এপ্রিল ২০, ২০২২ ১৭:১৩ Asia/Dhaka

এখনো সে পুণ্য রাত্রি নামে পৃথিবীতে, কিন্তু প্রাণ এক অন্ধকার ছেড়ে অন্য এক আঁধারে হারায়, ঊর্ধ্বের ইঙ্গিত আসে লক্ষ মুখে, অজস্র ধারায়; নর্দমার কীট শুধু পাপ-পঙ্কে খোঁজে পরিত্রাণ। .... আত্মার প্রশান্তি গ্রাস করে ছায়া উদ্ভ্রান্ত মতের; সে আজ দেখাতে রাহা এ সংশয়ে,... শবেকদরের কত অপলক দৃষ্টি জাগে আজও যে পথ-সন্ধানে; জুলমাতের এলাকায় বলে দাও নিঃসঙ্গ খিজির।’-ফররুখ

পবিত্র রমজান দোয়া ও মুনাজাতের শ্রেষ্ঠ মাস যা আত্মশুদ্ধির অন্যতম বড় চাবিকাঠি। তাই গত পর্বের আলোচনায় আমরা দোয়া কবুল হওয়ার কয়েকটি শর্ত ও দোয়া কবুল না হওয়ার নানা কারণ সম্পর্কে কিছু কথা বলেছি। আজও এ বিষয়ে কিছু কথা বলব। দোয়া কবুল হওয়ার আরেকটি শর্ত হল দোয়া করেই বসে থাকলে চলবে না। বরং তাকে ঐ লক্ষ্য প্রতিফলিত হওয়ার উপযুক্ত কর্ম ও প্রচেষ্টা চালতে হবে। কেননা মহান আল্লাহ তার এ প্রচেষ্টার মধ্যেই বরকত ও রহমত দিবেন। তাই কেউ যদি দোয়া করেই অলসভাবে বসে থাকে তাহলে আল্লাহ তার দোয়া কবুল করবেন না। এ প্রসঙ্গে ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) বলেন:

“‘চার ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না এদের প্রথম ব্যক্তি হল যে নিজ ঘরে বসে থেকে বলে প্রভু আমাকে জীবিকা দান কর; প্রভু তাকে বলেন: আমি কি তোমাকে নির্দেশ দেইনি যে তুমি তার সন্ধানে যাবে?' [আল ক্বাফী ২খন্ড, ৫১১ পৃঃ]

দোয়া কবুল না হওয়ার আরো একটি কারণ হল উক্ত বিষয়ে তার জন্য ক্ষতির কারণ থাকতে পারে। কেননা আমরা মহান প্রভুর কাছে অনেক কিছু আবেদন করে থাকি কিন্তু তার প্রতিফল সম্পর্কে আমরা অবগত নই। অনেক সময় আমরা এমন কিছু আবেদন করি যা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারার ২১৬ নম্বর আয়াতে বলেন: তোমাদের কাছে হয় তো একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। আর হয় তো বা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তা তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।

 ‘সালাবেহ্ বিন হাতেব মহানবী (সঃ)-এর কাছে এসে অনুনয় বিনয়ের সাথে বলল, আমার জন্য দোয়া করেন যাতে আমি একজন ধনী ব্যক্তি হতে পারি। সে মহানবী (সঃ)-এর সাথে অঙ্গিকার করেছিল যে, সে ধনী হ’লে কখনো সীমালঙ্ঘন করবে না। কিন্তু মহানবী (সঃ)-এর দোয়ার পর যখন সে সম্পদশালী হ’য়ে গেল তখন সে মহানবীকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি কেবল ভঙ্গই করেনি বরং সে যাকাত প্রদানের মত একটি ফরয দায়িত্ব থেকেও বিরত থাকে। [ সিমায়ে শিয়া, ৪৮৫পৃ.] 

