কেমন হয়েছে এবারের বাজেট
'বিদেশে যাওয়া খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ঘটুক!'
সম্প্রতি বাংলাদেশে নিজস্ব অর্থায়নে বিশাল বাজেটের স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তবে। দেশের মানুষ এই সেতুর উপর দিয়ে চলাচল করছে। একইসাথে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে সম্প্রতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট সংসদে পাস হলো। তো এবারের বাজেট কেমন হলো তা নিয়ে আমরা কথা বলেছি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও কলামিস্ট ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদের সঙ্গে।
তিনি এবারের বাজেট তৈরিতে বেশ মেধাবী মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়া হয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন, আমি মনে করি সামগ্রিকভাবে সময়ের প্রয়োজনের তুলনায় যথাসাধ্য শ্রম দিয়ে, চেষ্টা করে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে হ্যাঁ এই বাজেটের সার্বিক সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর।
পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব,ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পাস করা হয়েছে। তো আপনার দৃষ্টিতে কেমন হয়েছে এবারের বাজেট?
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: এবারের বাজেট গতানুগতিক অন্য বছরের তুলনায় একটু ভিন্ন ধরনের। সাধারণত অন্যান্য সময় আমরা যে বাজেট তৈরি করি সেটি সম্প্রসারণশালী হয়ে থাকে। তবে এরইমধ্যে দুই-আড়াই বছর করোনার আঘাত এবং অতি সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এবারের বাজেটটি গতানুগতিক হওয়ার কোনো অবকাশ ছিল না। এবারের বাজেটটি নিয়ে যেসব আলোচনা বা প্রক্ষেপণ যা কিছু হয়েছে সেখানে মেধাবী মুন্সিয়ানার চেষ্টা করা হয়েছে এবং অনেকগুলো চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে এই বাজেট তৈরি করা হয়েছে। তবে হ্যাঁ সবকিছুতে হয়তো বলে-ব্যাটে মেলানো সম্ভব হয় নি। সব সমস্যার সমাধান দেওয়ার মতো অবকাশও হয়তো ছিল না। যা নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছেন। অনেকে বলছেন এই বাজেটে অনেক বিষয় অনুপস্থিত আছে। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। অন্য যে কেউ করলে এ ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকত। আমি মনে করি সামগ্রিকভাবে সময়ের প্রয়োজনের তুলনায় যথাসাধ্য শ্রম দিয়ে, চেষ্টা করে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে হ্যাঁ এই বাজেটের সার্বিক সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। সুতরাং বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই বাজেট ভালো না মন্দ একথা এখন বলার অবকাশ খুব একটা নেই।
রেডিও তেহরান: এবারের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। কিন্তু ১৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক বলেছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি হবে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এখানে বেশ খানিকটা পার্থক্য। কী বলবেন আপনি?
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখুন, জিডিপির হিসাবায়নটা অনেকগুলো ফ্যাক্টর কিংবা সূচকের ওপর নির্ভর করে। এরমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানী, বিনিয়োগ, সঞ্চয়, ঋণ প্রবাহ, প্রবাসী আয় এসব বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করেই জিডিপি করা হয়। সুতরাং এপ্রিল মাসে বিশ্ব ব্যাংক যেটা বলেছে সেটা তৎকালীন প্রেক্ষাপট বলেছে। তারা যেটা বলেছে সেটাও স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশ সরকার এই বাজেটটা তৈরি করছে জুন মাসে। আর এই এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে কিন্তু অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে এবং পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। ফলে বিষয়টি এরকমই হবে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবটাও এস্টিমেট বাংলাদেশ সরকারেরটাও এস্টিমেট। সুতরাং এস্টিমেট ইজ এস্টিমেট। মাঝখানে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে নানা পরিবর্তন ঘটবে। ফলে এ ধরনের পার্থক্য হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আর এসবের ওপই জিডিপির উত্থান পতনের ব্যারোমিটার ওঠানামা করে। ফলে এস্টিমেটাকে এস্টিমেট হিসেবে দেখা ভালো।
রেডিও তেহরান: বিদেশ থেকে পাওয়া অর্থকে এবারের বাজেটেও আয়ের একটি বড় খাত হিসেবে দেখানো হয়েছে। অনেকে বলেন, দুর্নীতি কমলে এই বিদেশ নির্ভরতা আরো কমে যেত। আপনার কী মনে হয়?
