'ইরানি নারীদের প্রতি পাশ্চাত্যের প্রতিশোধ-স্পৃহা স্পস্ট'
ইরানের নারী সম্পর্কে পাশ্চাত্য কেন মিথ্যার বেসাতি ছড়াচ্ছে?
পশ্চিমা সরকারগুলো অন্য দেশগুলোর নারীদের ব্যাপারে অকার্যকর নানা নসিহত বিলিয়ে আসছে, অথচ বাস্তবে বছরের পর বছর ধরে নিজ দেশের নারীদের ব্যাপারে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে নির্দয়ভাবে তাদেরকে নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে একাকী পরিত্যাগ করেছে।
পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো মুসলিম দেশগুলোর নারীদের ব্যাপারে, বিশেষ করে ইরানের নারীদের ব্যাপারে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। আর এসব অপপ্রচারের কয়েকটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল:
১. পরিবার-কাঠামোকে দুর্বল ও হেয় করা
পরিবার হচ্ছে সমাজের ভিত্তি ও মানবজাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। পরিবার একটি দেশের জনসংখ্যার জন্য বেশ জরুরি। এ ছাড়াও শিশুদেরকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নানা মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ধার্মিকতা, সততা ও দেশপ্রেম ইত্যাদি ছড়িয়ে দেয়ার জন্যও পরিবারের অস্তিত্ব অপরিহার্য। কিন্তু পাশ্চাত্য নানা ধরনের মিথ্যাচার ও বস্তাপচা পুরনো কুসংস্কার ইত্যাদি ছড়িয়ে দিয়ে পরিবারকে মূল্যহীন হিসেবে তুলে ধরতে চায় এবং পরিবার ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে চায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ফ্রান্সের ৪৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় বৈধ দাম্পত্য ও পারিবারিক ব্যবস্থার বাইরে। সত্যিকার অর্থেই পরিবার-ব্যবস্থা সেখানে ধসে পড়েছে।
২. পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রসার ও ইরানি নারীদের ঐতিহ্যবাহী আত্মপরিচিতি বদলে দেয়া
নারীর সম্মানিত পরিচিতি ও অধিকার পশ্চিমাদের কাছে মোটেই গুরুত্বের বিষয় নয়। বরং পাশ্চাত্যে সামাজিক স্বাধীনতার যে প্রচলিত ধারণা তা তারা ছড়িয়ে দিতে চায় সবখানে। অন্য কথায় সম্প্রতি ২০২২ সালের শরৎকালে ইরানে যেসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও প্রতিবাদ আর প্রচারণা চালানো হয়েছে তাতে 'ইরানি নারীর জীবনধারা' নয় বরং তাতে কেবল 'পশ্চিমা নারীর জীবনধারা' চালু ও প্রসারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, ইরানে হিজাব ইস্যু ও এক্ষেত্রে শত্রুদের বিপুল বিনিয়োগের উদ্দেশ্য হল ইরানে নারী-কেন্দ্রিক বিপ্লব ঘটানো। তাদের মতে ইরানের ইসলামী বিপ্লব হচ্ছে পুরুষের নেতৃত্ব-কেন্দ্রিক। আর তাই এখন নারীদের বিপ্লবের মাধ্যমে এ বিপ্লবকে লণ্ডভণ্ড করা সম্ভব।
৩. নারী-বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে গৃহযুদ্ধ বাঁধানো
পশ্চিমারা চেষ্টা করছে নারীদের মধ্যে নানা ভ্রান্ত বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে এবং প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদেরকে ও তাদের পুরুষদেরকেও বিদ্রোহী করে তুলতে (উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির নারীদেরকেও)। আর এভাবে তারা দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধাতে চায়। অথচ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় এখানে সব সময়ই নারীরা উপস্থিত ছিল পুরুষদের পাশাপাশি এবং দেশের উন্নয়নমূলক তৎপরতাতেও তাদের ব্যাপক ভূমিকা লক্ষণীয়। ইরানের ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের মিছিলগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ রেকর্ড হয়ে আছে পত্র-পত্রিকার পাতায়। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পরও এক শ্রেণীর চরমপন্থী গ্রুপ সামাজিক অঙ্গনে নারীর উপস্থিতিকে সীমাবদ্ধ করতে চেয়েছে কিন্তু বিপ্লবের নেতৃবৃন্দের প্রতিরোধের কারণে বিশেষ করে মরহুম ইমাম খোমেনীর বাধার কারণে তারা এ কাজে সফল হয়নি।
