বিশ্লেষণ:
পাক-আফগান সংঘাত ও উত্তেজনা জোরদারের রহস্য এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি
-
পাক-আফগান সংঘাত ও উত্তেজনা জোরদারের রহস্য এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি
পার্সটুডে - সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা ব্যাপক সামরিক সংঘর্ষের রূপ নেয় যার মূলে রয়েছে ঐতিহাসিক মতপার্থক্য, সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এবং সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ।
পাক-আফগান সীমান্ত উত্তেজনা শুরু হয়েছিল চলতি বছরের প্রথম দিকে। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে এ উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর এমন তীব্র সংকট খুব কমই দেখা গেছে।
পাকিস্তান তালেবানদের বিরুদ্ধে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ করে বলে আসছে এইসব গোষ্ঠী পাকিস্তানের মাটিতে মারাত্মক হামলা চালায়, অন্যদিকে তালেবান কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন এবং পাকিস্তান আফগান সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে বলে পাল্টা অভিযোগ করছেন।
এই সংকট কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেই ব্যাহত করেনি, একইসঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং অভিবাসনের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
এই উত্তেজনার মূর শেকড় আসলে ডুরান্ড লাইন। ১৮৯৩ সালে ব্রিটেনের চিহ্নিত এই সীমানাকে আফগানিস্তান কখনও স্বীকৃতি দেয় নি।
এই বছরের শুরু থেকে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে শুরু হয়। তবে উত্তেজন তুঙ্গে ওঠে যখন গত ৯ অক্টোবর কাবুল ও দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তানে কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনার পর তালেবান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিমান হামলার অভিযোগ আনে। এর দু'দিন পর তালেবান সেনারা পাকিস্তানের সীমান্ত চৌকিগুলোর ওপর হামলা চালায় এবং তিনটি চৌকি দখল করে ও ৫৮ পাক-সেনাকে হত্যার দাবি করেছে। পাকিস্তান পাল্টা হামলা চালিয়ে ২০০'রও বেশি তালেবান সেনাকে হত্যার খবর দেয়। কুনার ও হেলমান্দ সীমান্তে ব্যাপক ভারি গোলা বিনিময় ও সংঘাতের পর পাকিস্তান তুরখাম সীমান্তের মত গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত-পয়েন্টগুলো বন্ধ করে দেয়ার কথা জানায়। ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে, আর এতে পাকিস্তান আফগানিস্তানের প্রধান বাণিজ্য শরিক হওয়ায় খুব অসুবিধার শিকার হবে সীমান্ত অঞ্চলের পাকিস্তানি ও আফগানরা।
এই উত্তেজনার পরিণতি বহুমুখী। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সংঘাতগুলো সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। টিটিপি এই সুযোগটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে আরও আক্রমণ চালিয়েছে এবং এমনকি সীমান্ত চৌকিও দখল করেছে। বিভিন্ন রিপোর্টে এসেছে, ২০২৫ সালে পাকিস্তানে ১০টিরও বেশি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২.৬% এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে প্রায় ৪০ লক্ষ আফগান শরণার্থী রয়েছে এবং যদি তাদের বহিষ্কার করা হয় তাহলে আফগানিস্তান একটি মানবিক সংকটের মুখোমুখি হবে। দু-দেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর চলাচল বন্ধ হওয়ায় অসুবিধার শিকার হবে উভয় পক্ষেরই বেসামরিক জনগণ।
ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংকট আঞ্চলিক সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে, ভারত তালেবানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং অক্টোবরে তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারত সফর করছেন, যা পাকিস্তানকে চিন্তিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব, কাতার এবং চীন। চীন উভয় পক্ষের মধ্যে সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তান মধ্যস্থতা চাইছে, কিন্তু তালেবানরা তাদের ভূখণ্ড রক্ষার উপর জোর দিচ্ছে।
এদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বলেছে, তেহরান উভয় দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। এক অভিন্ন প্রতিবেশী হিসেবে ইরান বিশ্বাস করে যে বিদেশী হস্তক্ষেপ ছাড়াই সংলাপের মাধ্যমে বিরোধের সমাধান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার মূল চাবিকাঠি।
কেবল কূটনীতি ও পারস্পরিক সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মানই উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করতে পারে। যেকোনো উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়াকে ব্যাপক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে অভিবাসন বৃদ্ধি, বাণিজ্যে ব্যাঘাত এবং সন্ত্রাসী হুমকি যা ইরানের সীমান্তকেও প্রভাবিত করবে।
তাই এটা স্পষ্ট বিতর্কিত ডুরান্ড লাইন এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোর মৌলিক সমাধান না হলে, এই উত্তেজনা অব্যাহত থাকবে এবং এর পরিণতি কেবল দুটি দেশকেই নয়, সমগ্র অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে। এই সংকটকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ দিতে না চাইলে সংলাপ জরুরি এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাও অপরিহার্য। #
পার্স টুডে/এমএএইচ/১৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।