ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৬ ১৯:২৪ Asia/Dhaka
  • পারস্যের পল্লী (১-১১)

বিধাতা সৃষ্টি করেছেন গ্রাম, আর মানুষ সৃষ্টি করেছে শহর। তাই প্রকৃতির অপরূপ শোভায় সমৃদ্ধ গ্রামের সৌন্দয্য ও জীবনধারা অকৃত্রিম। প্রকৃতির মতই প্রাণবন্ত ও সজীব গ্রামগুলো যে কোনো দেশ বা জনপদের মূল সম্পদ এবং মৌলিক অবকাঠামোর অংশ ।

নৈসর্গিক সৌন্দয্য ছাড়াও গ্রামগুলোর রয়েছে কূটির শিল্প, পল্লী-সাহিত্য ও সংস্কৃতিসহ ভৌগলিক ও আঞ্চলিক নানা আকর্ষণ। এসবই যে কোনো জাতির মূল জীবনধারা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অংশ। বিভিন্ন গোত্রের বৈচিত্রময় ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ গ্রামগুলো যেন বৃহত্তর মানব সভ্যতার পুষ্প-মাল্যের এক একটি আকর্ষণীয় ফুল। গ্রামাঞ্চলের নানা পেশার কষ্ট-সহিষ্ণু মানুষেরা মানব-সভ্যতায় অতীতের মত এখনও অবদান রেখে চলেছেন অকৃপন ঔদার্য্যে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত ইরানের গ্রামগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। ইরানের গ্রামগুলোর পরিচিতি ছাড়া দেশটির পরিচয় অসম্পূর্ণ । তাই ইরানের পরিচিতি ভালোভাবে তুলে ধরার নানা উদ্যোগের অংশ হিসেবে আমরা আয়োজন করেছি "পারস্যের পল্লী" শীর্ষক নতুন ধারাবাহিক আলোচনার। এ অনুষ্ঠানে আমরা ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক ও বিভিন্ন বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ইরানের কিছু গ্রামের বর্ণনা তুলে ধরবো।

হ্যাঁ, ইরানের স্বপ্নিল ও চিত্রময় এই গ্রামটির নাম "ওয়ারকানে"। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদের দিক থেকে ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সমৃদ্ধ শহর হামেদানের কাছে এই গ্রামটির অবস্থান। উল্লেখ্য, পশ্চিম ইরানে অবস্থিত হামেদান ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইরানের শ্রেষ্ঠ ৫ টি শহরের মধ্যে অন্যতম। এই হামেদানে রয়েছে ১১০০'রও বেশী গ্রাম। এর মধ্যে "সিমিন আবরু", "ওয়ারকানে", "খাকু", "হাবশী" ও "আলী সাদ্‌র" নামের গ্রামগুলো অত্যন্ত দর্শনীয় ও পর্যটকদের স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।

হামেদানের ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত "ওয়ারকানে" গ্রামটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ২৫০ মিটার উঁচু। আকাশে হেলান দেয়া পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই গ্রাম প্রাকৃতিক বিস্ময়ের সমারোহে যেন স্বর্গীয় এক নিকুঞ্জ । এ গ্রামের উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে "সার দোররেহ" নামের পাহাড়, পশ্চিমে "সিমিন" গ্রাম, দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে "সোরখ বোলাগ্ব" পাহাড় ও পূর্বে রয়েছে "কোরে দাগ্ব" পর্বত। অন্যদিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে "বরানী" এবং "কাশলাক্ব" নামের পাহাড়ী উপত্যকা। পাহাড়ের কোলে থাকায় ওয়ারকানে গ্রামটির আবহাওয়া ভারসাম্যপূর্ণ। "ওয়ারকানে"র অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা বৃদ্ধি করেছে আশপাশের "খান", "তাখতে সাঙ্গ", "যেন্ " ও "সে বোলাগ্ব" নামের পাহাড়ী উপত্যকাগুলো। পর্বতসংকুল এ গ্রামে রয়েছে কয়েকটি মৌসুমী ঝর্ণা বা ছোট নদী। "ওয়ারকানে"র পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে "আরযান ফার্দ" নামের একটি নদী। ভূ-গর্ভস্থ কয়েকটি খালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে "ওয়ারকানে" গ্রাম। "ওয়ারকানে" কূর্দী শব্দ। ওয়ার অর্থ পাশ বা কিনার, আর কানে অর্থ ঝর্ণা। তাই "ওয়ারকানে" শব্দের অর্থ হলে পানি বা ঝর্ণার কিনার।

"ওয়ারকানে" গ্রামটি প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। এই গ্রামে রয়েছে ফার্সী, কূর্দী ও আযেরী ভাষাভাষী মানুষ। ২০০৬ সালে পরিচালিত জরীপ অনুযায়ী গ্রামটির জনসংখ্যা দুই হাজার। তাদের প্রধান পেশা কৃষিকাজ ও পশুপালন। কেউ কেউ হস্ত বা কুটির-শিল্পের কাজে জড়িত। এখানকার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মধ্যে গম, যব, সিম, ছোলা, আলু ও বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধী শাক-সবজি এবং আঙ্গুর, আপেল, আখরোট ও খুবানী জাতীয় ফল উল্লেখযোগ্য। দুগ্ধ-জাত বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্য, পশম ও গোশত এ গ্রামের উৎপাদিত আরো কিছু উল্লেখযোগ্য পণ্য।