ইমাম খোমেনী বলেছিলেন, পুরুষের পাশাপাশি আপনারা নারীরাও জেগে উঠুন এই খাঁটি আন্দোলনে, যেমনটি সাংবিধানিক আন্দোলন ও তামাক আন্দোলনের মত খাঁটি আন্দোলনগুলোতেও আপনারা শরিক হয়েছিলেন। এসব জাগরণে আপনাদের ভূমিকা ছিল পুরুষের চেয়েও বেশি ব্যাপক। কারণ যখন আপনারা সড়কগুলোতে জড় হয়েছেন ব্যাপক হারে এবং ট্যাংক ও বন্দুকের সামনেও বিক্ষোভ করেছেন তখন পুরুষদের শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর আপনারা পরিচ্ছন্নতা, জিহাদ ও পুনর্গঠন তৎপরতায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। আর এভাবে আপনারা ক্লান্ত ভাইদের উৎসাহ দিয়েছেন।
৪. ভোগবাদের প্রসার
পাশ্চাত্য নানা মিডিয়ার প্রচারণার মাধ্যমে সেখানকার নারীদেরকে প্রগতিশীল হিসেবে তুলে ধরছে এবং অন্যান্য অঞ্চলের নারীদেরকে পশ্চাদমুখী হিসেবে দেখাতে চায়। তারা দেখাতে চায় যে উন্নতি ও অগ্রগতি চাইলে অন্যান্য অঞ্চলের নারীদেরকেও পশ্চিমা নারীদের মতই হতে হবে। কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে চেহারাকে সুন্দর করার চেষ্টা করা ও কথিত অত্যাধুনিক মডেলের পোশাক পরা –এসবই তারা করতে চায় যাতে ভোগবাদের প্রসার ঘটে এবং তাদের অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত পণ্য অন্যান্য দেশে বিক্রি করা যায়।
৫. ইরানের ওপর আরও অবরোধ আরোপ করা
পশ্চিমারা চায় নানা ভুয়া ঘটনা প্রচার করে বা কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে প্রচারের মাধ্যমে বিশ্ব-জনমতকে ইরানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে এবং এভাবে ইরানের ওপর বিশ্ব-সমাজের মাধ্যমে আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিতে। মানবাধিকার ও নারী অধিকার রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে তারা এসব করতে চায়। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য হল পশ্চিমা নেতাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন।
৬. পাশ্চাত্যে ইসলামের প্রতি আকর্ষণের জোয়ার প্রতিরোধ করা
পাশ্চাত্যে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। নানা নেতিবাচক প্রচারণা ও ইরানের মত মুসলিম দেশের নারীদের সম্পর্কে মিথ্যা চিত্র তুলে ধরা সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি পশ্চিমা নারীদের আকর্ষণ ঠেকাতে পারছে না পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা। পাশ্চাত্যে প্রতিদিন শত শত নারী নিহত হচ্ছে ও অপহৃত হচ্ছে এবং এমনকি তারা পুলিশের হাতে ধর্ষিতও হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া এসব বিষয়ে নীরব থাকছে। তারা কেবল এ অপেক্ষায় থাকে যে কখন ইরান বা পশ্চিম এশিয়ার কোনো রাস্তায় এমন কোনো ঘটনা ঘটবে যা দিয়ে মিডিয়ার প্রচার-প্রোপাগান্ডার অজুহাত খুঁজে পাওয়া যায়।
৭. ইরানি নারীর প্রতি পাশ্চাত্যের প্রতিশোধ-স্পৃহা
