আসমাউল হুসনা (পর্ব-৫৯)
মানুষ দুনিয়ার বুকে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। তবে আল্লাহর যোগ্য প্রতিনিধি হতে হলে তাঁর নামগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখতে হবে। এইসব পবিত্র নাম কেবল একটি শব্দ নয় বরং ব্যাপক অর্থবোধক বিষয়।
বিভিন্ন সময়ে বিচিত্রময় এইসব নামের প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠে। মহান আল্লাহর এমনই দুই সুন্দর নাম হল 'মুহ্য়ি' ও 'মুমিত' । আজ আমরা এ দুই নামের অর্থ ও ব্যাখ্যা নিয়ে কথা বলব। পবিত্র কুরআনের কোনো কোনো আয়াতে বিপরীতধর্মী অর্থের এ দুই নাম একইসঙ্গে বা পাশাপাশি এসেছে।
'মুহ্য়ি' নামের অর্থ কোনো শর্ত ছাড়াই মৃতকে জীবিতকারী বা জীবন দানকারী ও মুমিত নামের অর্থ জীবিতকে মৃত্যু দানকারী। মহান আল্লাহ 'মুহ্য়ি' হিসেবে গাছপালা, পশু-পাখি, মানুষ, জিন ও ফেরেশতাসহ সব জীবের জীবন দানকারী।
আল্লাহই সব জীবকে জীবন্ত রাখেন। সুরা রুম-এর ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: আল্লাহ হচ্ছেন তিনিই যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, এরপর তিনিই তোমাদের রিজিক দান করেন। এরপর তিনি তোমাদের মৃত করেন ও অতঃপর তিনি তোমাদের মৃত অবস্থা থেকে জীবন্ত করেন।–
হায়াত শব্দটির মাধ্যমে জীবন বা জীবিত থাকাকে বোঝানো হয় যা মউত বা মৃত্যু শব্দের বিপরীত। পবিত্র কুরআনে হায়াতকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে: পার্থিব বা ইহকালীন জীবন ও পারলৌকিক জীবন। প্রথম ভাগে জন্মের পর মৃত্যু পর্যন্ত সময়কালই হল হায়াত যা মানুষ ও অন্যান্য জীব-জন্তুরও রয়েছে। তাই এ জীবনকে প্রাণীজগতের জীবনও বলা হয়।
মহান আল্লাহর মুহ্য়ি নামের অর্থ জীবন্তকারী। আর তা কেবল পার্থিব জীবনেই সীমিত নয় বরং তা আধ্যাত্মিক জীবনেও বিস্তৃত। যেমন, সুরা আনফালের ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর, যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। জেনে রেখো, আল্লাহ মানুষের এবং তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। বস্তুত: তোমরা সবাই তাঁরই কাছে সমবেত হবে।–
এখানে যে জীবন বা হায়াতের কথা বলা হয়েছে তা মানুষের সাধারণ হায়াত নয়। আয়াতুল্লাহ শহীদ মুতাহ্হারির মতে এই আয়াতে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: জীবিত ও মৃত এবং পবিত্র কুরআনকে জীবনের উৎস ও মহানবীকে (সা) জীবন্তকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে মহানবী-সা তোমাদের জন্য জীবন ও হায়াত বা আয়ু নিয়ে এসেছেন। তোমরা যে এখন মরে আছ তা তোমরা বুঝতে পারছ না। তাই তোমাদের উচিত এই আধ্যাত্মিক চিকিৎসকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা যাতে তোমরা দেখতে পার যে তিনি তোমাদের কিভাবে জীবন দান করেন।
মানুষ তো এমন নয় যে পশু পাখির মত একবার মরে যাওয়ার পর আর জীবিত হবে না। সুরা আনআমের ১২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
