নাজমার পর সুমির কণ্ঠে বাঁচার আকুতি: এর শেষ কোথায়?
ড. সোহেল আহম্মেদ: সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি গৃহকর্মী সুমি আক্তারের আর্তনাদ-‘ওরা আমারে মাইরা ফালাইব, আমারে দেশে ফিরাইয়া নিয়া যান। আর কিছুদিন থাকলে মরে যাব।’
এক.
গত কয়েক দিন ধরেই ফেসবুকে সুমির বাঁচার আকুতি শোনা যাচ্ছে। প্রায় দুই মাস আগে এভাবেই আর্তনাদ করতে করতে শেষ পর্যন্ত পরপারে চলে গেছেন আরেক নারী গৃহকর্মী নাজমা বেগম। মৃত্যুর আগে সৌদি আরব থেকে টেলিফোনে নাজমার বাঁচার আকুতি ও পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা শুনে তখনও তার দুই সন্তানসহ স্বজনদের অনেকের হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হয়েছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারেন নি তারা। মৃত্যুর প্রায় দুই মাস পর নাজমার লাশ পেয়েছেন স্বজনরা। মা-কে দেশের মাটিতে কবর দিতে পেরেছেন এটাই এখন এতিম দুই সন্তানের বড় সান্ত্বনা।
এরপর ৩১ অক্টোবর গৃহকর্মী পারভিন আক্তারের লাশও বাংলাদেশে পৌঁছেছে। তার সঙ্গে সৌদি আরব যে মৃত্যুসনদ পাঠিয়েছে সেখানে লেখা আছে পারভিন আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর আগে পারভিনও তাদেরকে নির্যাতনের কথা জানিয়েছিলেন।
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রতিদিন গড়ে ১১টি লাশ বাংলাদেশে যাচ্ছে। এর মধ্যে নারী গৃহকর্মীদের লাশও রয়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে শুধু সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী শ্রমিক এসেছেন ২ লাখ ৬০ হাজার। এই সময়ে দেশে লাশ হয়ে ফিরেছেন প্রায় সাড়ে তিনশ’ নারী। এছাড়া গত কয়েক মাসে বহু নারীকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে স্বদেশে ফিরেছেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এখনও সুমির মতো অনেকেই স্বজনদের ফোন দিচ্ছেন, কেউবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্তা দিয়ে পরিস্থিতি জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, নিয়োগদাতারা তাদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করেন না।
এসব চিত্র থেকে এটা স্পষ্ট মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত আমাদের মা-বোনেরা ভালো নেই। নাজমা বেগমের ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়, কতটা নির্মমতার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা। নাজমা বেগম ফোনে তার পরিবারকে যেসব তথ্য দিয়েছিলেন তা থেকে জানা যায়, তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো। মালিকের ছেলের যৌন নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে। কথা না শুনলে বেধড়ক মারপিট করা হতো। এমনকি ওই বাড়ির অন্যরাও সুযোগ পেলেই তার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাতেন। মৃত্যুর দু'দিন আগেও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে যাবার জন্য স্বজনদের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন নাজমা। কিন্তু অর্থাভাবে তাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে পারে নি তার স্বজনরা। যেসব প্রবাসী উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠান অনেকেই তাদেরকে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলে সম্মান দেখান। নাজমা সেই অর্থে ‘রেমিট্যান্স শহীদ’।
দুই.
নাজমার মৃত্যু প্রমাণ করেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব নারী দেশে ফিরছেন তারা মিথ্যা বলছেন না। তারা সত্যিই নির্যাতনের শিকার। দেশে ফিরতে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা পাশবিক নির্যাতনের গল্প বানাচ্ছেন বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা মেনে নেয়া যায় না। মৃত্যুর আগে পাঠানো নাজমার বার্তা ও পরবর্তীতে তার লাশ প্রমাণ করছে তিনি যা বলেছিলেন তা মিথ্যা ছিল না। বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীরা অন্তত যৌন নির্যাতনের বিষয়ে মিথ্যা বলবেন না। কারণ তারা জানেন এমন নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবর নিজ এলাকায় রটে গেলে তিনি দেশে ফিরেও শান্তি পাবেন না,তাকে অপমান ও নিগ্রহ সহ্য করতে হবে। এর আগে কয়েকজন নারী দেশে ফেরার পর নিজ বাড়ীতেও ঠাঁই পান নি। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এটা জানতে পেরে স্বামী তাদের আর গ্রহণ করে নি। অন্য স্বজনরাও দায়িত্ব নিতে চায় নি। এর চেয়ে নির্মমতা আরও কী হতে পারে!
বাংলাদেশের বহু নারী গৃহকর্মীর সম্ভ্রম যে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে ঢাকার আহসানিয়া মিশনের দুঃস্থ নারী ও পরিত্যক্ত শিশু কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণকারী এক নারী গণমাধ্যমকে জানান, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে একটি বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়েছেন তিনি। গর্ভবতী হয়েছেন সে তথ্য গোপন করে দেশে ফিরে নিজের জীবন বাঁচিয়েছেন। গর্ভবতী হওয়ার তথ্য জানতে পারলে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাকে সেদেশ ত্যাগের অনুমতি দিত না। সাংবাদিকরা স্বচক্ষে তার অবস্থা দেখে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সেসব প্রতিবেদন গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
তিন.
মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মীরা মারা যাওয়ার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে তারা আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু এর মাধ্যমে কেবলি দায় এড়াতে চাইছে ঘাতকরা। সেদেশে হত্যার বিচারতো দূরের কথা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা পর্যন্ত হচ্ছে না। এ অবস্থায় নিজ দেশের নাগরিকদের অধিকার আদায় ও সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। সৌদি সরকারের সহযোগিতায় বিষয়টির সমাধান করতে হবে। সৌদি আরবসহ যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিচ্ছে তাদেরকে হত্যা-নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করতে বলতে হবে। এটা অবশ্যই ন্যায্য দাবি।
বিশ্বের সব দেশেই নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়ে আইন রয়েছে। আমাদের নারী গৃহকর্মীরা বৈধভাবে সেসব দেশে যাচ্ছেন। বৈধ হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইন-আদালতও তাদেরকে সহযোগিতা দেবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জোরালো উদ্যোগ দরকার। এসব অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধপ্রবণতা অনেকটা কমে আসবে।
আমাদের দূতাবাসগুলোর সহযোগিতায় প্রত্যেক বাংলাদেশির মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। যেসব দেশে আমাদের মা-বোনেরা হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সেসব দেশের সরকারকে বুঝাতে হবে এসব ঘটনায় তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ওই সব দেশের সরকার ও মানুষ সম্পর্কে বাংলাদেশিদের কাছে খারাপ বার্তা যাচ্ছে।
অবশ্য সরকার চাইলে ভিন্ন সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এর আগে সৌদি আরবের অসহযোগিতার কারণে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সেখানে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
চার.
প্রবাসে বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা দশ লাখের বেশি নয়। কিন্তু এর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি নারী গৃহকর্মী স্বদেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে ৫০টি শিশু গৃহকর্মীকে দেশে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হচ্ছে। সম্প্রতি নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার ১২ বছরের গৃহকর্মী জান্নাতীর হত্যাকাণ্ডটি এখনও সবাইকে কষ্ট দিচ্ছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শিশুটির দেহে ধর্ষণ ও পিটিয়ে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের শহর-গ্রাম সর্বত্রই এমন চিত্র। বাংলাদেশেও অনেকেই গৃহকর্মীদের মানুষ বলেই গণ্য করেন না। শিশুদের অবস্থা আরও করুণ। কারণ প্রতিবাদ করার শক্তি ও সাহস কোনোটিই তাদের নেই।
জান্নাতী চার বছর ধরে গৃহকর্তা সাইদ আহম্মেদ ও গৃহকর্ত্রী রোকসানা পারভিনের বাসায় কাজ করে আসছিল। ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত এই দম্পতির জান্নাতীর প্রায় সমবয়সী একজন সন্তান রয়েছে। নিজের সন্তান তাদের কাছে মানবশিশু হিসেবে মর্যাদা পেলেও জান্নাতী পেয়েছে শুধু বঞ্চনা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার। শিশু গৃহকর্মীরা প্রায় ২৪ ঘণ্টাই চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দির মতো জীবনযাপন করে। যখন প্রয়োজন তখন তাদের কাছ থেকে শ্রম নেওয়া হয়। ঘরের ভেতর অন্যের সন্তানকে অশিক্ষিত রেখে নিজের সন্তানকে শিক্ষিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চলে প্রায় প্রতিটি ধনী পরিবারে। আজ যারা উচ্চ শিক্ষিত তাদের অনেকের এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে নারী গৃহকর্মীদের অবদান। গৃহকর্মীরা সহযোগিতা করেন বলেই অনেক পরিবারের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন, পড়ালেখায় সাহায্য করতে পারেন।
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইন রয়েছে। তবে স্পষ্টভাবে গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় আলাদা আইন নেই। গৃহকর্মীদের সর্বনিম্ন বয়সও নির্ধারণ করে দেওয়া হয় নি। ভবিষ্যতে হয়তো এসবের সমাধান হবে। পাশাপাশি আমাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ধনী-গরিব সবাইকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
জান্নাতী হত্যায় মামলা হয়েছে। গৃহকর্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। গৃহকর্তাও হয়তো গ্রেপ্তার হবেন। শেষ পর্যন্ত এ মামলার কী হবে জানি না। প্রবাসে নিহতদের বিষয়ে বিচারতো দূরের কথা, মামলাই হচ্ছে না। তবে একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি শেষ বিচারের দিন এ ধরণের অপরাধের চরম শাস্তি হবে। সেদিনের আদালতে জান্নাতী, নাজমা, পারভিনরা কোনোভাবেই আমাদেরকে ক্ষমা করবে না।
লেখক: রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক।