শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইনের (আ.) কাছে শত্রুদের বহুমুখি পরাজয়
(last modified Fri, 28 Jul 2023 10:51:25 GMT )
জুলাই ২৮, ২০২৩ ১৬:৫১ Asia/Dhaka
  • শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইনের (আ.) কাছে শত্রুদের বহুমুখি পরাজয়

আশুরা-বিপ্লবের রয়েছে বহুমাত্রিকতা। আসলে ইমাম হুসাইনের নেতৃত্বে সংঘটিত এ মহাবিপ্লব ইসলামেরই পরিপূর্ণ চিত্রের প্রতিচ্ছবি। কালের মহাপাখায় এ মহাবিপ্লব ইসলামেরই সব দিককে জানার এবং সবগুলো মহৎ গুণ চর্চার কেন্দ্র-বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

কারবালা ও আশুরা একত্ববাদ বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, ইসলামী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ,  খোদাপ্রেম ও ইসলামী আদর্শের জন্য চরম ত্যাগ-তিতিক্ষা, চরম ধৈর্য, চরম দৃঢ়তা, মানবতা, মহত্ত্ব, বীরত্ব, বিশ্বস্ততা, মহানুভবতা, মুক্তিকামিতা , সততা, আধ্যাত্মিকতা ও আত্ম-সংশোধনের নানা দিক শেখার এক মহান বিশ্ববিদ্যালয়।  কারবালা এটা প্রমাণ করে যে রক্ত তরবারির ওপর বিজয়ী হতে পারে। সত্যের পক্ষে মুষ্টিমেয় সেনানীও ভেঙ্গে দিতে পারে প্রবল পরাক্রান্ত তাগুতি শক্তির সিংহাসন।

ইমাম হুসাইনের (আ.) বিপ্লব ইসলামের ইতিহাসে অনন্য। এ বিপ্লব বদলে দিয়েছে বিশ্বের ইতিহাসকে। আশুরা বিপ্লবে মহানবীর (সা) নাতি শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর সঙ্গীদের অনন্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগ ইসলামকে এবং মানবতাকে দিয়েছে এক অনন্য মহিমা, গৌরব ও সৌন্দর্য।

মানবতা ও ইসলামকে অমর্যাদা ও অপবিত্রতার হাত থেকে রক্ষার যে আন্দোলন ও বিপ্লব তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা যে কোনো মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে দেয় অশেষ মহত্ত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ সেই আদর্শকে অনুসরণের অনুপ্রেরণা এবং তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দুর্বার সংকল্প।

ইমাম হুসাইনের (আ) মহাবিপ্লব ছিল এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পবিত্র ও মহান আন্দোলন। ইতিহাসে এর কোনো জুড়ি নেই। আর এ কারণেই তা চিরকালের আদর্শে পরিণত হয়েছে। এর লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট গোত্র, জাতি, দেশ ও মহাদেশে সীমিত নয়। সমস্ত মানবতার কল্যাণই ছিল ওই মহাবিপ্লবের টার্গেট। একত্ববাদ, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সমতা, সহমর্মিতা এবং এ ধরনের মনুষ্যত্বের জন্য অপরিহার্য হাজারো উপাদানকে সুপ্রতিষ্ঠার  করাই ছিল এ মহাবিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য।

এ কারণে ইমাম হুসাইন (আ) সমস্ত মানুষের। সবাই তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমনটি বলেছেন, ‘হুসাইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে।’

তেমনি আমরাও যেন সমস্বরে বলি, ‘হুসাইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে।’

কারণ প্রায় ১৪০০ বছর আগে তিনি আমাদের জন্য এবং মানবতার জন্য বিপ্লব করে গেছেন। তার বিপ্লব ছিল গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে এবং পবিত্র ও মহান।