লাইলাতুল ক্বাদ্‌র বা পবিত্র শবে ক্বদর রমজানের প্রাণ বা সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। অনেকেই মনে করেন আজকের রাত তথা ১৮ রমজানের দিবাগত রাতটি পবিত্র শবে ক্বদর। বিশেষ করে, আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.) ১৯ রমজানের রাতে মহাপাপিষ্ঠ ইবনে মুলজেমের তরবারির আঘাতে আহত হন এবং ২১ রমজান শাহাদত বরণ করেন বলে এ দুই রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে অনেকেই মনে করেন। অনেকে ২৩ রমজানের রাতকেই শবে কদর বলে মনে করেন। আবার অনেকে ২৭ রমজানকে শবে কদর বলে মনে করেন। রমজানের শেষ দশ দিনের যে কোনো বেজোড় রাতই কদরের রাত হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন এবং তারা এইসব রাতেই বেশি বেশি ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত ও ইসলামী জ্ঞান চর্চা করেন।

ঠিক কোন্ রাতটি শবে কদর তা আল্লাহর পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের জন্য গোপন রাখার রহস্য হল মানুষ যেন রমজানের এই রাতগুলোতে বেশি বেশি খোদামুখি হয় এবং আল্লাহর ইবাদত করে। বলা হয় যে মানুষ সারা বছর কতটা সৌভাগ্য অর্জন করবে তা নির্ধারণ করা হয় কদরের রাতে। এই রাতের ইবাদত এক হাজার মাসের ইবাদতের সমান।

পাপীদের জন্য কদরের রাত তওবা করার ও গোনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার অতি মোক্ষম সময়। আর যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা এই রাতে তাঁর আরও প্রিয় হওয়ার এবং আল্লাহর আরও বেশি সন্তুষ্টি অর্জনের একনিষ্ঠ সাধনার পুরস্কার পান। যারা আল্লাহর অতি-নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা বা আল্লাহর ওলি তারা এই রাতে ফেরেশতাদের অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি দেখতে পান। এমন পবিত্র রাত যেন বৃথা না যায় সেজন্য সবারই সচেষ্ট হওয়া উচিত। সারা বছর জুড়ে এমন পাপ ও মহাপাপে জড়িত হওয়া উচিত নয় যাতে এমন রাতেও সেই পাপের কলঙ্ক মোচন করা না যায়। রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দেয়া হচ্ছে এমনই এক মহাপাপ যার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি বা ক্ষমা শবে কদরের মত রাতেও অর্জন করতে পারে না। 

আজ ১৮ রমজান শেষ হয়ে ১৯ তম রমজান শুরু হতে যাচ্ছে। আজ হতে ১৪০৩ চন্দ্র-বছর আগে ৪০ হিজরির এই দিনে তথা ১৮ ই রমজানের দিন শেষে ১৯ রমজানের ভোর বেলায় ইবনে মোলজেম নামের এক ধর্মান্ধ খারেজি ফজরের নামাজে সেজদারত আমীরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আঃ)'র মাথায় বিষ-মাখানো তরবারি দিয়ে আঘাত হানায় দুই দিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। এ ঘটনা ঘটেছিল কুফার গ্র্যান্ড মসজিদে।

আলী (আ.) সর্বত্র প্রকৃত ইসলাম ও ন্যায়-বিচার কায়েমের তথা সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই সুবিধাবাদী, মুনাফিক এবং স্বল্প-জ্ঞানী ধর্মান্ধ ও বিভ্রান্ত শ্রেণীগুলো তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন, তিনি খিলাফত লাভের পর সব সাহাবির জন্য সরকার-প্রদত্ত ভাতা সমান করে দিয়ে রাসূল (সা.) সুন্নাত পুন:প্রবর্তন করেছিলেন। ফলে অনেকেই তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়। হযরত আলী (আ.) জানতেন সত্যের পথে অবিচল থাকলে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও নেতা তাঁকে ত্যাগ করবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ন্যায়-বিচারের পথ ত্যাগ করেননি। ফলে শাহাদতের উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন হযরত আলী (আ.)।