"ওয়ারকানে" গ্রামের ঘর-বাড়ী ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কাজে স্থানীয় মাল-মশলা ও বিশেষ করে পাথরের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এখানকার স্থাপনার অবকাঠামো ছাড়াও অন্যান্য অংশেও পাথরের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যেমন, প্রধান দেয়াল ও উঠানের দেয়াল নির্মাণে পাথরের ব্যবহার অপরিহার্য। পাথরের এত ব্যাপক ব্যবহার যেন "ওয়ারকানে"র আভিজাত্য ও সৌন্দর্য্যেরই অংশ। এখানকার পাথরের দেয়ালগুলো ঘর-বাড়ীর নীচের তলায় এক মিটার পর্যন্ত চওড়া হয়। পাথর ও কাদামাটি মিশিয়ে নির্মাণ করা হয় দেয়াল বা ইমারাত। দেয়ালগুলোর মধ্যে সংযোগ বা বাঁধনের মাধ্যম তথা রড হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠ। "ওয়ারকানে" গ্রামের ঘর-বাড়ী নির্মাণে পাথরের এত ব্যাপক ব্যবহারের অন্যতম কারণ হ'ল, এখানে পাথর খুবই সহজ-লভ্য এবং বিভিন্ন ধরনের আবাহাওয়ায় এর টিকে থাকার প্রবল ক্ষমতা।

"ওয়ারকানে" গ্রামের আবাসিক অঞ্চলকে কয়েকটি এলাকায় ভাগ করা যায়। এসব এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবন। মসজিদের প্রবেশ-স্থলের কাছে রয়েছে এ গ্রামের সবচেয়ে পুরনো আবাসিক এলাকা। এ এলাকায় রয়েছে মসজিদ, গণ-গোসলখানা ও টেলিযোগাযোগ কেন্দ্র। "ওয়ারকানে" গ্রামে বয়স্ক বা মুরব্বী ও গণ্যমান্য শ্রেণীর মানুষকে খুবই সম্মান করা হয়। এ গ্রামের দুই কিলোমিটারের মধ্যে "কোল্ য়ে আরবাবি" ও "আস্তাবল" নামক দুটি ঐতিহাসিক স্থাপনার অস্তিত্ব এই ঐতিহ্যের জ্বলন্ত স্বাক্ষর। "কোল্ য়ে আরবাবি" নাম থেকেই এ গ্রামের সর্দারের সাথে প্রজাদের সু-সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়। "ওয়ারকানে" গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে সবুজ পাহাড়ের কোলে চিত্রময় এই কেল্লার অবস্থান। ৩২০ বর্গমিটার এলাকা-জুড়ে শক্ত ভিত্তির ওপর নির্মিত নয়নাভিরাম এই কেল্লার হাতছানি উপেক্ষা করা যে কোনো দর্শক ও পর্যটকের জন্য দুঃসাধ্য।

"ওয়ারকানে" গ্রামের প্রতিটি সড়ক এবং অলি-গলি পাথরের নির্মিত হওয়ায় আপনি পাথরের সুদৃশ্য গালিচার মধ্যে রয়েছেন বলে অনুভব করবেন। রঙ্গীন পাথরের এইসব পথ যেন গোটা গ্রামকে অপরূপ ও সুশৃঙ্খল বিন্যাসে বিন্যস্ত করেছে। এই পথগুলোর পাথরের রঙ্গের সাথে মিল রেখে সড়কের পাশে ফুটপাথে রংবেরংয়ের আলোক-সজ্জার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে রাতের বেলায় মনে হবে আলোর বর্ণাঢ্য মিছিলে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে পুরো গ্রাম। এইসব অপরূপ সাজ-সজ্জা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে ইরানের ইসলামী সরকারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থা ও ইসলামী বিপ্লবী আবাসন সংস্থার সহযোগিতায়। এসব সরকারী সহযোগিতা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে "ওয়ারকানে" গ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য-শৈলী আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, "ওয়ারকানে" গ্রামটি অধ্যাপক তৌফিক মুসিওয়ান্দের জন্মভূমি। পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম হৃদযন্ত্রের নির্মাতা হিসেবে খ্যাত এই অধ্যাপক ১৯৩৪ সালে জন্ম নিয়েছিলেন এই ঐহিত্যবাহী গ্রামে।

"ওয়ারকানে" গ্রামের অপরূপ দৃশ্য, মনোরোম স্থাপত্য-শৈলী ও সুদৃশ্য বাড়ী-ঘর ছাড়াও গ্রামটির পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সবার নজর কাড়ে। ফার্সী অবন মাসের মধ্যভাগে তথা অক্টোবর মাসের শেষ প্রান্তে বা নভেম্বর মাসের শুরুতে "গজলে ইউসুফ ইয়ারাম ত্বক্বলু" ও " "ওয়ারকানী" নামের দুটি গোত্র বা উপজাতি "ওয়ারকানে" গ্রামের ওপর দিয়ে তাদের যাযাবরী-যাত্রা শুরু করে থাকে। যাযাবরী-মৌসুম শেষ হবার পর তারা ক্বাশলাক্ব অঞ্চলে ফিরে যায়। এই গোত্রগুলোর যাযাবরী-যাত্রার উদ্দেশ্য হল পশু-চারণের জন্য বেশী উপযোগী উপত্যকার সন্ধান করা। যাই হোক্, এ দুই গোত্রের যাযাবরী-যাত্রার সময় "ওয়ারকানে" গ্রাম ও এর আশপাশের অঞ্চল আরো মনমুগ্ধকর হয়ে উঠে। এই অঞ্চলের ছোট ছোট নদী ও ঝর্ণা "ওয়ারকানে" গ্রাম এবং তার আশপাশের এলাকাকে সবুজ ও প্রাণবন্ত রেখেছে। বিশেষ করে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে এইসব স্রোতস্বিনী-বিধৌত এখানকার সবুজ-শ্যামলিমা ও ছায়াঘেরা সবুজ বনানী এবং বিভিন্ন ফলের বাগান আরো চোখ-জুড়ানো হয়ে উঠে। একদিকে সবুজের এত প্রাচুর্য ও সমারোহ ও অন্যদিকে পাহাড়ী প্রকৃতি এবং প্রাণোচ্ছল পানির ফল্গুধারা গোটা অঞ্চলে সৃষ্টি করেছে সৌন্দর্য্যের অফুরন্ত বন্যা। সৌন্দর্য্যের এসব বণ্যায় অবগাহন করতে গিয়ে আপনার মন হয়তো কবির সাথেই সুর মিলিয়ে বলে উঠবে, "সুন্দর তুমি কতরূপে কতভাবে প্রকাশিছ আপনারে।" #
পারস্যের পল্লী (দুই)

ইরানের চিত্রময় ও স্বপ্নিল সৌন্দয্যে ভরা গ্রামগুলোর পরিচিতি তুলে ধরার প্রথম আসরে আমরা নয়নাভিরাম ওয়ারকানে গ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা ঐতিহাসিক হামেদান অঞ্চলের আরো দুটি অপরূপ গ্রামের পরিচয় তুলে ধরবো। এ দুটি গ্রামের নাম আলী সাদ্‌র ও খ'কু।

আলী সাদ্‌র গ্রামটির অবস্থান হামেদান থেকে ৭৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। পাহাড়ী ও মালভূমি জাতীয় অঞ্চল হওয়ায় এখানকার আবহাওয়া আরামদায়ক। ওয়ারকানে গ্রামটির মত এই গ্রামটির বয়সও প্রায় চার'শ বছর। এই গ্রামটির প্রাচীন জনপদ আঁকা-বাঁকা সর্পিল সড়ক ও অলি-গলিতে ভরপুর। এ ছাড়াও এ গ্রামের ওপর বয়ে যাওয়া কয়েকটি স্বচ্ছ-সলিলা স্রোতস্বিনীর পাশাপাশি এখানকার স্থাপনাগুলোর ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য-শৈলী এবং সাজানো-গোছানো ফলের বাগান আলী সাদ্‌র গ্রামটিকে নৈসর্গিক ও মন-ভোলানো গ্রামে রূপান্তরিত করেছে।

আলী সাদ্‌র গ্রামটির বিশেষ আকর্ষণের মধ্যে এর প্রাচীন মসজিদ ও হযরত যায়েদ (রা)এর মাজার বা জিয়ারত-কেন্দ্র অন্যতম। তবে এ গ্রামের ভূগর্ভস্থ খালগুলো গোটা বিশ্বে এ গ্রামকে করেছে নজিরবিহীন। অনিন্দ্য-সুন্দর এই খালগুলোতে নৌকা-ভ্রমন আপনাকে নিয়ে যাবে রূপকথার মত অথচ বাস্তব এমন এক জগতে যেখানে কল্পনা আর সৌন্দর্য্য এগিয়ে চলে হাতে হাত ধরে। বিস্ময়ের ব্যাপার হ'ল, ভূগর্ভস্থ এই খালগুলো সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ৯০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
ভূগর্ভস্থ খালগুলো আলী সাদ্‌র গ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে সুব'শি নামের পাহাড়ে অবস্থিত। এইসব খাল থেকে ৭ ও ১১ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সুব'শি ও সারাব নামের আরো দুটি ভূগর্ভস্থ খাল। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, এসব খালের বয়স আনুমানিক ১৩৬ থেকে ১৯০ মিলিয়ন বছর বা ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ থেকে ১৯ কোটি বছর।
ইরানের সাফাভী রাজবংশের শাসনামলে এইসব ভূগর্ভস্থ খাল চিহ্নিত বা আবিস্কৃত হয় বলে প্রথম দিকে মনে করা হত। কিন্তু প্রত্নতাত্তিক খনন ও এর ফলে আবিস্কৃত পোড়া মাটির পাত্র থেকে জানা যায়, সেলযুকদের শাসনামলেও এইসব খালের পাশে জনবসতি ছিল।

আলী সাদ্‌র-এর ভূ-গর্ভস্থ খালগুলোর প্রবেশ পথে, ছাদে এবং এর বিভিন্ন স্থানে খাল-সংলগ্ন পাহাড়ের দেয়ালে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের পাথর দেখা যায়। এসব পাথরের বিন্যাস খালগুলোর সৌন্দর্য্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব পাথর থেকে বোঝা যায় অতীতে এইসব স্থানেও পানির প্রবাহ ছিল। আলী সাদ্‌র-এর ভূ-গর্ভস্থ খালগুলোর পানির উচ্চতা বা গভীরতা আধা-মিটার থেকে ১৪ মিটারও দেখা যায়। খালগুলোর কিছু অংশ নৌকাযোগে অতিক্রম করার পর কিছু অংশকে পুরোপুরি শুকনো দেখতে পাবেন এবং এরপর আবারও কিছু অংশে পানি থাকায় সেখানেও নৌকাযোগে ভ্রমণ করতে হয়। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ খাল, সুড়ঙ্গ ও স্থাপনা মিলিয়ে ১৪ কিলোমিটার পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পথ চিহ্নিত হয়েছে। তবে কেবল প্রায় ৪ কিলোমিটার পথে আলোক-সজ্জার ব্যবস্থা থাকায় বাকী পথে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আলী সাদরের গুহায় বহু সংখ্যক খাল রয়েছে। এমনকি এখানকার ভূ-গর্ভস্থ অনেক খাল এখনও আবিস্কৃত হয় নি।

১৯৬২ সালে হামেদানের একদল পর্বতারোহী এ অঞ্চলে খনন কাজ চালায়। ৫ বছর পর ভূ-গর্ভস্থ এই খালগুলোতে আলো বা বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা নেয়া হয় যাতে সাধারণ মানুষ এই খালগুলো পরিদর্শন করতে পারে। এরপর থেকে আলী সাদ্ র-এর ভূ-গর্ভস্থ এই খালগুলো শুধু ইরানের নয়, বরং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণীয় পর্যটন-কেন্দ্রে পরিণত হয়।

