ডিসেম্বর ০৫, ২০২১ ১৮:৪০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ৬ষ্ঠ পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ২৫ থেকে ২৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

إِنَّ الَّذِینَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّیْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُمْ ﴿٢٥﴾

“নিশ্চয়ই যারা নিজেদের নিকট সৎপথ স্পষ্ট হওয়ার পর তা পরিত্যাগ করেছে, শয়তান তাদের [পাপ] কাজকে তাদের জন্য সুশোভিত করে দেখিয়েছে এবং দীর্ঘ আশা দিয়ে তাদেরকে প্রতারিত করেছে।” (৪৭:২৫)

গত আসরে দুর্বল ঈমানের অধিকারী মুনাফিক চরিত্রের মানুষদের কথা বর্ণনা করা হয়েছিল যারা কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না। কুরআনের ভাষায় তারা নিজেদের অন্তরকে তালা মেরে রেখেছে। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথ পরিত্যাগ করে তারা মূলত শয়তানকে অনুসরণ করে। শয়তান স্বাভাবিকভাবেই তার মন্দ ও পাপকাজগুলোকে তার জন্য সুশোভিত করে দেখায় এবং এরপর আরো পাপকাজ করতে তাকে প্রলুব্ধ করে। এ ধরনের মানুষ নিজেদের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্য এমন সব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে যা তাদেরকে প্রতিদিন একটু একটু করে সৎপথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং এক সময় সৎপথে ফিরে আসা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মুনাফিকরা নিজেদেরকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও স্মার্ট মনে করলেও কুরআনের দৃষ্টিতে তারাই কুপমন্ডুক ও প্রতিক্রিয়াশীল। তারা আলোকিত পথ ত্যাগ করে অন্ধকার জগতে ফিরে গেছে।

২- শয়তানের প্রতারণায় পা দিলে মানুষের ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  আর শয়তানের পথে অটল থাকলে মানুষ সৎপথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং চরম খারাপ পরিণতির শিকার হয়।

৩- এলম বা সত্য জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয় বরং আমলও জরুরি। সেইসঙ্গে শয়তানের ধোঁকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রবল মানসিকতা থাকতে হবে।

৪- খারাপ কাজ ভালো লাগলে বুঝতে হবে আমরা শয়তানের ধোঁকায় পড়েছি।

সূরা মুহাম্মাদের ২৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

ذَلِکَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِینَ کَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِیعُکُمْ فِی بَعْضِ الأمْرِ وَاللَّهُ یَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ ﴿٢٦﴾

“এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে ওরা (অর্থাৎ রুগ্ন আত্মার অধিকারীরা) বলে, অচিরেই আমরা কোনো কোনো বিষয়ে তোমাদের অনুগত্য করব। অথচ আল্লাহ্‌ তাদের গোপন অভিসন্ধিসমূহ জানেন।” (৪৭:২৬)

কাফিরদের সঙ্গে মুনাফিকদের সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করে এই আয়াতে বলা হচ্ছে: মদীনার মুনাফিকরা সেখানকার ইহুদিদের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার চুক্তিতে আবদ্ধ হতো। যেসব বিষয়ে তাদের যৌথ স্বার্থ ছিল সেসব বিষয়ে তারা মুসলমানদের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিত। এই মৈত্রীর বন্ধনকে তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদের কাছে গোপন রাখত। কিন্তু কুরআনে কারিমের এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা মহান আল্লাহ প্রকাশ করে দেবেন যাতে মানুষ তাদেরকে চিনে রাখতে পারে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মুসলিম সমাজের কিছু মানুষ তাদের শত্রুদের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক বজায় রাখে। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও শত্রুর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মুসলিম সমাজের ক্ষতি করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

২- শত্রুদের সঙ্গে মুনাফিকদের সম্পর্ক গোপনে হয়। কাজেই এই সম্পর্কের রহস্য উন্মোচন করার জন্য মুসলিম সমাজের দায়িত্বশীলদেরকে সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩- মানুষকে একথা মনে রাখতে হবে যে, তার সব গোপন কাজ ও অভিসন্ধি আল্লাহ তায়ালা ভালো করে জানেন। মানুষ যদি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে তাহলে সে যেন অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা থেকে বিরত থাকে।

সূরা মুহাম্মাদের ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

فَکَیْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلائِکَةُ یَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ ﴿٢٧﴾ ذَلِکَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَکَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ ﴿٢٨﴾

“সুতরাং কেমন হবে তাদের দশা যখন ফেরেশতারা তাদের চেহারা ও পৃষ্ঠাদেশে আঘাত করতে করতে তাদের প্রাণ হরণ করবে?” (৪৭:২৭)

“এটা এজন্যে যে, তারা এমন সব বিষয় অনুসরণ করেছে যা আল্লাহর ক্রোধ সৃষ্টি করেছে এবং তারা তাঁর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করেছে; সুতরাং আল্লাহও তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।” (৪৭:২৮)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই দুই আয়াতে পার্থিব জগতে মুনাফিকদের শেষ পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: তাদের মৃত্যু হবে অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে। যেসব ফেরেশতা প্রাণ হরণ করার দায়িত্বে আছে তারা প্রথমে তাদেরকে আজাব দেবে এবং তারপর তাদের জান কবজ করবে। এ ধরনের মৃত্যু তাদের কৃতকর্মের ফল। এর কারণ হচ্ছে যেসব কাজ করলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন তারা সেসব কাজ করেনি বরং তিনি যেসব কাজে ক্ষুব্ধ হন শুধু সেসব কাজই করে বেড়িয়েছে।

জীবনের নানা পর্যায়ে আমরা অনেক সময় দু’টি পথের সামনে এসে আটকে যাই এবং এগুলোর যেকোনো একটি পথকে বেছে নিতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ এ সময় তাদের খেয়ালখুশি মতো এবং পার্থিব স্বার্থ রক্ষা করে তাদের পথ বাছাই করে। কিন্তু পবিত্র কুরআন বলছে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে মুমিন ব্যক্তি পার্থিব স্বার্থ ও নিজের চিত্তকে প্রশান্ত করার পরিবর্তে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি যে পথে হয় সে পথ বেছে নেয়। মুমিন ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করে না যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট বা ক্ষুব্ধ হন।  তারা নিজেদের খেয়াল খুশি দমন করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় না বরং এটি তার পার্থিব জীবনের সমাপ্তি মাত্র। জন্মের সময় মাটির মানুষকে যে প্রাণ দেয়া হয়েছিল ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে তা কেড়ে নেয়।

২- মুনাফিক ও দ্বৈত চরিত্রের মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত কষ্টের হয়।

৩- মানুষ যেকোনো কাজ করা বা জীবনের লক্ষ্য ঠিক করার ক্ষেত্রে স্বাধীন; তবে তাকে এর পরিণতির কথা বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিলে তার পরিণতি ভালো হবে এবং আল্লাহর ক্রোধ সঞ্চারণকারী কাজ করলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত খারাপ।

৪- যেকোনো কাজ মানুষের দৃষ্টিতে যত ভালোই হোক না কেন তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা না হয় তাহলে তা নিষ্ফল হয়ে যাবে। এর জন্য আল্লাহর কাছে কোনো পুরস্কার থাকবে না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