স্ন্যাপব্যাক কেন ব্যর্থ হবে?
-
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের বিরুদ্ধে পুরোনো নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনর্বহাল করার বিষয়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির প্রচেষ্টা 'অকার্যকর' এবং এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। সামরিক আগ্রাসন যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি স্ন্যাপব্যাকও ব্যর্থ হবে।
গতকাল (শুক্রবার) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। সেখানে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির ভেতরে থাকা তথাকথিত 'স্ন্যাপব্যাক' প্রক্রিয়া সক্রিয় করার বিষয়ে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনর্বহাল করা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা, যার মধ্যে ইউরোপীয় ত্রয়ীও ছিল, একটি খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দেয়।
ওই প্রস্তাবে ‘স্ন্যাপব্যাক’ প্রক্রিয়া ছয় মাস বিলম্বিত করার সুপারিশ করা হয়েছিল, তবে ভেটোর মাধ্যমে তারা সপ্তাহান্তেই নিষেধাজ্ঞা পুনরায় কার্যকর করার পথ সুগম করতে চেয়েছে।
আরাকচি উল্লেখ করেন- ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সর্বদা পারমাণবিক সমঝোতা (জেসিপিওএ), পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) এবং এর সেফগার্ডস চুক্তির পূর্ণ মেনে চলেছে—যা ১৫টি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার মতে, এই বাস্তবতা ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিকে কলঙ্কিত করার সব প্রচেষ্টাকে অবৈধ করে দিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন- যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ত্রয়ী ভ্রান্ত অভিযোগ তুলে ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। অথচ তারা নিজেরাই বারবার পারমাণবিক চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে।
তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন—২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ ও একতরফা সরে দাঁড়ানো, ইউরোপীয় ত্রয়ীর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় অবৈধ ও উস্কানিমূলক হামলা।
এই প্রেক্ষাপটে তিনি নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের প্রচেষ্টাকে 'ক্ষমতার নগ্ন অপব্যবহার' বলে আখ্যা দেন।
আরাকচি বলেন, শুক্রবারের ভেটোগুলো 'আইনগতভাবে শূন্য, রাজনৈতিকভাবে বেপরোয়া এবং প্রক্রিয়াগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ।'
আরাকচি জোর দিয়ে বলেন, আগামী ১৮ অক্টোবর জাতিসংঘের প্রস্তাব ২২৩১-এর আওতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে 'টার্মিনেশন ডে' শুরু হবে। ওই দিন থেকেই পারমাণবিক সংক্রান্ত সব নিষেধাজ্ঞা স্থায়ীভাবে শেষ হয়ে যাবে।
তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবকে আহ্বান জানান, নিষেধাজ্ঞা পুনরুজ্জীবিত করার কোনো প্রচেষ্টায় সেক্রেটারিয়েটকে জড়ানো থেকে বিরত থাকতে।
‘যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, ইউরোপ কবর দিয়েছে’
আরাকচি ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এবং 'ইসরাইলের অমূলক অভিযোগের প্রতিধ্বনি করে' পশ্চিমা মিত্রদেরও নিন্দা করেন। তিনি ইউরোপীয় ত্রয়ীকে 'আসল দোষী' আখ্যা দেন কূটনীতিকে 'কবর দেওয়ার' জন্য।
আরাকচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের আগ্রাসন বাড়াতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, অথচ ইরান সবসময় আলোচনার দ্বার খোলা রেখেছিল। কূটনীতির প্রতি এই সদিচ্ছারই প্রতিদান এসেছে “আগ্রাসনের মাধ্যমে।”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন: সামরিক আক্রমণ যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি স্ন্যাপব্যাকও ব্যর্থ হবে।
‘ইরান কেবল সম্মানের জবাব দেয়’
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, পশ্চিমাদের কর্মকাণ্ড ইরানি জনগণের বাকি থাকা বিশ্বাস সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। তাই পশ্চিমাদের উচিত তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা।
আরাকচি বলেন, “ইরান কখনো হুমকি বা চাপের কাছে মাথানত করে না। আমরা কেবল সম্মানের প্রতিদান দিই।”
‘কূটনীতি কখনো মরে না, তবে কঠিন হয়েছে’
নিরাপত্তা পরিষদের ভোট শেষে সাংবাদিকদের আরাকচি বলেন, কূটনীতি কখনো মরে না, তবে ইরানের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক পদক্ষেপের কারণে তা 'আরও কঠিন' হয়ে উঠেছে।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ইরান অতীতে বহুবার প্রতারিত হয়েছে।
আরাকচি বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, আমেরিকার ওপর বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।”
তিনি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদদ আলী খামেনেয়ির মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা সম্পূর্ণভাবে “অচল গলিপথ”।
“তিনি একদম সঠিকই বলেছেন,” আরাকচি যোগ করেন।
রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও আলজেরিয়াকে ধন্যবাদ
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সময় বাড়ানোর পক্ষে ভোট দেওয়া দেশগুলো—চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান এবং আলজেরিয়াকে তিনি ধন্যবাদ জানান।
আরাকচির ভাষায়, এ দেশগুলো 'ইতিহাসের সঠিক দিক বেছে নিয়েছে' এবং সংলাপের দ্বার খোলা রেখেছে।
ইরানের ওপর ২০১৫ সালের আগের যে পুরোনো নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনার ইউরোপীয় প্রস্তাব যেন আরও ৬ মাস দেরি করে কার্যকর করা হয়- জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এমন প্রস্তাব দিয়েছিল রাশিয়া ও চীন। কিন্তু ভোটে তাদের এই প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। পক্ষে ভোট দিয়েছে- রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, আলজেরিয়া। বিপক্ষে ভোট দিয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, গ্রিস, পানামা, সিয়েরা লিওন, স্লোভেনিয়া ও সোমালিয়া।আর ভোটদানে বিরত থাকে গায়ানা এবং দক্ষিণ কোরিয়া।#
পার্সটুডে/এমএআর/২৭