আলী সাদ্ র-এর ভূ-গর্ভস্থ খালগুলোর মূল প্রবেশ পথের আশপাশে কয়েকটি ছোট-বড় ভবন রয়েছে। এই ভবনগুলো আঁকা-বাঁকা বা সর্পিল করিডোর দিয়ে সংযুক্ত। করিডোরগুলো ছাদযুক্ত এবং করিডোরের দেয়ালগুলো জালের মত ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় ভবনগুলোর শোভা বা সৌন্দর্য্য সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। এসবের মধ্যে কোনো কোনো ভবন কয়েকশ বর্গমিটার পর্যন্ত প্রশস্ত।

আলী সাদ্ র-এর ভূ-গর্ভস্থ খালগুলোর পানির উৎস হল ভূগর্ভস্থ ঝর্ণা ও বিভিন্ন খালের শাখা। এর পানির উষ্ণতা মোটামুটি শীতল এবং তা প্রায় ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই পানির বিশেষ কোনো গন্ধ ও স্বাদ নেই। পানির বর্ণ হালকা নীল রংয়ের ও খুবই স্বচ্ছ। এর পানি এত স্বচ্ছ যে মোটামুটি আলোতেও ৫ মিটার গভীরতায় থাকা বস্তু বা খালের তলা খালি চোখে দেখা যায়। এই পানিতে অম্লতা ও ক্ষারের পরিমাণ এমন যে তা পান করার অযোগ্য এবং এ জন্য এ পানিতে কোনো জীব বেঁচে থাকতে সক্ষম নয়।
আলী সাদ্ র-এর ভূ-গর্ভস্থ খালগুলোর ওপরের বাতাস পরিস্কার, ধুলো-বালিহীন ও স্থির। তাই এখানে যদি কোনো মোমবাতি জ্বালানো হয় তাহলে এর শিখায় কোনো নড়াচড়া দেখা যায় না।
আলী সাদ্ র-এর ভূ-গর্ভস্থ খালগুলো দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে ছুটে আসেন। তাই এখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। কিন্তু তাও চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন ধরনের সুদৃশ্য মাটির পাত্র, সিরামিকের দ্রব্য, ওয়াল কার্পেট, গালিচা, মোজা, মাফলার প্রভৃতি পণ্য পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় উপহার হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ছাড়াও এখানকার নানা কূটির শিল্প-জাত পণ্য, দুগ্ধজাত পণ্য ও স্থানীয় খাবার-দাবার পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে এখানকার বিভিন্ন কাবাব, রুটি, কোপ্তা হালিম, আবগুশত নামের খাবার ভোজন-বিলাসীদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ ।

এবারে পশ্চিম ইরানের হামেদান অঞ্চলের অন্য একটি রোমাঞ্চকর গ্রামের পরিচয় তুলে ধরবো। এই গ্রামটির নাম খ'কু। হামেদান থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ গ্রাম সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৩০০ মিটার উঁচু। ভূ-মধ্যসাগরীয় হাওয়ার প্রভাবে এখানকার আবহাওয়া শীতকালে খুবই শীতল এবং গ্রীষ্মকাল বেশ গরম ও শুস্ক। খ'কু গ্রামের বয়স প্রায় ৫০০ বছর। এ গ্রামের দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে একটি মৌসুমী স্রোতস্বিনী । এখানকার অধিবাসীদের মূল পেশা কৃষিকাজ ও পশুপালন। গোটা গ্রামটি বেশ ঢালু পাথর-বহুল পাহাড়ী উপত্যকায় অবস্থিত। চারদিকে বৈচিত্রময় নানা বৃক্ষশোভিত সবুজ বনানী ও ফলের বাগানে পরিবেষ্টিত পাহাড়ী গ্রাম খ'কু যেন এক মায়াময় স্বপ্নপুরি ও সৌন্দর্য্যে ভরপুর নন্দনকানন। বিশ্বনবী (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের বংশধর বা ইমামযাদে বাবা তাহিরের মাযার এ গ্রামের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ঐতিহাসিক এ মাযার পরিদর্শন না করলে এই গ্রামে আপনার সফর যেন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বাবা তাহির একজন বিখ্যাত কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে খ্যাত। তার কবিতাগুলো দ্বিপদী এবং খুবই জনপ্রিয়।

সেলযুকদের শাসনামল বা হিজরী চতুর্থ শতকের শেষের দিক ও পঞ্চম শতকের প্রথম দিক তথা খৃষ্টীয় একাদশ শতককে বাবা তাহিরর জীবনকাল বলে মনে করা হয়। আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে তিনি বাবা উপাধি পেয়েছিলেন। পার্থিব সব ধরনের লোভ ও মোহ থেকে দূরে ছিলেন বলে তাকে উরিয়ান বা নগ্নও  বলা হত।Â

 পারস্যের পল্লী - তিন

ইরানের চিত্রময় ও স্বপ্নিল সৌন্দয্যে ভরা গ্রামগুলোর পরিচিতি তুলে ধরার দ্বিতীয় আসরে আমরা নয়নাভিরাম আলী সাদ্ র ও খ'কু গ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা ঐতিহাসিক ইস্ফাহান প্রদেশের "মেসর" বা মিশর নামক অপরূপ গ্রাম ও এর আশপাশের দর্শনীয় স্থানের পরিচয় তুলে ধরবো।

"মেস্‌র" বা মিশর শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে পিরামিড ও নীল নদীর দেশ হিসেবে সুপরিচিত উত্তর আফ্রিকার একটি আরব-মুসলিম দেশের ছবি। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হ'ল ইরানের কেন্দ্রীয় মরুভূমি অঞ্চলের নায়িন জেলায় "মেস্ র" বা মিশর নামের একটি গ্রাম আছে। নদীর মোহনা বা সংকীর্ণ প্রণালীর পাশে অবস্থিত সমতল ভূমির এ গ্রামটি যেন বালুময় মরুভূমিতে একটি স্বর্গীয় নিকুঞ্জ বা বেহেশতের দ্বীপ। ইরানের "মেস্ র" বা মিশর গ্রামটি ইস্ফাহানের উত্তরাঞ্চল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চিত্রময়, স্বপ্নিল ও মিছরির মত মিষ্টি সৌন্দর্য্যে ভরপুর এ গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪৪ টি পরিবার।