ইমাম হুসাইন (আ.) দূরদর্শী ছিলেন। তিনি যা দেখতেন সমসাময়িক কালের কোনো বুদ্ধিজীবী কিংবা চিন্তাবিদের মাথায়ও তা আসত না। তিনি জনগণের পরিত্রাণের উপায় জনগণের চেয়ে ভালো বুঝতেন। দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ, শত বছর যখন পার হয় তখন মানুষ একটু একটু বুঝতে পারে যে, সত্যিই তো! তিনি তো এক মহাবিপ্লব করে গেছেন! আজ আমরা পরিস্কার বুঝতে পারি যে, ইয়াজিদ কেমন মানুষ ছিল আর মুয়াবিয়া কেমন ব্যক্তি ছিল বা উমাইয়াদের ষড়যন্ত্র কি ছিল! কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) সেদিনই সবার চেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। সেকালে বিশেষ করে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মদিনার লোকজন ইমাম হুসাইন (আ.) কি চান তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদাতের সংবাদ যেদিন তাদের কানে গেলো, অমনি যেন সবার টনক নড়ে উঠল। সবার একই প্রশ্ন: হুসাইন ইবনে আলীকে (আ.) কেন শহীদ করা হল? এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য মদিনার চিন্তাশীল লোকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। এর প্রধান ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা। তদন্ত কমিটি সিরিয়ায় গিয়ে ইয়াজিদের দরবারে এসে উপস্থিত হল। মাত্র ক’ দিন অতিক্রান্ত হতে না হতেই তারা অবস্থাটি ধরে ফেলল। অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে তারা শীঘ্রই মদিনায় ফিরে এলো। লোকজন জিজ্ঞেস করলো: কি দেখে এলেন? জবাবে তারা বলল, শুধু এইটুকুই তোমাদের বলি যে,আমরা যে ক’ দিন সিরিয়ায় ছিলাম সে ক’ দিন শুধু এ চিন্তায় ছিলাম যে, খোদা এক্ষুণি হয়তো এ জাতিকে পাথর নিক্ষেপ করে ধ্বংস করবেন! লোকজন বলল, কেন, কি হয়েছে!? তারা বলল, আমরা এমন এক খলিফার সামনে গিয়েছিলাম যে প্রকাশ্যে মদ খাচ্ছিলো, জুয়া খেলছিল, কুকুর-বানর নিয়ে খেলা করছিল, এমন কি নারীর সাথে যেনাও করছিল!

যে ব্যক্তির নাম সর্বযুগের স্বৈরাচার ও অত্যাচারী শাসকের রাজ প্রাসাদ নড়বড়ে করে দিয়েছে তিনি কি বৃথা নিহত হলেন!

আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালার আটজন ছেলে ছিল। তিনি মদিনার জনগণকে বললেন, তোমরা বিদ্রোহ কর আর না করো আমি শুধু আমার আটজন ছেলেকে নিয়ে হলেও বিদ্রোহ করতে যাচ্ছি। কথামতো তিনি তার আটজন ছেলেকে নিয়ে বিদ্রোহ করলেন এবং ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ‘হাররা বিদ্রোহে’ প্রথম তার আটজন ছেলের সবাই এবং পরে তিনি নিজেও শহীদ হন। (মুরুজুয যেহাব ৩/৬৯)

আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা নিঃসন্দেহে একজন চিন্তাশীল লোক ছিলেন। কিন্তু তিন বছর আগে ইমাম হুসাইন (আ.) যখন মদিনা থেকে বেরিয়ে আসনে তখন তিনিও ইমামের (আ.) কাজকর্ম থেকে কিছুই বুঝতে পারেননি।

ইমাম হুসাইন (আ.) বিদ্রোহ করলেন, আন্দোলন করলেন, জানমাল উৎসর্গ করলেন। তিনটি বছর কেটে গেল। তারপর আজ এসে আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালার মতো ব্যক্তিরও টনক নড়ল। এ হল ইমাম হুসাইনের (আ.) দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতার স্বরূপ মাত্র।

আশুরা বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি এমন লোকদের কেউ কেউ বলেন, ইমাম শহীদ হলেন যাতে উম্মতের সমস্ত পাপ মাফ হয়ে যায়। এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও বিভ্রান্ত খ্রিস্টানদের অনুকরণ মাত্র।