আর অজ্ঞতা ও শিরকের কারণে যে মৃত ছিল অতঃপর আমি তাকে সুপথ দেখানোর মাধ্যমে জীবিত করেছি এবং তাকে এমন একটি আলো বা ঈমান দিয়েছি, যা নিয়ে সে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে। সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে, যে অন্ধকারে তথা বিশ্বাসগত ও কর্মগত বিচ্যুতির মধ্যে থাকায় সেখান থেকে বের হতে পারছে না? এমনিভাবে কাফেরদের দৃষ্টিতে তাদের কাজকর্মকে সুশোভিত করে দেয়া হয়েছে।– এখানে মুমিনের জীবন ও অবিশ্বাসীর মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে উভয়ই জীবিত। মুমিন পার্থিব জীবনের ঊর্ধ্বে এক ধরনের উন্নত জীবনের অধিকারী। আর অবিশ্বাসীরা সেই উন্নত জীবনের অধিকারী নয় বলে মৃত। অন্য কথায় পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে কাফিরদের মোকাবেলায় একত্ববাদে বিশ্বাসীরা জীবন্ত এবং আধ্যাত্মিক ও পবিত্র জীবনের অধিকারী।
সুরা ইয়াসিনের ৭০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
তিনি তথা রাসুল কুরআনের মাধ্যমে সতর্ক করেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুহ্য়ি বা জীবন্তকারীর বিশেষ ভূমিকা সম্পর্কে সুরা নাহ্ল্-এর ৯৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন বা হায়াত দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে অবশ্যই তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত।
-এ আয়াত থেকেও স্পষ্ট যে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন নির্ভর করে ঈমান ও সৎ কাজের ওপর। অবশ্য ঈমান ও সৎ কর্মের মাত্রা অনুযায়ী মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনেরও রয়েছে নানা স্তর।
মহান আল্লাহর মুমিত নামের অর্থ জীবিতকে মৃত্যু দানকারী। কোনো কিছু যখন শক্তি হারিয়ে ফেলে তখন তাকে মৃত বলা হয়। জীবনের পরই মৃত্যুর প্রশ্ন আসে। মহান আল্লাহ মানুষকে জীবন ও মৃত্যু দেন। জীবন্ত সব কিছুর জীবন ও মৃত্যু দানকারী হলেন মহান আল্লাহ।
মানুষের মৃত্যুও দুই ধরনের। শারীরিক ও আধ্যাত্মিক মৃত্যু। মানুষ যখন তার বিবেক বা সত্তাগত প্রকৃতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাপ, অনাচার ও জুলুমে মত্ত হয় তখন সে সত্য পথ হারিয়ে আধ্যাত্মিক মৃত্যুর শিকার হয়। তাই প্রকৃত মুমিন জীবন ও মৃত্যুকে মহান আল্লাহর পরীক্ষা বলে মনে করেন ও পার্থিব জীবনকে সংক্ষিপ্ত বলে মনে করেন। মহান আল্লাহ মুমিত হিসেবে সব জীব ও প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করান। তাই মুমিন আধ্যাত্মিক জীবন অর্জনে সচেষ্ট থাকেন এবং কখনও আধ্যাত্মিক মৃত্যুর শিকার হতে চান না।-
হযরত ইব্রাহিম নবী জানতে চেয়েছিলেন কিভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করবেন। তখন মহান আল্লাহ ইব্রাহিম (আ)কে চারটি পাখি জবাই করে সেগুলোর গোশত, হাড় ও চামড়াকে খিচুড়ির মত গুলিয়ে ফেলতে বলেন। এরপর সেসবের কিছু অংশ কয়েকটি পাহাড়ের ওপর রেখে এসে সেগুলোকে কাছে আসার আহ্বান জানাতে বলেন। সেগুলো খুব দ্রুত জীবন্ত হয়ে তাঁর দিকে আসে। অবশ্য খোদাদ্রোহী মহাজালিম নমরুদ বলেছিল সেও মানুষকে মৃত্যু ও জীবন দান করতে পারে। সে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশপ্রাপ্ত একজনকে মুক্তি দিয়ে ও নিরপরাধ এক ব্যক্তিকে হত্যা করে এই দাবি জানায়। অথচ মানুষকে নতুন সৃষ্টি হিসেবে অনস্তিত্ব থেকে জন্ম দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না, কিংবা মৃত ব্যক্তিকে আবারও জীবিত করার ক্ষমতাও তার ছিল না। জীবন দান ও মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই রয়েছে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।