ইরানের "মেস্ র" বা মিশর গ্রামটি ইরানের "দাশতে কাভির" বা কাভির মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার আবহাওয়া উষ্ণ ও শুস্ক। এখানকার জনগণের পেশা কৃষিকাজ ও পশুপালন। কৃষি-পণ্য ও ফলের জন্য "মেস্ র" বা মিশর গ্রামটির খ্যাতি রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত প্রধান কৃষি-পণ্য হল- গম, খেজুর, ডালিম, জাফরান, রসুন এবং গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন ফসল। সীমিত মাত্রায় মাছের চাষও হয় এই গ্রামে।

ইরানের "মেস্ র" বা মিশর গ্রামটির পাশেই রয়েছে আমিরাবাদ ও ফারাহযাদ নামের গ্রাম। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ৬ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এ দুটি গ্রাম। ফারাহযাদে বাস করে অল্প কয়েকটি পরিবার। আর আমিরাবাদ মেসর গ্রামের কৃষিজীবীদের কৃষিকাজের জায়গা। "মেস্ র" থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমিরাবাদ যেন ইরানের ফল-বাগানগুলোর প্রতীক বা স্মারক। এখানে রয়েছে মিঠা পানির একটি কূয়া। মরুময় শুস্ক অঞ্চলে এ ধরনের কূয়ার প্রতি ফোটা পানি অত্যন্ত মূল্যবান। আর এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে মনোরম মরুদ্যান বা ওয়েসিস। কয়েকটি বালুর টিলার মধ্যে চির-সবুজ ঝাউ জাতীয় গাছসহ আঙ্গুর-লতা ও খেজুর-গাছ যেন বালুর সাগরে স্নিগ্ধ সবুজের দ্বীপ। চোখ-জুড়ানো শ্যামল-মায়াবী এসব দৃশ্য দেখে আপনি মুহূর্তেই ভুলে যাবেন যে এটা আসলে মরু-অঞ্চল। এখানাকার পশু-পালন, কৃষিকাজ ও বিভিন্ন দিকে সমৃদ্ধির সমারোহ পর্যটকদের বিস্মিত করে। এইসব সমৃদ্ধি এ অঞ্চলের লোকজনের পরিশ্রমী ও কষ্ট-সহিষ্ণু প্রকৃতির প্রমাণ বহন করছে।

আমিরাবাদ পেরিয়ে এবার ঢোকা যাক্ খোদ মিশর গ্রামে। ইরানের প্রথাগত গ্রামগুলোর মত এ গ্রামের সড়ক বা অলি-গলি সংকীর্ণ ও আঁকা-বাঁকা নয়। প্রশস্ত সড়ক-পথে এ গ্রামে প্রবেশ করার পর সড়কের দুই পাশের আবাসিক ভবনগুলো এবং গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে-যাওয়া খাল আপনার নজর কাড়বে। ২৫ কিলোমিটার দূরের একটি কূপ থেকে এই খাল দিয়ে মেস্ র বা মিশর গ্রামের মিঠা পানি সরবরাহ করা হয়। এখানকার ভবনগুলোর স্থাপত্য-শৈলী প্রথাগত বা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির। ফলে বৈদ্যুতিক কুলার ছাড়াই গ্রীষ্মকালে ঘরগুলোকে ঠান্ডা রাখা যায়। বিশেষ করে বাতাস প্রবেশের জন্য ভবনের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা থাকায় এবং খড়-কূটা মেশানো কাদামাটি দিয়ে এসব বাড়ী-ঘর নির্মিত হওয়ায় ঘরের ভেতরের আবহাওয়া সহনীয় বা আরামদায়ক থাকে। উজ্জ্বল রংয়ের এই বাড়ীগুলোও বেশ দৃষ্টি-নন্দন। এ গ্রামের আশপাশের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে একটি লবন হ্রদ, নল-খাগড়ার বন, "তাখতে আব্বাসি" ও "তাখতে আরুস" এবং একটি পাহাড়ী খাদের কথা উল্লেখ করা যায়।

ইরানের "মেস্ র" বা মিশর গ্রাম থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্বে রয়েছে নল-খাগড়ার ঝোঁপ বা বন। একটি নয়নাভিরাম ঝর্ণার ফলে এই বন সৃষ্টি হয়েছে। এই ঝোঁপের কোনো কোনো নল-খাগড়া ৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু। এই ঝর্ণা এখানকার পশু-পাখির পানি-পানের কেন্দ্র। এই ঝর্ণার সুবাদে এখানে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক চিড়িয়াখানা। বালুময় মরুভূমিতে নল-খাগড়ার এই ঝোঁপ বা বন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অনন্য ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে।

"সালকনুন" নামের একটি পাহাড়ী খাদ "মেস্ র" বা মিশর গ্রামের আরেকটি বড় আকর্ষণ। এটি এই গ্রামের উত্তর অংশে রয়েছে। এই খিরি-খাদটি আশপাশের পাহাড়ের চেয়ে নীচু ও বেশ গভীর। এর একাংশে রয়েছে একটি জলাশয় বা বিল। এই খাদের গভীর ঢাল, কঙ্করময় বালি বা ছোট পাথরের আবরণ এবং আশপাশের বালির টিলা এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা করেছে। আর এইসব অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে ছুটে আসেন প্রকৃতি-প্রেমী বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক।

