ইরানে ইসরায়েলি হামলায় শহীদদের স্মরণ:
তেহরানের এভিন কারাগারে ইসরায়েলি হামলায় শহীদ এক নারীর মর্মস্পর্শী গল্প
-
শিরিন ইসমাইলি
পার্সটুডে : গত ২৩ জুন দুপুরে তেহরানের এভিন কারাগারে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলায় শহীন হন এক সন্তানের জননী শিরিন ইসমাইলি। তিনি ওই কারাগারের কর্মচারী ছিলেন। শিরিনের প্রাণহীন দেহাবশেষ পাওয়ার পর তাঁর স্বামী আবেগাপ্লুত হয়ে তাঁর প্রাণবন্ত ও পরিশ্রমী স্বভাব এবং শাহাদাতের মর্মান্তিক মুহূর্তের বর্ণনা দেন।
"তার নাম ছিল শিরিন এবং তিনি আমার জীবনকেও শিরিন (মধুর) করে তুলেছিলেন। সে সবসময় প্রাণবন্ত, উদ্যমী এবং হাসিখুশি থাকতেন। তার মা কারাগারে কাজ করতেন, তাই তিনি মা’র সঙ্গে কাজে যোগ গিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কারচাক কারাগারে কাজ করতেন। কিন্তু পথের দূরত্বের কারণে তিনি এভিনে স্থানান্তরিত হন। এভিনে আসার পর তার মনের অবস্থা বদলে যায়। তিনি মাঝেমধ্যেই কাঁদতেন এবং বলতেন, 'আমি এখন বুঝতে পারছি- আমাদের নেতা, সাইয়্যেদ খামেনেয়ী কে? যখন আমি রাজনৈতিক বন্দিদের ওয়ার্ডে তাঁর কিছু প্রতিপক্ষকে দেখি, তখন বুঝতে পারি- আমাদের নেতা কতটা মজলুম!'
শহীদ শিরিন ইসমাইলির স্বামী মাসুদ নওরোজি আরও বলেন, "আমার স্ত্রী এভিন কারাগারের প্রশাসনিক ও সহায়ক বিভাগের কর্মী ছিলেন। ঘটনার দিন, আমি মসজিদে নামাজের জন্য যাচ্ছিলাম, তখন এভিনের দিকে থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম আমার স্ত্রীর কিছু একটা হয়েছে। দ্রুত এভিন কারাগারে পৌঁছালাম। পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ, যেন মহাপ্রলয়! আমার ছেলে ও শ্বাশুড়িও পৌঁছেছিলেন। কিন্তু আমাদেরকে সেসময় ঘটনাস্থলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমার শ্বাশুড়ি যেহেতু কারাগারে কাজ করতেন, সে কারণে তিনি ধ্বংসস্তূপের কাছে যাওয়ার অনুমতি পান। তিনি ও আমার ছেলে মিলে ধ্বংসস্তূপ থেকে আমার স্ত্রীর মৃতদেহ বের করে আনেন। আমি সহ্য করতে পারিনি সেই দৃশ্য।
প্রাণবন্ত ও স্নেহময় মনের অধিকারী
শিরিন ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও পরিশ্রমী। সবসময় হাসিখুশি ছিলেন। তিনি মোটেও আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন না। আমরা কখনো তর্ক করলে খুব দ্রুত মিটমাট করতাম। তার রাগ এবং মিটমাট করা দুটোই ছিল সুন্দর। কথাও বলতেন চমৎকারভাবে।
আমার চোখে তিনি সবসময় প্রিয়তম ছিলেন। আমরা ২৭ বছর একসাথে জীবন যাপন করেছি। আমাদের এক ছেলে, এরফান, ২৫ বছর বয়সী, যার জন্য আমরা অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। শিরিন তার প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, আমার ছেলে তার মা’র মৃতদেহ ধ্বংসাবশেষ থেকে তোলার দৃশ্য এখনও ভুলতে পারছে না।
কর্মজীবনের দিনগুলো
আমাদের বিবাহের তিন মাস পর শিরিন তার মায়ের কর্মস্থলে যোগ দেন। কারাগারে কাজ করা ছিল খুব কঠিন। প্রয়োজন শক্ত মনের। শিরিন বহু কষ্ট সহ্য করেছেন। তিনি ৪৫ বছর বয়সী এবং ১৮ বছর বয়স থেকে কাজ করে আসছিলেন। কাজের পাশাপাশি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তিনি সবসময় বলতেন: "রাজনৈতিক বন্দিরা আমাদের মাঝে মাঝে অপমান করেন, যা আমার মন ভেঙে দেয়।" আমার স্ত্রী ২৭ বছর কাজ করেছেন এবং কয়েক বছর পর অবসর নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।
তিনি তার নামের মতোই মধুর ছিলেন
শিরিন পরিবারের জন্য সহানুভূতিশীল এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। তবু, সব ব্যস্ততার মাঝেও তিনি রুচিশীল ও সুশৃঙ্খল ছিলেন। তিনি তার নামের মতোই মিষ্টি ছিলেন। খুব ভালো রান্না করতেন, ছিলেন অতিথিপরায়ণ। তিনি গাছ-গাছালির প্রতি যত্নশীল ছিলেন এবং চিত্রকর্মের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি সবসময় দিন গুণতেন অবসরের দিনগুলো কবে আসবে, যাতে পেশাদার শিল্পী হিসেবে চিত্রকর্ম করতে পারেন। তাঁর আঁকা তেলচিত্রগুলো এখনও আমাদের ঘরে আছে। একটি অসমাপ্ত তেলচিত্রও আছে যা আর কখনও শেষ হবে না।"
পার্সটুডে/এমএআর/২