সূরা ফাতহ : আয়াত ২২-২৫ (পর্ব-৬)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ফাতহ 'র ৬নং পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ২২ থেকে ২৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلَوۡ قَٰتَلَكُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَوَلَّوُاْ ٱلۡأَدۡبَٰرَ ثُمَّ لَا يَجِدُونَ وَلِيّٗا وَلَا نَصِيرٗا (22) سُنَّةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِي قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلُۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ ٱللَّهِ تَبۡدِيلٗا (23)
“আর যদি কাফেররা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে তারা অবশ্যই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, তারপর তারা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।” (৪৮:২২)
“এটাই [অর্থাৎ মুমিনদের সাহায্য করা ও কাফিরদের পরাজিত করা] আল্লাহর বিধান— যা পূর্ব থেকেই চলে আসছে, আপনি আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবেন না।” (৪৮:২৩)
গত কয়েক আসরে আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধি নিয়ে আলোচনা করেছি। মক্কার মুশরিক সর্দার এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে এ সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ সময় কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদের এই বলে ভর্ৎসনা করছিল যে, তোমরা নিজেদের দুর্বলতার কারণে এই সন্ধি চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছো। যদি হুদায়বিয়ায় যুদ্ধ হতো তাহলে তোমরা পরাজিত হতে। এই দুই আয়াতে ওই ভর্ৎসনার বিপরীতে মুসলমানদের মানসিক শক্তি যোগানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই বরং এসব বাতুলতা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে যখন ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ পার্থিব স্বার্থ, বিভক্তি ও মতপার্থক্য পেছনে ফেলে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্য করে তখন আল্লাহর বিধান হচ্ছে, তিনি এমন ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় দান করবেন।
বদর ও আহযাবের যুদ্ধে আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে। ওই দুই যুদ্ধে হাতে গোনা কয়েকশ’ ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর সাহায্য নিয়ে মুশরিকদের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- যে ব্যক্তি আল্লাহকে অস্বীকার করে সে প্রকৃতপক্ষে নিজেকে আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত করে এবং তাঁর অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে বের করে নেয়।
২- মিথ্যার ওপর সত্যকে এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে মুমিনদেরকে বিজয়ী করা আল্লাহ তায়ারার সুস্পষ্ট বিধান।
৩- আল্লাহর বিধানের কার্যকারিতা স্থান, কাল ও পাত্রের ঊর্ধ্বে। কাজেই এই বিধান সময়ের বিবর্তনে কখনো পুরনো হয়ে যায় না।
সূরা ফাতহ ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَهُوَ ٱلَّذِي كَفَّ أَيۡدِيَهُمۡ عَنكُمۡ وَأَيۡدِيَكُمۡ عَنۡهُم بِبَطۡنِ مَكَّةَ مِنۢ بَعۡدِ أَنۡ أَظۡفَرَكُمۡ عَلَيۡهِمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرًا (24) هُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَصَدُّوكُمۡ عَنِ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَٱلۡهَدۡيَ مَعۡكُوفًا أَن يَبۡلُغَ مَحِلَّهُۥۚ وَلَوۡلَا رِجَالٞ مُّؤۡمِنُونَ وَنِسَآءٞ مُّؤۡمِنَٰتٞ لَّمۡ تَعۡلَمُوهُمۡ أَن تَطَُٔوهُمۡ فَتُصِيبَكُم مِّنۡهُم مَّعَرَّةُۢ بِغَيۡرِ عِلۡمٖۖ لِّيُدۡخِلَ ٱللَّهُ فِي رَحۡمَتِهِۦ مَن يَشَآءُۚ لَوۡ تَزَيَّلُواْ لَعَذَّبۡنَا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡهُمۡ عَذَابًا أَلِيمًا (25)
“আর তিনিই [হুদায়বিয়ায়] তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর মক্কার ভেতরেও তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের থেকে নিবারিত করেছেন। আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।” (৪৮:২৪)
“তারাই তো কুফরী করেছিল এবং বাধা দিয়েছিল তোমাদেরকে মসজিদুল হারামে [প্রবেশ করা] হতে ও তোমরা কুরবানীর জন্য যে পশুগুলো নিয়ে এসেছিলে তা কুরবানীর স্থানে পৌঁছাতে। আর যদি [মক্কায়] মুমিন পুরুষরা ও মুমিন নারীরা না থাকত, যাদের সম্পর্কে তোমরা জান না যে, তোমরা অজ্ঞাতসারে তাদেরকে পদদলিত করবে, ফলে তাদের কারণে তোমরা অপরাধী ও দোষী সাব্যস্ত হতে, [তবে অবশ্যই আমি মক্কায় হামলার অনুমতি দিতাম। কিন্তু আমি তোমাদেরকে তখন এর অনুমতি দেইনি] যাতে আল্লাহ যাকে ইচ্ছে নিজ অনুগ্রহে প্রবেশ করান। যদি [মুমিন ও মুশরিকরা] পৃথক হয়ে থাকত, তবে অবশ্যই আমি মক্কার অধিবাসীদের মধ্যে কাফিরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিতাম।” (৪৮:২৫)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই দুই আয়াতে হুদায়বিয়া সন্ধির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে- তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের বিজয় যা অর্জিত হয়েছিল কোনোরকম যুদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়াই। কারণ, যদিও তোমরা তাদের ভূখণ্ডে অবস্থান করছিলে এবং মুশরিকরা ইচ্ছা করলেই তোমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলতে পারত কিন্তু রাসূলের হাতে হাত রেখে তোমাদের বায়াত গ্রহণের পর তাদের অন্তরে এমন ভীতির সঞ্চার হয়েছিল যে, তারা নিজেরাই শান্তির প্রস্তাব দিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিষয় হলো- তখনও মক্কা শহরে কিছু মুসলমান বসবাস করছিলেন যারা নানা কারণে হিজরত করে মদীনায় যেতে পারেননি। যদি আল্লাহ তায়ালা মক্কায় হামলার নির্দেশ দিতেন তাহলে তোমাদেরকে সেসব মুসলমানদের ওপরও হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে হতো। কারণ, যুদ্ধের মধ্যে মুশরিকদের থেকে মুসলমানদের পৃথক করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না এবং এজন্য তোমাদের আজীবন ধিক্কার শুনতে হতো।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কখনও কখনও সন্ধি বিজয়ের সমতুল্য হয়। অবশ্য সেটি তখনই সম্ভব হবে যখন সমাজের প্রজ্ঞাবান ও ঈমানদার নেতারা সার্বিক দিক বিবেচনায় শান্তি প্রতিষ্ঠাকে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ বলে মনে করবেন।
২- মক্কা শহর শুধুমাত্র এই শহরের অধিবাসীদের জন্য নয়। আল্লাহর ঘর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে কেউ যদি এই নগরীতে প্রবেশ করতে চায় তাহলে তাকে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই।
৩- যুদ্ধের সময় নিরপরাধ ও বেসামরিক নাগরিকদের জীবন বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে। শত্রুর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্বিচারে যা খুশি তাই করা বা যাকে খুশি তাকে হত্যা করা যাবে না।
৪- সব সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে শত্রু কোনো অজুহাত খুঁজে না পায়। মুসলমানদের বদনাম হতে পারে বা পরবর্তীতে তাদেরকে লজ্জার মধ্যে পড়তে হতে পারে এমন কোনো কাজ করা যাবে না।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।