একবার শাবান মাসের শেষ শুক্রবারে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্বনবী (সা.) ভাষণের শেষ পর্যায়ে কাঁদতে থাকেন। তা দেখে হযরত আলী (আ.) এর কারণ জানতে চান। জবাবে মহানবী বহু বছর পর রমজান মাসে আলী (আ.)'র মর্মান্তিক শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন,"হে আলী, এই মাসে তোমার ওপর যা নেমে আসবে সে জন্য আমি কাঁদছি। আমি নিজেকে কল্পনা করছি তোমার স্থানে যখন তুমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছ এবং সামুদ জাতির কাছে পাঠানো খোদায়ী উটের পা কর্তনকারী লোকটির মতই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটি তোমার মাথার ওপর আঘাত হানবে এবং তোমার দাড়ি তাতে (রক্তে) রঞ্জিত হবে।"

 নিজের শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শুনে সব কিছুর আগে হযরত আলী (আ.)'র মনে যে চিন্তাটির উদয় হয়েছিল তা এই বস্তু-জগত সম্পর্কিত ছিল না, বরং তা ছিল নিজের ঈমান সম্পর্কিত।  তাই তিনি প্রশ্ন করলেন: " হে আল্লাহর রাসূল! সে সময় আমি কী ঈমানের ওপর অবিচল থাকব? "রাসূল (সা.) বললেন: " হ্যাঁ, সে সময় তোমার ঈমান নিরাপদ থাকবে।"

 বিশ্বনবী (সা.) আরো বলতে লাগলেন,  "হে আলী, যে তোমাকে হত্যা করে সে (বাস্তবে) আমাকে হত্যা করল, যে তোমাকে বিরক্ত করে সে আমাকে বিরক্ত করল এবং যে তোমার অবমাননা করল সে আমার অবমাননা করল, কারণ তুমি আমার আত্মা বা প্রাণের সমতুল্য। তোমার ও আমার মানসিকতা এবং স্বভাব অভিন্ন। নিঃসন্দেহে প্রশংসিত ও গৌরবান্বিত আল্লাহ প্রথমে আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং এরপর সৃষ্টি করেছেন তোমাকে,তিনি প্রথমে বেছে নিয়েছেন আমাকে এবং এরপর বেছে নিয়েছেন তোমাকে। আল্লাহ আমাকে নবুওতের জন্য মনোনীত করেছেন, আর তোমাকে মনোনীত করেছেন ইমামতের জন্য। আর যে তোমার ইমামতকে অস্বীকার করবে সে (কার্যত) আমার নবুওতকে প্রত্যাখ্যান করল।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলতে লাগলেন,   হে আলী, তুমি আমার উত্তরাধিকারী, আমার সন্তানদের তথা নাতী-নাতনীর পিতা এবং আমার কন্যার স্বামী আর আমার উম্মতের জন্য আমার জীবদ্দশায় ও আমার মৃত্যুর পর আমার প্রতিনিধি বা খলিফা। তোমার নির্দেশ হল আমারই নির্দেশ, তোমার নিষেধাজ্ঞা হল আমারই নিষেধাজ্ঞা। সেই শক্তির শপথ করে বলছি যেই শক্তি আমাকে নবুওত দান করেছেন এবং আমাকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে তৈরি করেছেন, তুমি হচ্ছ সৃষ্টিকুলের জন্য হুজ্জাতুল্লাহ বা আল্লাহর নিদর্শন এবং তাঁর রহস্যগুলোর আমানতদার বা ট্রাস্টি ও সৃষ্টিকুলের ওপর আল্লাহর খলিফা।"

 আলী (আ.) জিহাদ থেকে ফিরে আসলে মহানবী (সা.) তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যেতেন এবং তাঁর মুখের ঘাম মুছে দিতেন নিজ হাতে। তাঁকে জিহাদ বা সফরের সময় বিদায় দিতে গিয়ে তাঁর বিজয়ের জন্য দোয়া করতেন এবং বলতেন: হে আল্লাহ, আলীর সঙ্গে এটাই যেন আমার শেষ দেখা না হয় কিংবা বলেছেন: হে আল্লাহ, আমার মৃত্যুর আগে আলীকে যেন আরো একবার দেখতে পারি । 