খ্রিষ্টানদের আকীদার একটি মূল অংশ এই যে, তারা বিশ্বাস করে হযরত ঈসা (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হন খ্রিষ্টানদের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেবার জন্য। অর্থাৎ এখন থেকে খ্রিষ্টানরা যতই পাপ করুক,কোনো ভয় নেই। কেননা হযরত ঈসা (আ.) আছেন। উম্মতের সব পাপ তার কাঁধেই পড়বে। এ কারণে আজ খ্রিষ্ট সমাজে যত অনাচার, নৈরাজ্য, ব্যভিচার, হত্যা, লুণ্ঠন অবাধে চলছে।

দ্বিতীয় যে ভ্রষ্ট ব্যাখ্যা হুসাইনি আদর্শকে অসার ও প্রভাবহীন করে দেয় তা হলোঃ আরেক দল মুসলমান বলে থাকে ইমাম হুসাইন (আ.) বিদ্রোহ করে নিহত হলেন এটি তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল বলেই। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যাস, এ নিয়ে আপনার আমার মাথা ঘামানোর কিছু নেই এবং এটি ইসলামের মূল করণীয় বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত নয়।

অথচ ইমাম হুসাইন (আ.) চিৎকার করে বললেন যে, আমার বিদ্রোহের কারণ ইসলামের মৌলিক ও সার্বিক বিষয়াদির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

ইসলাম কোনো মুমিনকে জুলুম, অত্যাচার, সামাজিক অধঃপতন প্রভৃতির প্রেক্ষিতে নাকে তেল ঢেলে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর অনুমতি দেয় না। ইমাম হুসাইনের (আ.) আদর্শ ছিল ইসলামী আদর্শেরই এক বাস্তব প্রতিফলন।

অনেকে আবার এই বলে চোখের পানি ঝরাতে থাকে যে, নবীর (সা.) সন্তান ইমাম হুসাইনকে (আ.) বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইমাম হুসাইন (আ.) নির্দোষ ছিলেন তবে দুঃখ হল যে তাকে মজলুম অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। শুধু এটিই তাদের আফসোস। অনর্থক তার রক্ত ধুলায় মেখেছে। তারা চোখের পানি দিয়ে যেন হযরত ফাতিমাকে (আ.) সান্ত্বনা দিতে চায়। এর চেয়ে বোকামি আর কী আছে?

পৃথিবীতে যদি কোনো একজন লোক তার রক্তের প্রতিটি ফোটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্য দান করে থাকেন তাহলে তা একমাত্র ইমাম হুসাইনই তা (আ.) পেরেছেন। সেই ৬১ হিজরি থেকে আজ ১৪৪৫ হিজরি পর্যন্ত ইমাম হুসাইনের (আ.) নামে যত টাকা-পয়সা খরচ করা হয়েছে তা যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে তাঁর প্রতি ফোটা রক্তের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যে ব্যক্তির নাম সর্বযুগের স্বৈরাচার ও অত্যাচারী শাসকের রাজ প্রাসাদ নড়বড়ে করে দিয়েছে তিনি কি বৃথা নিহত হলেন!

তাই আমরা যারা আফসোস করে বলি যে, মজলুম ইমাম হুসাইন (আ.) অকারণে নিহত হয়েছেন তাদের জানা উচিত মহানবীর (সা) এই বাক্য, ‘হুসাইন আমা থেকে ও আমি হুসাইন থেকে!’

শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইনের (আ.) মর্যাদায় একমাত্র শাহাদাতের মাধ্যমেই পৌঁছানো সম্ভব। তিনি শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। তাই তাঁর নজিরবিহীন মজলুম অবস্থা ও বীরত্বপূর্ণ শাহাদাতের প্রেক্ষাপটে আমাদের মূলত এ উদ্দেশ্যেই চোখের পানি ঝরানো উচিত যাতে ইমাম হুসাইনের (আ.) ঈমান, দৃঢ়তা, সত্যকামিতা ও ন্যায়পরায়ণতা, মুক্তিকামিতা, সৎসাহস, বীরত্ব, খোদাভীতি প্রভৃতির সাগর থেকে এক বিন্দু হলেও যেন আমাদের ভাগ্যে জোটে!।