মরুময় এ এলাকার রাতের আকাশও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। কারণ এখানে রাতের আকাশ স্বচ্ছ এবং উজ্জ্বল তারকা ও নক্ষত্র-শোভিত। বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহীদের জন্য এই অঞ্চল অত্যন্ত উপযোগী স্থান। এ ছাড়াও উটের পাল এবং উটে চড়ে কঙ্করময় বালুর টিলায় ভ্রমণ ইরানের "মেস্ র" বা মিশর গ্রামের আরেকটি রোমাঞ্চকর আকর্ষণ।
মরুচারণে আগ্রহী পর্যটকদের জন্যে ফারাহযাদ ও মিশর গ্রামে দুটি সুন্দর অতিথি-ভবন বা হোটেল রয়েছে। এইসব হোটেল বা অতিথি-ভবনে গরম পানিতে গোসল করার এবং রান্না-বান্নারও সুযোগ-সুবিধা আছে। অবশ্য মিশর ও ফারাহযাদ গ্রামের কোনো কোনো বড় আবাসিক ভবনও ভাড়া করা যায়। ইরানের ঐতিহ্যবাহী কিছু সুস্বাদু খাবারও এখানকার বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে ডালিমের সস, খেজুরের ঘন রস ও উটের দুধ নজিরবিহীন সৌন্দর্য্যে ভরপুর এই গ্রামের সওগাত বা উপহার হিসেবে নিয়ে যেতে পারেন প্রিয়জনদের জন্য।
পারস্যের পল্লী (চার)

ইরানের চিত্রময় ও স্বপ্নিল সৌন্দর্য্যে ভরা গ্রামগুলোর পরিচিতি তুলে ধরার তৃতীয় আসরে আমরা ঐতিহাসিক ইস্ফাহান প্রদেশের "মেসর" বা মিশর নামক অপরূপ গ্রাম ও এর আশপাশের দর্শনীয় স্থানের পরিচয় তুলে ধরেছি। আজকের আসরে আমরা সবুজের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ও মায়াবী শ্যামলিমার প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ ইরানের উত্তরাঞ্চলের "ক্বাল্ য়া রুদখান" নামক গ্রামে সফর করবো।

ইরানের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত গিলান প্রদেশের রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের ব্যাপক ঐশ্বর্য্য এবং অনেক আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন। গিলান প্রদেশের ফুমেন অঞ্চলের ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে "ক্বাল্ য়া রুদখান" নামের চিরসবুজ গ্রাম। সবুজ পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত এই গ্রামের আবাসিক বুনন মোটামুটি ঘন। এখানকার ভারসাম্যপূর্ণ পাহাড়ী আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। "ক্বাল্ য়া রুদখান" নামটির "রুদখান"/ নদী বা ফার্সী রুদখানেহ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। আর "ক্বাল্ য়া" শব্দটির অর্থ কেল্লা বা দূর্গ। এখানকার নদীর কাছে একটি কেল্লা বা দূর্গ থাকায় গ্রামটির এই নামকরণ করা হয়েছে। এই কেল্লা বা দূর্গ গিলানের প্রাচীন শাসকদের অন্যতম দপ্তর বা আবাসস্থল ছিল।

"ক্বাল্ য়া রুদখান" গ্রামের মানুষ এ অঞ্চলে প্রচলিত স্থানীয় "ত'লেশী" ও "গিলাকী" ভাষায় কথা বলে। পশুপালন, কৃষিকাজ এবং রেশমের চাষ এখানকার লোকদের প্রধান পেশা। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এই গ্রামের পুরনো অংশের ঘর-বাড়ীগুলো দুই-তলা বিশিষ্ট। এইসব বাড়ীঘরের মেঝে কাঠ এবং মাটি ও খড়ের আস্তর দিয়ে নির্মিত। বাড়ীর নীচের তলা শীতকালে এবং উপরের অংশ ও ব্যালকনী গ্রীষ্মকালে বসবাসের জন্য ব্যবহার করা হয়।
"ক্বাল্ য়া রুদখান" গ্রামের অধিকাংশ জনগণ স্থানীয় পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করে। এ গ্রামের মহিলারা অবসর সময়ে হস্ত-শিল্পের কাজ করেন। এখানকার হস্ত-শিল্প বা কুটির শিল্প-সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শাল, মোজা, চাদর ও দস্তানার মত নানা পশমী দ্রব্য।
ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামের মত এ গ্রামেও বিভিন্ন বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবের আসর বসে। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে নওরোজখানি অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান। নববর্ষ বা নওরোজের প্রাক্কালে কবিতা-পাঠের আসরকে বলা হয় নওরোজখানি। এ ছাড়াও রোদ ওঠার কামনায় গুলি বর্ষণ, বৃষ্টি বর্ষণের আশায় স্যুপ রান্না করা এবং পাকা ধান ঘরে তোলার সময়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ উৎসবও ব্যাপক গুরুত্ব পেয়ে থাকে।

তবে ইরানের "ক্বাল্ য়া রুদখান" গ্রামের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হ'ল, "ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গ। এ দূর্গ সাসানীয় রাজবংশের শাসনামলে অর্থাৎ খৃষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। হিজরী পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে তথা খৃষ্টীয় এগারশ ও ১২ শ শতকে সেলযুক শাসনামলে দূর্গটিকে পুনর্নিমাণ করা হয় এবং এটি ঈসমাইলীয়দের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হত। "ক্বাল্ য়া রুদখান" প্রাচীন দূর্গ, ক্বালয়া হেসামী এবং হাজার সিঁড়ির দূর্গ নামেও পরিচিত।

"ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গটি ফুমেন অঞ্চলের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। সবুজ বনানীতে ঘেরা উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত এই দূর্গে পৌঁছার জন্য ফুমেন শহর ও এরপর হেইদারঅ'লাত গ্রামসহ কয়েকটি গ্রাম গাড়ীতে চড়ে অতিক্রম করতে হয়। হেইদারঅ'লাত গ্রামের পর প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এবং বেশ কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে। এখানকার খরস্রোতা স্রোতস্বীনী ও সবুজের অফুরন্ত উচ্ছ্বাসে ভরা বনানীর পাশ দিয়ে এগিয়ে চলা এই পাহাড়ী সড়ক পর্বতারোহী ও স্থানীয় লোকদের কাছে "দালানে বেহেশত" নামে সমাদৃত। এই অঞ্চল পরিদর্শনের সবচেয়ে উপযোগী সময় হল বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল। তবে বছরের অন্য সময়েও আপনি এই নয়নাভিরাম দূর্গ দেখতে আসতে পারেন ।

"ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গটি ইরানের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সামরিক দূর্গের প্রজ্জ্বোল নিদর্শন। এ ঐতিহাসিক দূর্গটি বহু বছর ধরে গিলানের শাসকদের রাজধানী ছিল। এটি ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক দূর্গ। ৫০ হাজার বর্গমিটার এলাকা-জুড়ে বিস্তৃত "ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গটি এখানকার পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু অংশে অবস্থিত। ৬০০ মিটারেরও বেশী উঁচুতে অবস্থিত এই দূর্গের দেয়ালের দৈর্ঘ্য ১৫০০ মিটার। ১৮৩০ সালে রুশ গবেষক আলেক্সান্ডার শেভাদজকো এই দূর্গ সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে লিখেছেন, "ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গটি এই নামেরই একটি নদীর পাশে পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু অংশে অবস্থিত। এর ছাদ পাথর ও ইটের তৈরি। এর প্রবেশ-পথের দুই পাশে রয়েছে অত্যন্ত মজবুতভাবে নির্মিত দুটি প্রতিরক্ষামূলক উঁচু টাওয়ার। মূল প্রবেশ-পথের উপরে শিলালিপিতে এই দূর্গের পুননির্মাণের কথা লেখা রয়েছে। এতে লেখা হয়েছে যে, দূর্গটি হিজরী ৯২৮ থেকে ৯২১ সালে পুননির্মিত হয়। অবশ্য এই শিলালিপিটি এখন রাশত শহরের জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

"ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গটি গিলানের বিস্ময়কর স্থাপত্য-শৈলীর নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। উপযুক্ত স্থান নির্বাচন, অত্যন্ত মজবুত মাল-মশলা বা নির্মাণ-সামগ্রী ব্যবহার, কয়েক ধরনের স্থাপত্য-রীতির প্রয়োগ এবং বৈচিত্রময় জ্যামিতিক ডিজাইন বা আকৃতি এই বিশাল দূর্গটিকে করেছে অনিন্দ্য-সুন্দর ও অপ্রতিদ্বন্দ্বি। অসাধারণ এ দূর্গের সামগ্রীক কাঠামো বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। বিশেষ করে এর পূর্বের ও পশ্চিমের অংশ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ । পুরো দূর্গ-জুড়ে রয়েছে ৪০ টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এসব টাওয়ারের কক্ষগুলো আটকোনা আকৃতির এবং সেসবের মধ্যে রয়েছে গম্বুজযুক্ত রোমান খিলান। দেয়াল ও টাওয়ারগুলোতে রয়েছে বেশ কিছু জানালা বা ছিদ্র-পথ। এসব জানালা দূর্গের ভেতরমুখি। এই ছিদ্র-পথগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে সেগুলোকে শত্রুর অবস্থানে গলিত গরম পদার্থ ও তীর নিক্ষেপের জন্য ব্যবহার করা যেত। ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, শত্রুরা কখনও এই দূর্গ জয় করতে পারে নি। তাই বলা যায় এই দূর্গ ইরানী স্থাপত্য-কুশলীদের সামরিক জ্ঞান ও স্থাপত্য-শৈলীর অসাধারণ দক্ষতার এক অমর নিদর্শন।

গিলানের "ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গের পশ্চিম অংশে থাকতেন রাজা ও তার পরিবারবর্গ। অন্য অংশে ছিল সেনানিবাস ও সেনা-তৎপরতার কেন্দ্র। দূর্গটির পশ্চিম অংশ ছিল দুই তলা ভবন বিশিষ্ট ও ইটের নির্মিত। প্রহরীদের অংশ ছিল পূর্ব দিকে। দোতালা এই ভবনে অসংখ্য ছিদ্র বা জানালা দেখা যায় । "ক্বাল্ য়া রুদখান" দূর্গ-কমপ্লেক্সের মাঝখানে সবচেয়ে নীচু অংশে রয়েছে একটি ঝর্ণা। দূর্গের পূর্ব দিকের অংশে দেখতে পাবেন ১২ টি প্রবেশ-পথ, কারাগার, জরুরী অবস্থায় ব্যবহারের জন্য দরজা এবং গোসলখানা। পশ্চিম অংশেও রয়েছে ১২ টি প্রবেশ-পথ। এ ছাড়াও ইরানের ঐতিহাসিক এই দূর্গ হৌজ বা জলাধার, পানির রিজার্ভ, হিমাগার এবং টাওয়ারযুক্ত কয়েকটি আবাসিক ভবনে সজ্জিত। প্রকৃতির অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে টিকে থাকা ইরানের এই প্রাচীন দূর্গটির রোমাঞ্চকর ও শিহরণ-জাগানো হাতছানি সব সময়ই আকৃষ্ট করছে দেশী-বিদেশী বহু পর্যটককে।
পারস্যের পল্লী (পাঁচ)