আলী (আ.) বলেছেন, উট-শাবক যেমন মায়ের পিছে পিছে থেকে সব সময় মাকে অনুসরণ করে আমিও শৈশব থেকেই রাসূল (সা.)-কে সেভাবে অনুসরণ করতাম। রাসূল শৈশবে আমাকে কোলে নিতেন, খাইয়ে দিতেন, ঘুম পাড়িয়ে দিতেন ও বুকে চেপে ধরতেন। রাসূলের (সা.) কাছে ওহি নাজিল হওয়ার সময় আমিও দেখতে পেতাম ফেরেশতাদের। মহানবী (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন আলী (আ.)'র কোলে মাথা রেখেই এবং তাঁকে গোসলও দেন তিনি।

আলী (আ.)-এর জীবনের শেষ রমজান মাস ছিল অন্য এক রকম রমজান। এ মাস ভিন্ন এক পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছিল। হযরত আলী(আ.) বলেছেন, মানুষ কি ভেবে নিয়েছে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না- এই আয়াত (আনকাবুত ১-২) যখন নাযিল হল তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর এ উম্মতের জন্য ফিতনা ও কঠিন পরীক্ষা আসবে। তখন রাসূলকে প্রশ্ন করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! এ আয়াতে আল্লাহ যে ফিতনার কথা বলছেন সেটা কি? তিনি বললেন : হে আলী! আমার পর আমার উম্মত পরীক্ষার সম্মুখীন হবে।

যখন হযরত আলী শুনলেন রাসূল মৃত্যুবরণ করবেন এবং তাঁর পরে কঠিন পরীক্ষা আসবে তখন ওহুদের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ওহুদের দিনে যারা শহীদ হওয়ার তাঁরা শহীদ হলেন, অথচ আমি শাহাদাত থেকে বঞ্চিত হলাম!  হযরত আলী খুবই দুঃখ পেয়ে রাসুল(সা)কে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন শাহাদাতের মর্যাদা আমার হল না? মহানবী সা তখন বলেছিলেন, যদিও এখানে শহীদ হওনি কিন্তু অবশেষে শাহাদাত তোমার ভাগ্যে ঘটবে। আলী(আ.) এ সময় পঁচিশ বছরের যুবক ছিলেন এবং এক বছর হল হযরত ফাতিহা যাহরা (সা.)-কে বিবাহ করেছেন ও এক সন্তানের জনক। এ বয়সের যুবক যখন জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখে তখন থেকেই আলী(আ.) ছিলেন শাহাদাতের প্রত্যাশী!

৪০ হিজরির ১৯ শে রমজানে যখন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষটি সিজদারত আলী (আ.) মাথায় বিষ-মাখানো তরবারির আঘাত হানে তখনই তিনি বলে ওঠেন, কাবার প্রভুর শপথ, আমি সফল!-দুধের শিশুরা যেমন মায়ের স্তনকে ভালবাসে শাহাদত ছিল তার কাছে আরও বেশি প্রিয়। ২১ রমজানের রাতে শাহাদতের কিছুক্ষণ আগেও তিনি বলেন, 'আল্লাহর শপথ! শাহাদত আমার কাছে এমন কিছু নয় যে তার সম্মুখীন হতে আমি অসন্তুষ্ট হব, বরং তা যেন আমার কাছে নিজের হারানো অস্তিত্বকে ফিরে পাবার মত আনন্দদায়ক, কিংবা আমি যেন রাতের অন্ধকারে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি খুঁজছিলাম, আর হঠাৎ তা পেয়ে গেলাম, আল্লাহর কাছে যা আছে সৎকর্মশীলদের জন্য সেটাই তো উত্তম।'

এবারে পড়া যাক অর্থসহ ১৮ রমজানের রোজার দোয়া:

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।