সাহসী সামুরাই যোদ্ধা থেকে পশ্চিমাদের বাধ্য সেনা
জাপান কীভাবে নিজের রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলল?
পার্সটুডে- জাপান আসলে এখন আত্মবিস্মৃত একটি জাতি-রাষ্ট্র। এই সংকটের মূলে যে দর্শনটি রয়েছে তা হলো, এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা যা পশ্চিমা মূল্যবোধকে উগ্রভাবে গ্রহণ করার কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বের প্রাচীনতম ও সমৃদ্ধতম সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে জাপানের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কয়েক হাজার বছরের সভ্যতা, একটি বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিশ্রমী জাতি, অনন্য শিল্প ও সাহিত্য, উন্নত প্রযুক্তি এবং দেশটির সমাজে প্রাচ্যঘেঁষা বিশেষ অনুভূতি ইত্যাদি।
পার্সটুডে ম্যাগাজিনের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশটি তার ইতিহাস জুড়ে, বিশেষ করে প্রাক-আধুনিক যুগে, নিজের জন্য একটি অনন্য পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য উভয়কেই অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগ থেকে, বিশেষ করে দেশটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন এবং বিশ্বায়ন ও পশ্চিমামুখী উন্নয়ন নীতির প্রভাবে, জাপানের রাজনৈতিক কাঠামো ও শাসনব্যবস্থার সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। এটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
পশ্চিমা রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষ করে আমেরিকার প্রতি ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা ও বশ্যতা জাপানে একটি বড় ধরণের ‘রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের অভাব’ তৈরি করেছে, যা দিনে দিনে আরও বড় হচ্ছে। এই ধরনের নির্ভরতা এখন শুধু সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং সাংস্কৃতিক ও পরিচিতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শাসক শ্রেণির মধ্যেও দৃশ্যমান। দুর্ভাগ্যবশত, এ সংকট এতটা প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, অনেক লেখক ও বিশ্লেষক জাপানকে ‘প্রযুক্তিগত সৈনিক’ এবং ‘পশ্চিমের বুদ্ধিমান দাস’ বলে মনে করেন। বিগত কয়েক দশকে জাপান সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মনে যেসব ধারনা তৈরি হয়েছে সেগুলোর কয়েকটি হচ্ছে: অত্যাধুনিক রোবট ও আকর্ষণীয় অ্যানিমেশন নির্মাণকারী একটি দেশ যেখানে মার্কিন সেনারা স্থানীয় নারীদের ধর্ষণ করে, সেদেশের জনগণের মধ্যে আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনক এবং এর শাসক শ্রেণি পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসতে পেরে যত খুশি হয় অন্য কোনো কাজে ততটা খুশি হতে দেখা যায় না।
একটি অভ্যন্তরীণ সংকট
প্রকৃতপক্ষে জাপান আত্মপরিচয় বিস্মৃতির সংকটে পড়েছে। এই সংকটের মূলে যে দর্শনটি রয়েছে তা হলো, এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা যা পশ্চিমা মূল্যবোধকে উগ্রভাবে গ্রহণ করার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। যে জাপান ঐতিহ্যগতভাবে নিজে ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম রূপকার বর্তমানে সেই জাপানের রাজনৈতিক নেতারা পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরতা মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ি দিয়েছেন এবং যে সংস্কৃতির সঙ্গে জাপানি সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র মিল নেই বরং জাপানি সংস্কৃতি থেকে নিস্কৃষ্ট সংস্কৃতি, তার অনুসরণ তারা করছেন। জাপানের মূল সংস্কৃতিতে, মর্যাদা ও শান্তির ছিল একটি মৌলিক বিষয়, যা এখন প্রযুক্তিগত পরিচয়ে রূপ নিয়েছে এবং পাশ্চাত্যঘেঁষা উদ্বেগে পূর্ণ হয়ে গেছে।
জাপানি রাজনৈতিক নেতাদের ‘রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের অভাব’ থেকে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জাপানি রাজনৈতিক নেতাদের নিজস্ব বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না বরং তারা এসব ইস্যুতে অন্ধের মতো পাশ্চাত্যের লেজুড়বৃত্তি করছেন। পরিচিতির এই সংকটের অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে পাশ্চাত্যের প্রতি ভারসাম্যহীন ও উগ্র নির্ভরশীলতা। এক সময় যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের পুনর্গঠনের জন্য এই নির্ভরশীলতাকে ঐতিহাসিক প্রয়োজন বলে মেনে নেয়া যেত, কিন্তু পরবর্তী দশকগুলোতে এই নির্ভরশীলতা ও দৈন্য জাপানি রাজনৈতিক নেতাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
অবশ্য জাপানকে এরকম মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী করে রাখার পেছনে আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের সুদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের অবদানও কম নয়। পশ্চিমারা দশকের পর দশক ধরে তাদের নিজেদের স্বার্থে জাপানকে তাদের ওপর নির্ভরশীল করে রাখার প্রয়াস পেয়েছে।
আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে জাপানি সংস্কৃতি ও পরিচিতির ভূমিকা
এখানে, উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, জাপানি সংস্কৃতির এখনও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে ফিরে যাওয়ার উচ্চমানে সক্ষমতা রয়েছে। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, ঐতিহ্যবাহী ও শান্তিপূর্ণ শিল্পকলা, পরিবারকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক ব্যবস্থা এবং বীরত্বের চেতনার মতো মূল সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে জাপান বিশ্বের একটি নেতৃস্থানীয় জাতি হিসেবে তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারে। অবশ্যই, এই প্রত্যাবর্তন তখনই সম্ভব যখন জাপানের রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন বা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, জাপানের জনগণ তাদের শাসক হিসাবে আত্মবিশ্বাস এবং পরিচিতির স্বাধীনতার অধিকারী নেতাদের বেছে নেবে।
এখানে কোটি টাকার প্রশ্নটি হচ্ছে, জাপান যদি পশ্চিমা পরিচিতি ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ত্যাগ করে, তাহলে তার শাসকরা কি পশ্চিমাদের হাতে সৃষ্ট ও নির্যাতিত ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর গণহত্যা পরিচালনাকারী ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞের সামনে একজন বাধ্য সৈনিকের মতো হাসতে থাকবে নাকি সামুরাইয়ের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে?#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমএআর/৯