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: না, স্বাভাবিক। কারণ দুইভাবে আমরা বিদেশি সাহায্যের প্রত্যাশা করছি। একটি হচ্ছে বিদেশি ঋণ বা অনুদান। অপরটি হচ্ছে আমাদের নিজের প্রবাসী আয়। আরেকটি রপ্তানী বাণিজ্য সুত্রে বিদেশ থেকে অর্থ আসার যে বিষয়টি রয়েছে। এ তিনটিই কিন্তু পুরোপুরি বিশ্ব পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে। বিশ্ব রাজনীতির যে টালমাটাল অবস্থা তাতে এই তিনটি বিষয়ের পরিবর্তন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। করোনাকালে কিন্তু প্রবাসী আয় ভালো এসেছে। তবে এখন কমে গেছে। রপ্তানীও কমে গেছে সেটিও বিশ্ব রাজনীতির কারণে। দেখা গেছে অনেক দেশের চাহিদা কমে গেছে।
তবে এই তিনটি বিষয়ের সাথে বাংলাদেশে দুর্নীতির যে বিষয়টি আপনি বললেন, তার একটা বড় ভূমিকা আছে। কারণ বিদেশ থেকে যে ঋণ বা অনুদান আসে সে টাকাও মিস ইউজ হতে পারে। বর্তমানে ডলারের মূল্যে যে ওঠানামা তারসাথে বিদেশ থেকে আসার ঋণ বা অনুদানেরও সম্পর্ক আছে। রপ্তানীতে আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিংএর মাধ্যমে টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। এর সাথেও দুর্নীতি রয়েছে। আর এর প্রভাব রপ্তানী আয়ের ক্ষেত্রেও পড়ে।
পড
তৃতীয়ত, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে যে টাকাটা আসছে- সেক্ষেত্রে আগে একটা নিয়ম ছিল- প্রবাসী শ্রমিক ভাইয়েরা ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত পাঠাতে পারবে। কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ দিয়ে তারা শতকরা আড়াই ভাগ হারে ইনসেনটিভ নিতে পারবে। এরকম একটি ধারাবাহিক অবস্থা ছিল। এতে হুন্ডি অনেকটা কমে আসছিল ও রেমিটেন্স বাড়ছিল। কিন্তু মাসখানেক আগে বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সার্কুলার দিয়ে বলেছে, এখন আর ৫ হাজার ডলার না; যে কেউ যত খুশি ডলার নিয়ে আসতে পারবে এবং তাদেরকে ইনসেনটিভ দেয়া হবে। এরফলে প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের আয় শুধু না অন্যদের আয়ও আসার সুযোগ তৈরি হলো। এখানে একটি প্রশ্ন হচ্ছে কার টাকা কোথা থেকে আসছে? যিনি টাকাটা আনছেন তিনি কি বিদেশি শ্রমিক? নাকি বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী? বিনিয়োগকারী নাকি অন্য যেকথাটি বলা হয় –টাকা পাচারকারী! এই সামগ্রিক ব্যাপারে সাথে কিন্তু দুর্নীতির একটা সংযোগ থেকেই যাচ্ছে। অর্থাৎ এসব বিষয়কে যত সহজ করা হবে তত দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে। কারণ দুর্নীতি হচ্ছে এবং সেই দুর্নীতির কারণে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এখন বিদেশে চলে টাকা আবার ফেরত আনার পয়েন্টে- রেমিটেন্সের নামে বা সুযোগ সুবিধার নামে টাকা দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হয় একইসাথে ইনসেনটিভও দেয়া হয়-একইসাথে যদি আরও বলা হয় এই টাকা কে কোথা থেকে কীভাবে পাঠালো সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে না কিংবা কাগজপত্র দেখাতে হবে না তখন এটি কাউন্টার প্রোডাক্টিভ হবে।
এতে যে ম্যাসেজটি সামনে আসবে সেটি হচ্ছে একটি পক্ষ দেশের ভেতর থেকে সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে, কাগজপত্র দেখিয়ে, সব নিয়ম কানুন মেনে এবং কর দিয়ে মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকছেন- সেটি একটি পরিস্থিতি। আরেকটি হচ্ছে- বিদেশে টাকা নিয়ে গিয়ে- কোনো প্রশ্ন, নিয়ম কানুন, কাগাজপত্র কোনো কিছু না দেখিয়ে সেই টাকা আনতে পারছে একইসাথে ইনটেনসিভও পাচ্ছেন। এই ধরণের বৈষম্য সৃষ্টি করলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দুর্নীতি কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্নীতির উৎস বন্ধ করতে পারলেই তখন বিদেশে টাকা কীভাবে গেল কিংবা কীভাবে আসলো সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
রেডিও তেহরান: বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল কালো টাকা সাদা করার কথা বলেছেন। গত বাজেটের পরও তিনি এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি- বিদেশে অর্থ পাচার বেড়েছে। সুইস ব্যাংকের রিপোর্টে তা পরিষ্কার। তাহলে আমরা কী একথা বলতে পারি না যে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পেয়ে অর্থ পাচার বেড়েছে?