ইরানি নারীদের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের প্রতিহিংসা সম্পর্কে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি সম্প্রতি (৫ এপ্রিল,২০০৩) গত রমজান মাসে ইরানি কবিদের এক সমাবেশে (যেখানে অনেক নারী কবিও উপস্থিত ছিলেন) বলেছেন, 'শত্রুরা ইরানের জাতীয় ঐক্য, ধর্ম ও নারীর চারিত্রিক পবিত্রতাকে টার্গেট করেছে। ইরানি নারীদের প্রতি পশ্চিমাদের কোনো দয়া নেই বলেই তারা বলছে নারীদের অধিকার রক্ষা করা উচিত। আসলে ইরানি নারীদের ব্যাপারে তাদের মধ্যে প্রতিশোধ-স্পৃহা কাজ করছে। ইরানি নারীদের উপস্থিতি না থাকলে ইসলামী বিপ্লব অবশ্যই বিজয়ী হত না, আমি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কারণ আমি বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহের সময় উপস্থিত ছিলাম। আমার মতে ইরানি নারীরা যদি বড় বড় মিছিলগুলোতে উপস্থিত না থাকত তাহলে বিপ্লব বিজয়ী হত না। ইরানি নারীদের প্রতি পশ্চিমাদের এ কারণেই ক্ষোভ রয়েছে।তারা নিজেদের নারী অধিকারের, মানবাধিকারের ও স্বাধীনতার সমর্থক বলে দাবি করে। এসবই শত্রুদের হামলা।'
পাশ্চাত্যে ক্রমেই তালাকের হার বাড়ছে, বাড়ছে এক ব্যক্তি তথা কেবল একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা একজন প্রাপ্ত-বয়স্ক পুরুষ-ভিত্তিক পরিবার, জনসংখ্যার হার নেতিবাচক হওয়া- এসবই হচ্ছে পশ্চিমা রীতি অনুকরণের ফসল। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রতি ৯৮ সেকেন্ডে ধর্ষিত হয় একজন মার্কিন নারী, প্রতি ৬ মার্কিন নারীর একজন যৌন হেনস্তা বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ২০১৫ সালে ৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন নারী যা মার্কিন নারী জনসংখ্যার ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ –যৌন সহিংসতার শিকার হন। আর এদের ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন যা মোট মার্কিন জনসংখ্যার ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। এইসব সহিংসতার মার্কিন নারীদের প্রতি তিনজনের একজনের বয়স ১১ থেকে ১৭ বছর। আর এসব সহিংসতায় জড়িত অপরাধীদের ৯৭ শতাংশই বসবাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
নারী অধিকারের ব্যাপারে পশ্চিমাদের কপটতা ফুটে উঠেছে গাজার ঘটনায় খুব স্পষ্টভাবে। জাতিসংঘ নারী বিষয়ক এক পরিসংখ্যানে গাজার নারী ও শিশুদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
-গাজার শহীদদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।
-গাজার শহীদ নারীদের সংখ্যা নয় হাজার। (সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী দশ হাজারেরও কিছু বেশি)
-প্রতি এক ঘণ্টায় গাজার দুই জন মা শহীদ হচ্ছেন।
- ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে গাজার তিন হাজার নারী হারিয়েছেন তাঁদের স্বামী এবং দশ হাজার শিশু হয়েছে ইয়াতিম।
-গাজার নারীরা সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন চিকিৎসা সুবিধা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ছাড়াই
-ইসরাইলি কারাগারে যৌন হামলার শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনি নারীরা।
পশ্চিমা নারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই ইরানে দাঙ্গাবাজদের কথিত 'নারী, জীবন ও স্বাধীনতা' শীর্ষক স্নোগানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ২০২২ সনে নিজদের চুল কেটেছিলেন। অথচ সেই নারীরা এখন গাজার নারীদের ওপর ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের ব্যাপারে ও তাদের অধিকার হরণের ব্যাপারে নীরব রয়েছেন। বরং তারা অপরাধী ইসরাইলের শাসকগোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র বিক্রি করে এইসব অপরাধ জোরদারে ভূমিকা রাখছেন। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৯