ইরান ভ্রমণ : (পর্ব-১১৭)
বন্দর নগরী তুর্কামান
আমরা ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় গোলেস্তান প্রদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। গত আসরে আমরা গিয়েছিলাম রমিয়ন শহরের দিকে। আজকের আসরে আমরা যাবার চেষ্টা করবো বন্দর নগরী তুর্কামানের দিকে।
সেখানে আছে সমুদ্রের কিনারাহীন রহস্য অপার।
আহা! মনের গতিতে যদি নিমেষে হওয়া যেত পার।
বন্দর তুর্কামান শহরটির আয়তন আঠারো শ' ষাট বর্গকিলোমিটার। গোরগান সমতল ভূমির পশ্চিমাঞ্চল এবং কাস্পিয়ান সমুদ্র ও গোরগান উপসাগরের পূর্বউপকূল জুড়ে এই শহরটি অবস্থিত। শহরটির উত্তরে রয়েছে তুর্কমেনিস্তান, উত্তর-পূর্বে গোম্বাদে কাবুস শহর, পূর্বে গোরগান শহর এবং দক্ষিণে অবস্থিত কোর্দকুই শহর। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য তাহলো ,পারস্য উপসাগরের পানির অবস্থান, মুক্ত পানিস্তর থেকে ২৮ মিটার নীচে। আর বন্দর তুর্কামান শহরের বিশাল অংশের উচ্চতা বিশ্বের মুক্ত পানিস্তর থেকে অনেক নীচে।
ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে বিগত কয়েক শতাব্দীতে পারস্য উপসাগরের পানির স্তরের ওঠানামা এবং সমুদ্রে তলানী জমার কারণে ঐ অঞ্চলের আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এছাড়া কাস্পিয়ান উপসাগরমুখী নদীগুলোতে অসংখ্য বাঁধ দেওয়ার কারণেও উপকূলীয় সমতল ভূমি অঞ্চলে এই পরিবর্তন দেখা দেয়। বন্দর তুর্কামান অঞ্চলের উত্তরাংশের আবহাওয়া কিছুটা মরু অঞ্চলের মতো। তবে দক্ষিণাংশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। আর এ কারণেই বন্দর তুর্কামান শহরের দক্ষিণাঞ্চলে জনবসতি তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি হয়ে উঠেছে শহরের প্রাণকেন্দ্র। বন্দর তুর্কামান শহরের ইতিহাস খুব একটা প্রাচীন নয়। এখন থেকে মাত্র আশি বছর আগেকার। শুরুতে এই শহরটি ছিল সেনানিবাস। পরে তুর্কামান উপজাতীদের এসকান গোত্রের তৎপরতা, বন্দর তুর্কামান থেকে বন্দর ইমাম খোমেনী পর্যন্ত রেল লাইন প্রতিষ্ঠিত হওয়া, জেটি নির্মাণসহ বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারী বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা এবং সেইসাথে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠার কারণে এই শহরের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
বর্তমানে বন্দর তুর্কামান মাছ শিকারের জন্যে বিখ্যাত। বিশেষ করে অশুরাদাহ দ্বীপে ফিশারী বা মাছ শিকারের সুযোগ থাকায় এই শহরের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। গোরগান উপসাগরীয় সুন্দর সুন্দর দ্বীপগুলোর মধ্যে অশুরাদেহ দ্বীপটিও একটি। অশুরাদেহ দ্বীপটিই এখানকার একমাত্র দ্বীপ স'লভূমির সাথে যার দূরত্ব তিন কিলোমিটার। বর্তমানে এই দ্বীপটিতে মাছ শিকারের জন্যে চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। দূর থেকে দ্বীপটিকে দেখতে সবুজ বাগানের মতো মনে হয়। ঠিক কবে এই দ্বীপটি আবিষকৃত হয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় নি। তবে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী খাওয়ারেযম শাসনামলে অশুরাদেহ দ্বীপটির অস্তিত্ব ছিল। তখন দ্বীপটি 'অবসুকুন' দ্বীপ নামে বিখ্যাত ছিল। জনশ্রুতি আছে যে , খাওয়ারেযমী বাদশাহ সুলতান মুহাম্মদ, চেঙ্গিয খানের সাথে যুদ্ধের সময় এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আগেই