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখুন, অনেকগুলো কারণের ভেতরে এটা একটা কারণ। কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে যত সহজ নিয়ম করা হচ্ছে বা যত বেশি ইনসেনটিভ দেয়া হচ্ছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই কালো টাকা পাচারের পথ আরো বেশি প্রসারিত হচ্ছে। সরকার এর আগে যেসব ঘোষণা দিয়েছে তা কিন্তু দেশীয় টাকার ওপর। দেশে আপনার অপদর্শিত টাকা, দেশে আপনার কালো টাকা আছে আপনি জমা দিলে আপনার এত... টাকা ট্যাক্স হবে। তাছাড়া বিভিন্ন খাতে সুযোগ সুবিধা পাবেন।
তবে এবার অনেক দিন পর প্রথম বিদেশের টাকার কথা তোলা হলো। এর আগে কালো টাকার কথা ছিল। সেটি দেশি না বিদেশি সেকথা ছিল না। এখন অপ্রদর্শিত অর্থ যা বিদেশ থেকে আসবে সেই টাকার ওপর করের হার এবং তাকে সুযোগ সুবিধা দেয়ার বিষয় থাকবে। সাধারণভাবে প্রশ্ন উঠেছে, সবাই বলছেন- সরকার যদি এভাবে ইনসেনটিভ দেয়া শুরু করে এবং ঘোষণা দেয় তাহলে আরও বেশি টাকা বিদেশে চলে যাবে। তারপর আবার বিদেশে থেকে সেই টাকা আবার আসবে। একথাও ঠিক প্রতিটি অর্থনীতি চাইবে তার দেশের ভেতর থেকে যেসব 'খোকা বাবুরা' চলে গেছে সেইসব 'খোকা বাবুর' প্রত্যাবর্তন ঘটুক। সংসার আবার আনন্দে ভেসে ওঠুক। এটা ঠিক আছে। কিন্তু যে খোকা বাবু অন্যায়ভাবে বিদেশে গেছে, এখান থেকে লুটপাট করে চুরি করে টাকা নিয়ে গেছেন সেইটি যদি আবার 'খোকাবাবু'র নাম দিয়ে-'খোকাবাবু'কে অভ্যর্থনা জানানোর নাম নিয়ে তারা আবার ঢুকে তাহলে তো কালো টাকা বিদেশে পাচারের পথটা সুগম হবে। উৎসাহ এবং আগ্রহটা আরও বাড়বে। সুইস ব্যাংকে টাকা যে হঠাৎ করে বেড়ে গেল! এই সুইস ব্যাংকে টাকা কিভাবে যায়, কি হয় সেটা তো সবাই জানে! তো সেই সুইস ব্যাংকের টাকা যখন বেড়ে গেছে এর থেকে ইনডিকেটর আসতেই পারে এ বছরের আগের বছর যেখানে সরকার শতকরা ১০ ভাগ ট্যক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ যখন দেশের মানুষকে দিয়েছিল তখন তো খুব লোক এতে সংযুক্ত হয়নি, টাকা আসেনি। এখন তারাই আবার সেই টাকা বাইরে নিয়ে গিয়ে আরও বেশি কম সুদে অর্থাৎ শতকরা সাড়ে সাতভাগ সুদে বৈধ করা হবে এবং এ বিষয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। এ ধরনের অপশন যখন থাকবে সেটি একটি ঢালাও অ্যামনেস্টি দিয়ে দেয়া হলো। এমন ঢালাও অ্যামনেস্টি অনেক ক্ষেত্রে চলতে পারে তবে এখানে না! এটি খুব ভালো করে দেখার বিষয়।#
পার্সটুডে/ গাজী আবদুর রশীদ/১২