শতাব্দীর বড় গোয়েন্দা জয় ইরানের, জবাবে ইসরাইলের 'নীরবতা' ও 'উপহাস'
(last modified Tue, 10 Jun 2025 05:45:46 GMT )
জুন ১০, ২০২৫ ১১:৪৫ Asia/Dhaka
  • মোসাদের প্রধান ডেভিড বারনিয়া
    মোসাদের প্রধান ডেভিড বারনিয়া

পার্স টুডে: ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সম্প্রতি এক বিশাল গোয়েন্দা বিজয়ের খবর প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এক যুগান্তকারী সাইবার ও মাঠ পর্যায়ের অভিযানে সাফল্য অর্জন করেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে পার্সটুডে জানিয়েছে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একটি জটিল অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ইসরাইলের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, বিশেষ করে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত দলিলপত্র, ইসরাইলের অভ্যন্তর থেকে সরিয়ে ইরানে নিয়ে আনতে সক্ষম হয় এবং সেগুলো বর্তমানে একটি নিরাপদ স্থানে বিশ্লেষণাধীন।

মেহর নিউজের তথ্য অনুযায়ী, এসব তথ্যের নিরাপদ পরিবহন ও বিশালতার কারণে ইরান শুরুতে এই সাফল্য গোপন রাখে এবং সময় উপযোগী মুহূর্তে তা প্রকাশ করে।

ইসরাইলি নিরাপত্তা সূত্রগুলোর বরাতে জানা গেছে, এসব নথি মূলত ইসরাইলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পারমাণবিক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সার্ভার এবং 'হাকরিয়া' নামক অঞ্চলে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা দপ্তর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এই বিজয়ের ব্যাপকতা এতই গভীর, যে ইসরাইলি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোতে ‘ভূমিকম্প’ হতে পারে বলেও অনেক বিশ্লেষক মত প্রকাশ করছেন এবং শিন বেট ও মোসাদের প্রধানদের বরখাস্ত বা বিচারের সম্ভাবনার কথাও আলোচিত হচ্ছে। ইরানের গোয়েন্দামন্ত্রী সাইয়্যেদ ইসমাইল খাতিব এই দলিলগুলোকে “ইসরাইলি কৌশলগত তথ্যভাণ্ডার” হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ছায়া যুদ্ধক্ষেত্রে ভারসাম্যের পরিবর্তন

ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধে, ইরানের শক্তির মূল ভিত্তি ছিল ‘প্রতিরোধ ফ্রন্ট’ ও অসম লড়াইয়ের কৌশল। বিপরীতে ইসরাইল বিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড, নাশকতা, ডকুমেন্ট চুরি ও প্রপাগান্ডা প্রচারণা চালিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।

বিশেষত, ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো এবং "আল আকসা তুফান" অভিযান ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, এই দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।

তবে, এই গোয়েন্দা সাফল্যের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো যে, ইরান এখনো এমন সক্ষমতা রাখে যা দিয়ে ইসরাইলের নিরাপত্তা কাঠামোয় গভীরভাবে আঘাত হানতে পারে। বিশেষ করে যখন লেবানন, গাজা ও পশ্চিম তীরে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো শক্তিশালী হচ্ছে, তখন ইরান তার গোয়েন্দা তৎপরতা দিয়ে ইসরাইলের হৃদয়ে এক নতুন ফ্রন্ট খুলে দিয়েছে।

এখন যদি তেহরান চায়, তারা ইসরাইলের যেকোনো কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে—এখন কেবল বিষয়টি সময় ও স্থান নির্ধারণের।

অন্য কথায়, সাম্প্রতিক অভিযানের পর, ইসরাইলের কোনও কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুই নাগালের বাইরে বা অসম্ভব বিষয় নয়। এই অনুমানের সঠিকতা বিবেচনা করে, তেহরান এবং তেল আবিবের মধ্যে ক্ষমতার সমীকরণ পরিবর্তিত হয়েছে এবং আজ ইরানের কাছে ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থার উপর আঘাত করার নতুন সম্ভাবনা রয়েছে।