হুসাইনী আদর্শকে হুবহু টিকিয়ে রাখা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা হুসাইনি আত্মার সাথে একাত্ম হতে পারব। ইমাম হুসাইনের (আ.) ঈমান, একত্ববাদ, মুক্তিকামিতা, তাকওয়া, সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা থেকে আমরা যদি সামান্যটুকুও লাভের আশায় চোখের পানি ঝরাতে পারি তাহলে এ চোখের পানির মূল্য হবে অপরিসীম। এ অশ্রু একটি মাছির পাখনার সমান সূক্ষ্ণ হলেও তার মূল্য কেউ দিতে পারবে না। ইমাম হুসাইন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই আদর্শের খাঁটি অনুসারী হবার আশায় কাঁদলে সে কান্নাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।

ইমাম হুসাইনের (আ.) সুউন্নত আত্মা অপরাজেয়। এ আত্মার কোনো ধ্বংস নেই!

হুসাইনী আদর্শকে টিকিয়ে রাখার ওপর বেশি জোর দেয়া হয় এ জন্যই যাতে মানুষ ইসলামের এই বাস্তব চেহারাকে সরাসরি দেখতে পারে। মানুষ নবী (সা.) বংশের এই ঈমান দেখে নবীর (সা.) নবুয়্যতকে সত্য বলে বুঝতে পারবে। কেউ যদি অসীম বীরত্ব ও ঈমানের পরিচয় দিয়ে কেবল কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয় তবুও এটি রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের সত্যতার জন্য তেমন কোনো দলিল হতে পারে না। কিন্তু নবীর (সা.) সন্তান হযরত ইমাম হুসাইনকে (আ.) যখন ঐ অসীম ঈমান, সাহস, বীরত্ব, তৌহিদী অবস্থায় শহীদ হতে দেখে তখন যে কেউই রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের সত্যতা বুঝতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর কোনো লোকই হযরত আলীর (আ.) চেয়ে বেশী সময় রাসূলুল্লাহর (সা.) সান্নিধ্য পায়নি। রাসূলের (আ.) ঘরেই তিনি বড় হন। তাঁকে দেখে মানুষ যেমন রাসূলুল্লাহর (সা.) রেসালাতের সত্যতাকে বুঝতে পারে ঠিক তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহর (সা.) আদর্শে অনুপ্রাণিত রাসূলের (সা.) সন্তানকেও যখন অসীম ঈমান ও বিশ্বস্ততার সাথে দেখে তখনও মানুষ রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের সত্যতা বুঝতে পারে। কারণ রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতিচ্ছবি ইমাম হুসাইনের (আ.) মধ্যে দেখা যায়। মুসলমানরা ঈমান শব্দটি কতই শুনেছে কিন্তু বাস্তবে কমই দেখেছ। ইমাম হুসাইনের (আ.) দিকে তাকালেই এই ঈমানের প্রতিফলন দেখতে পায়। মানুষ অবাক হয়ে বলতে বাধ্য হয় যে,মানুষ কোথায় পৌঁছতে পারে!! মানুষের আত্মা এত অপরাজেয় হতে পারে!! তাঁর দেহকে খণ্ড -বিখণ্ড করা হয়, যুবক পুত্রকে তাঁর চোখের সামনে ছিন্ন-ভিন্ন করা হয়, তৃষ্ণার চোটে আকাশের দিকে চেয়ে যার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে, পরিবার-পরিজনদেরকে একই শিকলে বেঁধে বন্দী করা হয়, সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হন। কিন্তু যে জিনিস অক্ষয় হয়ে রয়ে গেছে তা হল ইমাম হুসাইনের (আ.) সুউন্নত অপরাজেয় আত্মা। এ আত্মার কোনো ধ্বংস নেই।

পৃথিবীতে আর মাত্র একটি ঘটনা খুঁজে বের করুন যাতে সমস্ত মানবিক গুণাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হয়েছে রক্ষিত ও প্রতিফলিত। কারবালা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ঘটনায় যদি তা পাওয়া যেত তাহলে আমরা এখন থেকে কারবালার ঘটনাকে রেখে সেটাকেই স্মরণ করবো। না, কোথাও পাবেন না।

তাই কারবালার মতো ঘটনাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে ঘটনায় আত্মিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে মাত্র ৭২ জনের এক বাহিনী ত্রিশ হাজার লোকের বাহিনীকে পরাজিত করেছে। তারা সংখ্যায় মাত্র ৭২ জন ছিলেন এবং মৃত্যু যে নির্ঘাত এটিও তারা নিশ্চিতভাবে জানতেন। তবুও কিভাবে তারা ত্রিশ হাজারের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেন?

