রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-৯)
একটি বছর পরে আবার/কুল মুসলিম বিশ্ব ধরায় সিয়ামের মাস এলো রমজান/আব হায়াতের শান্তি সুধায়। আত্ম অহং চিত্তদহন/বিনয় নম্র সংযমী মন। কুল রোজাদার সব কে-খোদা/খাস রহমতের শিরনী বিলায়। (কবি সাবির আহমদ চৌধুরী)
রমজান ও রোজা সম্পর্কে ইসলামের মহান ইমাম বা মহাপুরুষদের কয়েকটি অমর বাণী শুনিয়ে শুরু করব আজকের মূল আলোচনা। সব কিছুরই যাকাত রয়েছে এবং দেহের যাকাত হচ্ছে রোজা রাখা। দেহের পুষ্টি হ'ল খাদ্য নিজে খাওয়া, আত্মার পুষ্টি হ'ল অন্যকে খাওয়ানো। অন্তরের রোজা, জিহ্বার রোজার চেয়েও উত্তম এবং জিহ্বার রোজা, পেটের রোজার চেয়েও উত্তম। আত্মার রোজার অর্থ হচ্ছে পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে সমস্ত পাপ থেকে বিরত রাখা এবং সমস্ত মন্দ উদ্দেশ্য থেকে হৃদয়কে খালি করা। মানুষ খোদার প্রেমে কতটা আন্তরিক তার পরীক্ষা হয়ে যায় রোজার মাধ্যমে। দুনিয়ার আনন্দ বর্জন করা হচ্ছে আত্মার রোজা, এই রোজাই হচ্ছে সবচেয়ে উপকারী রোজা। নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ অন্যকে খাদ্য খাওয়ানো বা ইফতারি দেয়াকে এবং আল্লাহর পথে রক্ত ঝরানোকে পছন্দ করেন। হৃদয়ের রোজা হচ্ছে নিজের পাপ সম্পর্কে চিন্তা করা, এ রোজা পেটের রোজার চেয়েও উত্তম। রোজা তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে, কারণ এটি কামনার শেকড়কে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং পশুত্বকে দূর করে দেয়।
নিজেকে ক্ষুধার্ত রাখাই সর্বাধিক উপকারী নিরাময়, অন্যদিকে পেটপুরে খাওয়ার ফলে রোগব্যাধি বেড়ে যায়। হযরত ফাতিমা তুজ-জাহরা (আ) বলেছেন, আল্লাহ রোযাকে ফরয করেছেন, তাঁর প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা আরও দৃঢ় করার জন্যে।
ঈমান মানে কেবল মৌখিক স্বীকৃতিই নয়, যদি তা-ই হত তাহলে রোজা ও নামাজ আদায় এবং হালাল-হারাম মেনে চলার সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক থাকত না।
যে ব্যক্তি কোন সহকর্মী মুসলিম পুরুষ বা মহিলাকে গীবত করে, আল্লাহ তায়ালা চল্লিশ দিন ও রাত পর্যন্ত তাঁর প্রার্থনা ও রোযা কবুল করেন না, যতক্ষণ না যে তার গীবতের শিকার সে তাকে ক্ষমা করে না দেয়।
পাপের একটি বড় কারণ হল অজ্ঞতা। তাই অজ্ঞতা দূর করার জন্য জ্ঞান অর্জন জরুরি। গোনাহ'র রয়েছে নানা ধরন। ব্যক্তিগত পাপের চেয়ে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক পর্যায়ের পাপ বেশি মারাত্মক। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাপ ও কুপ্রথা চালু করা হলে তার প্রভাব হয় অনেক সুদূর-প্রসারী। কোনো কোনো পাপ এমন যে তার প্রভাব হাজার হাজার বছর ধরে অব্যাহত থাকে। যেমন, ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্ম এক সময় একটি ঐশী তথা সত্য ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও একদল জ্ঞানপাপী এই ধর্ম দু'টির মধ্যে এমন বিকৃতি এনেছে যে হাজার হাজার বছর ধরে শত শত কোটি মানুষ সেই বিচ্যুতি হতে মুক্ত হতে পারছে না। এ ধরনের পাপের হোতা ওই জ্ঞানপাপীরা ছিল মূলত শয়তানেরই শাগরেদ। তারা প্রকৃত ধর্মীয় নেতাদের আসন দখল করেছিল ছলে-বলে কৌশলে।
পাপ হতে দূরে থাকতে ও আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে অধ্যবসায় অত্যন্ত জরুরি। তবে এই প্রচেষ্টা শুরু করা উচিত যৌবনের প্রারম্ভেই। এ প্রসঙ্গে মরহুম ইমাম খোমেনী সত্য-সন্ধানী যুব বয়সীদের উদ্দেশে বলেছেন:
মানুষ যখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়, তখন অন্তরকে প্রকৃত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন। আল্লাহ না করুন, যদি আত্মশুদ্ধি না করেই দুনিয়া ত্যাগ করো, তাহলে কিভাবে খোদার সামনে দাঁড়াবে, যেখানে তোমার অন্তরটা কালো হয়ে গিয়েছে, চোখ-কান-জিহবা পাপে কলুষিত হয়ে গিয়েছে? যে জিনিস পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ অবস্থায় তোমাকে দেয়া হয়েছিলো, আস্থা ভঙ্গ করে তাকে কলুষিত করে কিভাবে সেটা আল্লাহর কাছে ফেরত দেবে? এই চোখ, কান, যা তোমার নিয়ন্ত্রণাধীন, এই হাত, এই জিহবা, যা তোমার আদেশ মেনে চলছে, শরীরের এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ– এগুলো সবই তোমার কাছে সর্বশক্তিমান খোদার আমানত, আর এগুলো তোমাকে দেয়া হয়েছিলো শতভাগ পবিত্র, বিশুদ্ধ অবস্থায়। এগুলো দিয়ে পাপকর্ম করলে তা অবিশুদ্ধ, কলূষিত হয়ে যায়। আল্লাহ না করুন, এগুলো যদি নিষিদ্ধ কর্মের কারণে কলুষিত হয় তাহলে আমানত ফেরত দেবার সময় হয়তো জিজ্ঞাসা করা হবে যে, আমানতের জিনিস কি এভাবেই রক্ষা করতে হয়? যে দৃষ্টি ও অন্তর তোমার কাছে আমানত রাখা হয়েছিল এবং তোমার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যাকে তোমার ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়েছিলো, সেগুলো কি এরকম নোংরা আর কলুষিত ছিল? আমানতের এত বড় খেয়ানত করে কিভাবে খোদার সামনে দাঁড়াবে? মহান আল্লাহ আমাদেরকে বৃদ্ধ হওয়ার আগেই আত্মশুদ্ধি অর্জনের তৌফিক দিন।

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।