হাকরিয়ায় ভূমিকম্প

"হাকরিয়া" — হিব্রু ভাষায় যার অর্থ “কমপ্লেক্স” — এটি তেল আবিবে অবস্থিত ইসরাইলের নিরাপত্তা ও সামরিক কাঠামোর কেন্দ্র। এখানে রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর এবং বিভিন্ন গোপন গোয়েন্দা কার্যালয়। এটি শুধু সামরিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক নয়, বরং ইসরাইলের আঞ্চলিক কৌশল নির্ধারণের কেন্দ্রস্থল।

হাকরিয়ার কাঠামো ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা, বিশেষ করে ইরানের মতো দেশগুলোর জন্য যারা ইসরাইলকে স্থায়ী হুমকি হিসেবে দেখে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একমাত্র লক্ষ্য নয়, বরং এক প্রকার সামরিক প্রতীক যেটি ইসরাইলের কৌশলগত দুর্বলতা প্রকাশ করতে পারে।

ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া: অস্বীকার, উপহাস, সন্দেহ, নীরবতা

এই ধরনের সাফল্যের কথা শুনে ইসরাইলের রাজনীতিবিদ, মিডিয়া এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ‘অস্বীকার’, ‘উপহাস’, ‘সন্দেহ’ এবং ‘নীরবতা’র পথ বেছে নিয়েছেন। কারণ, এই ধরনের গভীর অনুপ্রবেশ ও দলিল চুরি তাদের কল্পনারও বাইরে।

গত ৮০ বছর ধরে, মোসাদ ও অন্যান্য সংস্থা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের আধিপত্য বজায় রাখতে সফল হয়েছিল। যেমন—আরব দেশগুলোর বিজ্ঞানীদের হত্যা করে, তারা ইরাক ও সিরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি ব্যাহত করেছিল।

কিন্তু আজ, "আল আকসা তুফান" অভিযানের মাঝামাঝি সময়েই, ইরানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন এক বহুমাত্রিক, জটিল ও অভূতপূর্ব অভিযান চালিয়েছে যা ইসরাইলের নিরাপত্তা কাঠামোর হৃদয়ে প্রবেশ করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ইরান ধাপে ধাপে এসব দলিল ফাঁস করতে শুরু করে, তাহলে তা শুধু অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাই নয় বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরাইলের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল করবে।

আসন্ন নাটকীয় পরিবর্তন?

এই ঘটনার ফলে ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বারনিয়া’র পদত্যাগ বা অপসারণ অদূর ভবিষ্যতে ঘটতে পারে। আর তেহরান হয়তো এই ঐতিহাসিক ফাঁসের সময় নির্বাচন করে ইউরোপীয়-আমেরিকান কূটনৈতিক ত্রয়ীকে চাপে ফেলতে চাইবে, যারা ইরানের বিরুদ্ধে ‘মেকানিজম ট্রিগার’ চালুর চেষ্টা করছে।

ইতিহাসবিদরা আগে ইসরাইলি পারমাণবিক প্রকল্প ‘ডিমোনা’র গোপন তথ্য ফাঁসকারী মোর্দেখাই ভানুনুকে সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু আজকের এই ঘটনা তাকে ছাপিয়ে গেছে।

ইরান যদি সত্যি ৭ গিগাবাইটের বেশি গোপন দলিল (বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনাসমূহ) হস্তগত করে থাকে, তবে এখন তাদের হাতে রয়েছে ইসরাইলি স্থাপনাগুলোর স্থান, গঠন ও দুর্বলতা বিশ্লেষণের অসাধারণ সক্ষমতা।

এই বিজয় শুধু তেহরান-তেল আবিব দ্বন্দ্বে নিরাপত্তা ভারসাম্য বদলে দেবে না, বরং ইরান ও এর মিত্র প্রতিরোধ ফ্রন্টের কৌশলগত মর্যাদা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতাও বহুগুণ বাড়াবে।#