প্রথমত তারা এমন শক্তিতে শক্তিমান ছিলেন যে,শত্রুদের থেকে হুর ইবনে ইয়াজিদ রিয়াহীর মতো ত্রিশ জনেরও বেশি লোককে বেঁচে থাকার ঘাঁটি থেকে নির্ঘাত মৃত্যুর ঘাঁটিতে আকর্ষণ করতে সক্ষম হন! কিন্তু মৃত্যুর ঘাঁটি থেকে একজন লোকও ইয়াজিদের দুনিয়াবি ঘাঁটিতে যায়নি! তাহলে বুঝতে হবে যে, এ ঘাঁটিতে সংখ্যা কম এবং মৃত্যু নিশ্চিত হলেও এখানে শক্তি-সামর্থ্য অনেক বেশী যা দিয়ে শত্রুদেরকেও আকর্ষণ করা যায়।

দ্বিতীয়ত আরবের চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী একজনের মোকাবিলায় অন্য আরেকজন যুদ্ধ করতো। কারবালায় ইয়াজিদই সেনাপতি ইবনে সা’ দ প্রথমে এভাবেই যুদ্ধ করত রাজি হয়। কিন্তু যখন দেখল যে, এভাবে যুদ্ধ করলে ইমাম হুসাইনের (আ.) একজন সৈন্যই তাঁর সব সৈন্যকে সাবাড় করে দিতে যথেষ্ট তখন সে এ যুদ্ধ বর্জন করে দল বেঁধে আক্রমণ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হল।

আশুরার দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একে একে ৭১ জন শহীদের লাশকে ইমাম হুসাইন কাঁধে বয়ে তাঁবুতে নিয়ে এসেছেন। তাদের কাছে গিয়ে অভয় বাণী দিয়েছেন, তাঁবুতে এসে সবাইকে শান্ত করেছেন, এছাড়া তিনি নিজেও কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। ৫৭ বছরের একজন বৃদ্ধলোক এত ক্লান্ত, শ্রান্ত অবস্থায় যখন ময়দানে এলেন তখন শত্রুরা ভেবেছিল হয়তো সহজেই তাঁকে পরাস্ত করা যাবে। কিন্তু একটু পরেই তাদের সব আশা-ভরসা উড়ে গেল। ইমাম হুসাইনের (আ.) সামনে যে-ই এলো এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারলো না। ওমর ইবনে সাদ এ অবস্থা দেখে চিৎকার করে বলে উঠে:

 ‘তোমরা জান এ কার সন্তান? এ তাঁরই সন্তান যে সমস্ত আরবকে নিশ্চিহ্ন করতে পারতো। এ তো আল্লাহর সিংহ শেরে খোদা আলীর (আ.) সন্তান!’ ( মাকতালু মোকাররম: ৩৪৬ বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৫/৫৯ মানাকিবে ইবনে শাহের অশুবঃ ৪/১১০)

 ওমর ইবনে সাদ তারপর বলে : ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, তার দু’ বাহুতে তার বাবার মতোই শক্তি। আজ যে তাঁর মোকাবিলায় যাবে তার মৃত্যু অনিবার্য।’ এটি কি ওমর ইবনে সা’ দের পরাজয়ের প্রমাণ নয়? ত্রিশ হাজার সেনা নিয়ে যে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত, বয়োবৃদ্ধ, অপরিমেয় দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পিছু হটে ছুটে পালায় এটি কি তাদের পরাজয় নয়? ( ইরশাদে মুফিদঃ ২৩০ বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৪/৩৯০)

তারা তলোয়ারের মুখে যেমন পরাজয় বরণ করে তেমনি ইমাম হুসাইনের (আ.) চিন্তাধারার কাছেও তাদের হীন চিন্তাধারা পরাজিত হয়।