"পারস্যের পল্লী " শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তার আসর থেকে আপনাদের জানাচ্ছি সালাম ও আন্তরিক শুভেচ্ছা। ইরানের চিত্রময় ও স্বপ্নিল সৌন্দর্য্যে ভরা গ্রামগুলোর পরিচিতি তুলে ধরার চতুর্থ আসরে আমরা ইরানের উত্তরাঞ্চলের "ক্বাল্ য়া রুদখান" নামক গ্রাম ও এই নামেরই ঐতিহাসিক একটি দূর্গের পরিচয় তুলে ধরেছি। আজকের আসরে আমরা সবুজের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ও মায়াবী শ্যামলিমার প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ গিলান অঞ্চলের আরো একটি গ্রামে সফর করবো। আকাশে হেলান-দেয়া আলবোর্জ পর্বতমালার কোলে " মসুলেহ " নামের অনিন্দ্য-সুন্দর এ গ্রামে আমাদের আজকের এই আনন্দ-ঘন সফর আপনাদের সবারই ভাল লাগবে বলে আশা করছি।

ইরানের কোনো কোনো গ্রাম প্রাকৃতিক আকর্ষণ ও সৌন্দর্য্যে ভরপুর হওয়ায় এসব গ্রাম দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠেছে দুনির্বার আকর্ষণের কেন্দ্র। ইরানের এ ধরনের কয়েকটি গ্রামের মধ্যে আযারবাইজান প্রদেশের "কান্দুয়ান" ও "বোনে কোহাল", কেরমান প্রদেশের "মেইমান্দ" এবং গিলান প্রদেশের "ইমামজাদে ইব্রাহীম (রঃ)''র নাম উল্লেখ করা যায়। "বোনে কোহাল" গ্রামের ভূগর্ভস্থ বাড়ী-ঘর এবং গিলানের "ইমামজাদে ইব্রাহীম (রঃ)'' নামক গ্রামের বহুতল-বিশিষ্ট কাঠের ঘর পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আলবোর্জ পর্বতমালার কোলে " মসুলেহ " নামের অনিন্দ্য-সুন্দর গ্রামটির খ্যাতি এই সব গ্রামের দারুন খ্যাতিকেও ম্লান করে দেয়। ধাপে ধাপে পাহাড়ের ওপরের দিকে বিস্তৃত এই গ্রামটি এতই খ্যাতি অর্জন করেছে যে আরো কয়েকটি গ্রাম এই "মসুলেহ" নাম ধারণ করেছে। যেমন, ফার্স প্রদেশের "অরান" গ্রামকে বলা হয় ফার্সের মসুলেহ এবং কূর্দিস্তানের আকাশ-ছোঁয়া জাগ্রোস পর্বতমালায় অবস্থিত "উরামানাত" গ্রামটিও মসুলেহ নাম ধারণ করে নিজেকে ধন্য করেছে।

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ। কর্মব্যস্ত আধুনিক মানুষের একঘেয়ে যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর করার জন্য কর্ম-বিরতি বা ছুটি অপরিহার্য। এ ধরনের কর্ম-বিরতির সুযোগে অকৃত্রিম প্রকৃতির কোলে বিশ্রাম ও স্বস্তির খানিকটা নিঃশ্বাস নেয়ার উপযুক্ত স্থান হল " মসুলেহ " নামের অনিন্দ্য-সুন্দর ভূ-স্বর্গ। এ গ্রামের মুক্ত ও বিশুদ্ধ বাতাসে ক্ষণিকের নিঃশ্বাসই মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সমস্ত ক্লান্তি ও শ্রান্তির ধকল। আর এ জন্যেই দেশী-বিদেশী অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন ইরানের মসুলেহ নামের নৈসর্গিক গ্রামে ।

মসুলেহ গ্রামে যেতে হলে আপনাকে ইরানের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত গিলান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর "রাশ্ ত" থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে ফুমান এবং এরপর আরো ৩৫ কিলোমিটার ঘন ও সবুজ বনানীতে ভরা পাহাড়ী অঞ্চল অতিক্রম করতে হবে। ১৬ হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত চির-সবুজ ও চির-যৌবনা এই গ্রামটি প্রায় আটশ বছরের পুরনো। হৃদয়-জুড়ানো বাতাস আর নৈসর্গিক সবুজের সমারোহ ছাড়াও এ গ্রামের পুরনো বাড়ী-ঘর ও প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন আপনার পুরো সফরকে করবে চির-স্মরণীয় এবং সুখময় স্মৃতিতে ভরপুর।

কাস্পিয়ান সাগর-তীরবর্তী অঞ্চলের একটি নদী-বিধৌত এলাকা মসুলেহ গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অন্যতম বাড়তি আকর্ষণ। "মসুলেহ-দা'গ" নামের একটি দূর্গের কাছে তিন হাজার ৫০ মিটার উঁচুতে রয়েছে এই স্রোতস্বিনীর উৎস-মুখ। আর মসুলেহ গ্রাম টি সাগর-বক্ষ থেকে এক হাজার ৫০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এ গ্রামের সবচেয়ে উঁচু ও নীচু স্থানের মধ্যে পার্থক্য ১২০ মিটার। পাহাড়ের খাড়া ঢালের মধ্যে এ গ্রামের ঘর-বাড়ীগুলো স্থাপত্য-শৈলীর নজীরবিহীন নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে এখানকার পথ-ঘাট ও অলি-গলি এসব বাড়ীর ছাদের ওপর নির্মিত হয়েছে। এসব পথ-ঘাটের সাথে যুক্ত রয়েছে পাথরের সিঁড়ি যা পুরো এলাকার মনোহর দৃশ্যে সৃষ্টি করেছে ঐকতান।

ইরানের মসুলেহ গ্রামের অধিকাংশ বাড়ী-ঘর দোতালা। একতলা বা তিন-তলা বাড়ী খুব কমই দেখতে পাবেন। এসব বাড়ী-ঘরের স্থাপনায় রয়েছে ভবনের বাহির থেকে মূল ভবনের দরজা পর্যন্ত বিস্তৃত দেয়াল বা ছাদযুক্ত পথ, উপরের তলায় ওঠার জন্য বড় সিঁড়ি, বাইরের বৈঠক-খান<