিম বিশ্বের অন্তরে এক বিস্ময়কর ও অলৌকিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, যা মোকাবেলা করতে গিয়ে দাম্ভিক শক্তিগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আর এর নাম হলো প্রতিরোধ এবং এর সারবত্তা হলো ঈমান, জিহাদ ও আল্লাহর ওপর আস্থা থেকে উৎসারিত শক্তির প্রকাশ। এটা হলো সেই বাস্তবতা যেটা সম্পর্কে ইসলামের প্রাথমিক যুগে আয়াত নাজিল হয়েছে: 'এদেরকে লোকেরা বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ কথা তাদের ঈমানকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, 'আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক। তারপর তারা আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল, কোন অনিষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেনি এবং আল্লাহ্‌ যাতে সন্তুষ্ট তারা তারই অনুসরণ করেছিল এবং আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।'

ফিলিস্তিন হচ্ছে এই বিস্ময়কর বাস্তবতার একটি প্রকাশস্থল যা ইহুদিবাদী শাসক গোষ্ঠীকে একটি আক্রমণাত্মক ও হুঙ্কারের অবস্থান থেকে আত্মরক্ষামূলক ও নিষ্ক্রিয় অবস্থানে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং ইহুদিবাদীরা বর্তমান রাজনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও অর্থনৈতিক সংকটে জড়িয়ে পড়েছে। প্রতিরোধের অন্যান্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন এবং আরও কিছু স্থানে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।

তৃতীয়ত: এসব কিছুর পাশাপাশি গোটা বিশ্বের সামনে আজ ইরানে ইসলামের একটি রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার অহংকারপূর্ণ ও সফল উদাহরণ রয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান এত বিশাল ও অর্থবহ একটি ঘটনা যা যেকোনো সচেতন মুসলমানের চিন্তাধারা ও আবেগকে আকৃষ্ট করবেই।  কিছু ব্যর্থতা ও এই রাষ্ট্রব্যবস্থার কর্ণধারদের কিছু ভুলের কারণে যদিও ইসলামি শাসনব্যবস্থার সার্বিক সাফল্য অর্জনে ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও এই শাসনব্যবস্থার মূলনীতি থেকে উৎসারিত শক্তিশালী ভিত্তি এতটুকু নড়বড়ে হয়নি এবং তা এদেশের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই শাসনব্যবস্থার সকল আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হচ্ছে দ্বীন ইসলামের ভিত্তিতে এবং এখানকার রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে জনগণের রায়ের ওপর ভিত্তি করে। এই শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং অত্যাচারী ও দাম্ভিক শক্তিগুলোর প্রভাব থেকে এই শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ মুক্ত ও স্বাধীন। এই মূলনীতিগুলোকে কেন্দ্র করেই মুসলিম জাতি ও সরকারগুলো একবিন্দুতে মিলিত হতে পারে এবং গোটা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সার্বিক সহযোগিতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।  এগুলো হচ্ছে এমন কিছু প্রেক্ষাপট ও অনুষঙ্গ যা মুসলিম বিশ্বের অনুকূল পরিস্থিতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। কাজেই মুসলিম সরকারগুলোর পাশাপাশি ধর্মীয় ও জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী এবং সত্য অনুসন্ধিৎসু তরুণ সমাজের উচিত এই প্রেক্ষাপটকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করা।

স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের একটি আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে ভেবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিশেষ করে আমেরিকার শঙ্কিত হয়ে পড়ার কথা। আর তা যাতে ঘটতে না পারে সেজন্য তার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার কথা এবং বাস্তবে হয়েছেও তাই। মিডিয়া সাম্রাজ্য ও নরম যুদ্ধ থেকে শুরু করে যুদ্ধের ঝনঝনানি ও ছায়াযুদ্ধের উসকানি, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, হুমকি, প্রলোভন ও উৎকোচ প্রদানসহ এ ধরনের আরো নানা উপকরণ প্রয়োগ করে আমেরিকা ও তার সমমনা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বকে তার অভিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছে। দাগী অপরাধী ও গোমড়ামুখো ইহুদিবাদী ইসরাইল এ অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদীদের ওই অশুভ লক্ষ্য চরিতার্থ করার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ দয়ায় এ ধরনের বেশিরভাগ প্রচেষ্টা এ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেনি এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে। ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে তার অপরাধযজ্ঞের সহযোগী ইহুদিবাদী ইসরাইল চরম ব্যর্থতার মুখে পড়েছে ও মর্মপীড়ায় ভুগছে। আর এর মাধ্যমে তাদের দুর্বল হয়ে পড়ার বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।

এর বিপরীতে মুসলিম বিশ্বে রয়েছে প্রাণবন্ত ও উৎফুল্ল তরুণ সমাজ। ভবিষ্যত বিনির্মাণের প্রধান পুঁজি হচ্ছে আশা ও আত্মবিশ্বাস যা মুসলিম বিশ্বে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে উত্তাল তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের সবার দায়িত্ব এই মূল্যবান পুঁজিকে সংরক্ষণ ও এর সমৃদ্ধির ব্যবস্থা করা।

এতকিছু সত্ত্বেও শত্রুর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে এক মুহূর্তের জন্যও উদাসীন হলে চলবে না; আমাদেরকে অহংকার ও উদাসিনতা থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি সতর্কতা বাড়াতে হবে এবং সর্বাবস্থায় গভীর মনযোগের সঙ্গে সর্বশক্তিমান ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে কাকুতি মিনতি করে তাঁর সাহায্য চাইতে হবে। হজ্বের আনুষ্ঠানিকতায় [হাজীদের] উপস্থিতি আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও ইবাদত এবং চিন্তা, গবেষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিশাল সুযোগ অবারিত করে দিয়েছে।

আমি সারাবিশ্বে বসবাসকারী মুসলিম ভাই ও বোনদের জন্য দোয়া করছি এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে তাদের সাফল্য, বিজয় ও সমৃদ্ধি কামনা করছি। আপনাদের দোয়া এবং মুনাজাতেও আপনাদের এই ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে হেদায়েত এবং সাহায্য প্রার্থনা করুন।

ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

 

সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী

৫ জ্বিলহাজ্জ্ব ১৪৪৩ হিজরি

১৪ তির ১৪০১ ফারসি সাল।

ট্যাগ