আশুরার দিন যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগে ইমাম হুসাইন (আ.)-তিনবার বক্তৃতা দান করেন। এ বক্তৃতাগুলোর প্রত্যেকটিই ছিল বীরত্বপূর্ণ। যাদের বক্তৃতা করার অভ্যাস আছে তারা হয়তো জানেন যে বক্তৃতার ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত মানসিকতার দরকার হয়। সাধারণ অবস্থায় মানুষ একটি অসাধারণ বক্তব্য রাখতে পারে না। যে হৃদয় আঘাত পেয়েছে সে ভালো শোক-গাঁথা পড়তে পারে। তেমনি কেউ যদি বীরত্বপূর্ণ বক্তব্য দিতে চায় তাহলে তার অস্তিত্ব বীরের ভাবানুভবে ভরা থাকতে হবে। ইমাম হুসাইন (আ.) আশুরার দিনে যখন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন তখন ইবনে সা’ দ চিন্তায় পড়ে গেল। সবার কানে যাতে ইমামের কথা পৌঁছায় সে জন্য ইমাম হুসাইন (আ.) একটি উঁচু জায়গা হিসাবে উটের পিঠে উঠে দাঁড়ালেন এবং চিৎকার করে বললেন,

‘হে জনগোষ্ঠী! তোমাদের জন্য ধ্বংস এ জন্য যে, তোমরা জটিল পরিস্থিতিতে আমার সাহায্য চেয়েছো। আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছি। কিন্তু যে তরবারি আমার সাহায্যে পরিচালনার শপথ তোমরা নিয়েছিলে আজ আমাকেই হত্যার জন্য সে তরবারি হাতে নিয়েছ।’ ( আল-লুহুফঃ ৪১ তুহফাল উকুলঃ ১৭৩ মানাকিবে ইবনে শাহরে অশুবঃ ৪/১১০ মাকতালু মোকাররামঃ ২৮৬/৬)

সত্যিকার অর্থে হযরত আলীর (আ.) জ্ঞানগর্ভমূলক বাগ্মিতার পর এ ধরনের বক্তৃতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ইমাম হুসাইনের (আ.) বক্তৃতায় যেন হযরত আলীরই (আ.) বিচক্ষণতা! যেন সেই একই জ্ঞান, সেই একই সাহস! সেই  একই বীরত্ব!  ইমাম হুসাইন (আ.) এ কথা তিনবার চিৎকার করে বললেন। তাতেই ইবনে সাদের মনে ভয় ঢুকে গেলো যে, এভাবে কথা বলতে দিলে এক্ষুণি তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে। তাই ইমাম হুসাইন (আ.) যখন চতুর্থ বারের মত কথা বলতে যাবেন এ সময় পরাজিত মনোবৃত্তি নিয়ে কাপুরুষ ওমর ইবনে সাদ নির্দেশ দিল যে, সবাই হৈ-হুল্লোড় করে উঠবে যাতে ইমাম হুসাইনের (আ.) কথা কেউ শুনতে না পারে। এটি কি পরাজয় নয়? এটি কি ইমাম হুসাইনের (আ.) বিজয় নয়?

ইমাম হুসাইনের স্মরণে কাশ্মিরি মুসলমানদের শোক-অনুষ্ঠান

মানুষ যদি ইমানদার হয়, একত্ববাদী হয়, যদি আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং পরকালে বিশ্বাসী হয় তাহলে একাই বিশ-ত্রিশ হাজার সুসজ্জিত সৈন্যকে মানসিকভাবে পরাস্ত করতে পারে। এটি কি আমাদের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় নয়? এরূপ উদাহরণ আপনি দ্বিতীয়টি পাবেন কোথায়? পৃথিবীতে একজন লোক খুঁজে বের করুন, যে ইমাম হুসাইনের (আ.) মত দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পড়েও মাত্র দুটো শব্দ ইমাম হুসাইনের (আ.) মতো বলতে পারে!।

