পশ্চিমা বিশ্বের অন্ধকার ইতিহাসের পর্যালোচনা: কম্বোডিয়ায় মার্কিন অপরাধ
-
কম্বোডিয়ায় আমেরিকার অন্ধকার অধ্যায়
পার্সটুডে: ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ায় ব্যাপক হামলা চালিয়ে অসংখ্য নৃশংসতার জন্ম দেয়।
পার্সটুডে জানিয়েছে, ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়। ভিয়েতনামের প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়া প্রথমে তার নিরপেক্ষ অবস্থান ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এই দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভিয়েতকং বাহিনীর কম্বোডিয়ার সীমান্ত আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটিকে একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বিবেচনা করে।
১৯৬৫ সালে ভিয়েতকংদের মোকাবেলার অজুহাত দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে স্থল ও আকাশ হামলা শুরু করে। এই হামলা শুরুতে সীমিত ছিল, কিন্তু ১৯৬৯ সালে রিচার্ড নিক্সনের ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে তা তীব্রতর হয়। নিক্সন তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে কম্বোডিয়ায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। 'অপারেশন মেনু' (Operation Menu) নামের এই অভিযানে গোপন ও নৃশংস বোমাবর্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাতে শক্তি ও অর্থ ব্যবহারের কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না।
ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়
কম্বোডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন শুধু হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু ও দেশের অবকাঠামো ধ্বংসের কারণই হয়নি, বরং তা ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক স্পষ্ট উদাহরণ এবং ভবিষ্যতে খমের রুজ শাসনের উত্থান ও গণহত্যার ক্ষেত্রও তৈরি করেছিল।
মার্কিন বোমা হামলায় কম্বোডিয়ার ওপর ৫ লাখ ৪০ হাজার টন বোমা ফেলা হয় — যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত মোট বোমার দ্বিগুণেরও বেশি। হাজার হাজার গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়, দশ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয় এবং লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।
বোমাবর্ষণ কেবল সীমান্তবর্তী অঞ্চলই নয়, কম্বোডিয়ার গভীর ভূখণ্ডকেও লক্ষ্যবস্তু করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মন্দির, বাজার—কোনো জায়গাই বাদ যায়নি। বহু শিশু ঘুমন্ত অবস্থায় বা খেলাধুলার সময় প্রাণ হারায়।
কম্বোডিয়ায় বোমা হামলার ঘটনা বহু বছর গোপন রাখা হয় এবং কেবলমাত্র ১৯৭০-এর দশকে পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশিত হওয়ার পর এর আসল চিত্র সামনে আসে।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের পরও, এসব অপরাধের জন্য কোনো মার্কিন কর্মকর্তা কখনও বিচারের সম্মুখীন হননি।
এই প্রতিবেদনে আমরা এই অপরাধগুলোর কয়েকটি পর্যালোচনা করব:
১. গোপন বোমাবর্ষণ অভিযান - অপারেশন মেনু
১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র 'অপারেশন মেনু' নামে কম্বোডিয়ার পূর্বাঞ্চলে ৫৪০,০০০ টন বোমা ফেলে। ধারণা করা হতো, এই এলাকাগুলোয় ভিয়েতকং যোদ্ধারা লুকিয়ে আছে। কিন্তু এসব বোমা হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ নিহত হয়, গ্রাম, মন্দির, বাজার ধ্বংস হয়।
২. নিক লুং গ্রামের ধ্বংস
১৯৭৩ সালে, একটি মার্কিন বি-৫২ বোমারু বিমান ভুলবশত ছোট্ট শহর 'নিক লুং'-কে বোমাবর্ষণ করে। এই হামলায় ১৩০-এরও বেশি মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হয়। এই ঘটনাটি কম্বোডিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক ভুলগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃত।
৩. লক্ষাধিক মানুষের বাস্তুচ্যুতি: অবিরাম বোমা হামলার ফলে প্রায় দুই মিলিয়ন কম্বোডিয় নাগরিক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এই ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দেয় এবং এক ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি করে।
কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
মার্কিন হামলাজনিত অস্থিতিশীলতার কারণে তখনকার কম্বোডিয়ার সরকারের পতন ঘটে এবং ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা পল পটের নেতৃত্বে খেমার রুজ শাসনের উত্থানের পথ করে দেয়, যারা পরবর্তীতে ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত করে। এই গোষ্ঠী দুই মিলিয়নেরও বেশি কম্বোডিয়কে হত্যা করে। বহু বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কম্বোডিয়ায় পরিচালিত এই অপরাধই ছিল খমের রুজের উত্থান ও পরবর্তী গণহত্যার প্রধান ভিত্তি।
উপসংহার
কম্বোডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ ২০শ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামরিক আগ্রাসনের এক দৃষ্টান্ত। এই কার্যকলাপ শুধু হাজারো নিরীহ মানুষের জীবনই কেড়ে নেয়নি, বরং কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎকে বহু দশক ধরে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশ্বের নীরবতা এই অপরাধের প্রতি ইঙ্গিত করে যে, আন্তর্জাতিক বিচার ও জবাবদিহির ব্যবস্থাগুলো পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি।#
পার্সটুডে/এমএআর/২২