বলেছি যে বর্তমানে অশুরাদেহ দ্বীপটি মাছ শিকারের জন্যে কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যে একটি বিখ্যাত দ্বীপ। বিশেষ করে ক্যাভিয়ার উৎপাদনের জন্য এটি বিখ্যাত। ক্যাভিয়ার হলো এক ধরনের সামুদ্রিক মাছের ডিম। বেশ সুস্বাদু এই ক্যাভিয়ার। ইরান বিদেশে যে ক্যাভিয়ার রপ্তানী করে, তার বিশাল একটি অংশ এই দ্বীপে উৎপাদিত হয়। এছাড়া অশুরাদেহ দ্বীপটি এখন ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণ পিপাসুদের জন্যে দর্শনীয় একটি স্পটে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রমোদতরী এবং অসংখ্য নৌকা আছে। যার ফলে ভ্রমণকারীরা উপকূলে, কাস্পিয়ানের পূর্বাংশে এবং এখানকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে জলের ওপর দিয়ে যেতে পারে আর উপভোগ করতে পারে জলভ্রমণের চমৎকার অভিজ্ঞতা।
অশুরাদেহ দ্বীপের এইসব চমৎকৃতি ছাড়াও গুলিস্তান প্রদেশের এই বন্দর নগরীটির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো বন্দর তুর্কামানের সোমবারের বাজার এবং এখানকার ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। সোমবারের বাজারটি যথেষ্ট আকর্ষণীয়। সপ্তাহের প্রতি সোমবারে এখানে কৃষিকাজ এবং শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ বিচিত্র হস্তশিল্প সামগ্রী বেচা-কেনা হয়। সাধারণত মরুবাসী তুর্কামান উপজাতীরাই তাদের নিজেদের তৈরী হস্তশিল্প সামগ্রী এই বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গালিচা, কার্পেট, ম্যাট, গেলিম এবং সিল্কের তৈরী কাপড়। রং-বেরঙের এইসব সামগ্রী যখন বাজারে নিয়ে আসা হয়, তখন বাজারের চেহারাটাই পাল্টে যায়।
এ পর্যায়ে চলুন বন্দর তুর্কামান শহরের দক্ষিণে অবস্থিত কোর্দকুই শহরের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। কোর্দকুই শহরটির উত্তরে রয়েছে বন্দর তুর্কামান শহর এবং কাস্পিয়ান সাগর, উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে মযান্দারন প্রদেশের বেহশাহর, দক্ষিণে রয়েছে সেমনানের অন্তর্ভুক্ত আলবোর্য পর্বতমালার পূর্বাঞ্চল এবং পূর্বে রয়েছে গোরগান শহর। কোর্দকুই ছাড়াও এখানে 'বন্দর গায' নামে আরেকটি শহর আছে। এ অঞ্চলের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। বলা হয়ে থাকে যে,শাহ আব্বাস সাফাভির আমলে কুর্দিস্তানের বহু লোক পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানের মযান্দারন এবং আস্তারাবাদ এলাকায় যাযাবর হিসেবে এসে বসবাস করে। এজন্যেই এ শহরটি কোর্দকুই নামে পরিচিতি পেয়েছে। কোর্দকুই শহরটি ২৫০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কৃষিকাজ, পশুপালন, মুরগির ফার্ম ইত্যাদি এখানকার জনগণের সাধারণ পেশা।
এখানকার প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে ইটের তৈরী 'মিল রদকান' টাওয়ারের নাম করা হয়। রদকান টাওয়ারটি হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছে। দেখতে এটি কাবুস গম্বুজের মতো। কুফি অক্ষরে লেখা এখানকার শিলালিপী থেকে বোঝা যায় এই টাওয়ারটি ছিল তাবারেস্তানের একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেলের কবর এবং চার শ সাত হিজরীতে এই টাওয়ারটি নির্মাণ করা হয়। এই টাওয়ারটি ছাড়াও এখানে বেশ ক'জন ইমামযাদার মাযার আছে। যা শহরটিকে এক আধ্যাত্মিক মহিমা দান করেছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।