হুসাইনী আন্দোলনকে জিইয়ে রাখার জন্য এত জোর দেয়ার কারণ হল যে আমরা এটিকে সঠিক ভাবে বুঝবো, এর অনাবিষ্কৃত রহস্যগুলো উদ্ধার করবো এবং তা থেকে শিক্ষা নেব। আমরা যাতে ইমাম হুসাইনের (আ.) মহত্বকে অনুধাবন করতে পারি এবং যদি দু’ ফোটা চোখের পানি ঝরাই তা যেন সম্পূর্ণ মারেফাত সহকারে এবং জেনেশুনে ঝরাতে পারি। ইমাম হুসাইনের (আ.) পরিচিতি আমাদেরকে উন্নত করে, আমাদের মানুষ করে গড়ে তোলে, আমাদের মুক্তি দান করে। আমাদেরকে সত্য, হাকিকত এবং ন্যায়ের শিবিরে নিয়ে যায় এবং একজন খাঁটি মুসলমান তৈরি করে দেয়। হুসাইনী আদর্শ মানুষ গড়ার আদর্শ, পাপী তৈরি করার আদর্শ নয়। হুসাইনের (আ.) ঘাঁটি সৎ কর্মীর ঘাঁটি, পাপীদের এখানে কোন আশ্রয় নেই।

ইতিহাসে আছে, আশুরার দিন ভোর বেলায় ইমাম হুসাইন নামাজ সেরে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে বললেন, তৈরি হয়ে যাও। মৃত্যু এ দুনিয়া থেকে ঐ দুনিয়ার পার হবার জন্য একটা সাকো বৈ কিছুই নয়। একটা কঠিন দুনিয়া থেকে তোমাদেরকে একটা মর্যাদাশালী মহান জগতে পার করে দেব। এ ছিল ইমাম হুসাইনের (আ.) বক্তব্য । এ ঘটনাটি ইমাম হুসাইন (আ.) বর্ণনা করেননি। কারবালায় যারা উপস্থিত ছিল তারাই বর্ণনা করেছে। এমন কি ইবনে সা’দের নিযুক্ত গুপ্তচর বা সংবাদ সংগ্রহকারী হেলাল ইবনে নাফেও এ ঘটনা বর্ণনা করেছে যে, আমি হুসাইন ইবনে আলীকে (আ.) দেখে অবাক হয়ে যাই। তাঁর শেষ মুহূর্ত যতই ঘনিয়ে আসছিল এবং যতই তার কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠছিল ততই তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। যেন দীর্ঘ বিরহের পর কারো তাঁর আপনজনের সাথে মিলনের সময় হয়েছে!এমনকি যখন অভিশপ্ত শিমার ইমাম হুসাইনের শিরচ্ছেদ করছিল তখন অন্য এক ঘাতক বলছিল আমি তার চেহারায় এমন প্রসন্নতা এবং উজ্জ্বলতা দেখেছিলাম যে তাকে হত্যা করার কথা একবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। (আল লুহুফঃ ৫৩, বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৫/৫৭)

ইমাম হুসাইন (আ) যখন পরিবারের কাছ থেকে শেষবারের মত বিদায় নিয়ে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিলেন তখন বোন যাইনাবকেও কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নেয়ার সময় যাইনাব আবারও ফিরে আসতে লাগল ভাইয়ের দিকে এবং বললেন: থামো থামো বা ধীরে চলুন ভাই! ইমাম বললেন, কি ব্যাপার! তাবুতে যেতে বললাম না! যাইনাব কাছে এসে বললেন: মায়ের একটা ওসিয়ত মনে পড়ল! তা পালন করতে এলাম! এ কথা বলে ভাইয়ের গলায় একটি চুমো খেলেন! মা ফাতিমা যাইনাবকে সেই বহু বছর আগে বলে রেখেছিলেন যে, আমার হুসাইন যখন নিশ্চিত শাহাদাতকামী যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে তখন তুমি আমার পক্ষ থেকে তাঁর গলায় একটি চুমো দিও। এ যেন মা ফাতেমারই চুম্বন সেই গলায় যা কিছুক্ষণ পরই জীবন্ত অবস্থায় কাটা হবে শিমারের মত জালিমদের হাতে! জালিমদের ওপর আল্লাহর চির-অভিশাপ ও কঠোর শাস্তি কামনা  করছি।

পার্সটুডে/২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।