অক্টোবর ০৮, ২০২২ ২০:১২ Asia/Dhaka

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান আলাপনে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করি আপনারা সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমাদের সাক্ষাৎকারের বিষয় সম্প্রতি ইরানে মাহসা আমিনি নামে এক তরুণীর মৃত্যু এবং পরবর্তীতে সহিংস গোলযোগ সম্পর্কে। আর আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন ইরান প্রবাসী বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, গবেষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার মো.মুনীর হুসাইন খান।

জনাব মো. মুনীর হুসাইন খান-রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: জনাব মুনীর হুসাইন খান, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে মাহসা আমিনি নামে এক তরুণী নিহতের ঘটনায় সহিংস আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?

মুনীর হুসাইন খান: দেখুন, আসলে এটাকে আন্দোলন নয় বরং এটাকে বলা উচিত পশ্চিমা ও ইসরাইলের ইন্ধন ও উসকানিতে সহিংস গোলযোগ সৃষ্টির অপচেষ্টা। এটাকে প্রতিবাদমূলক কোনো বিক্ষোভ বলা যাবে না। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে তা বোঝা যায়। দেখুন, মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন।

মাহসা আমিনি

তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশের আগেই পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের অভ্যন্তরীণ এজেন্ট ও চরেরা  ইরানের পুলিশসহ নিরাপত্তাবাহিনীকে দোষী সাব্যস্ত করে ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল শহর ও সীমান্তবর্তী কুর্দিস্তান, বেলুচিস্তানে গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছে। গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে এসব গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা যারা সৃষ্টি করেছে তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। এতে ইরানের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন ছিল না এবং নেই। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা ব্যাংক, জনগণের সম্পত্তি, দোকানপাট, মসজিদ ও হোসাইনিয়াতে ভাঙচুর  ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা সাধারণ জনগণ, পুলিশ, হিজাব পরিহিত নারীদেরকে আক্রমণ করেছে। এমনকি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও তাদের হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। তারা পবিত্র কুরআন পুড়িয়েছে।  এক হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। বেশ কয়েকজন পুলিশ শহীদ হয়েছে। এসব বিষয়কে কি প্রতিবাদ বলা যায়? আসলে পশ্চিমা ও ইসরাইলের ইন্ধনে ও উসকানিতে মুষ্টিমেয় তাদের এদেশি এজেন্টরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য গোলযোগ সৃষ্টি করা। একে কোনোভোবেই আন্দোলন বলা যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি হত্যা

পাশাপাশি একটা বিষয় আমি একটু তুলে ধরতে চাই সেটি হচ্ছে, আমেরিকাতে প্রতিবছর এক হাজারেরও বেশি মানুষ পুলিশের হাতে খুন হয়। ২০২১ সালে মার্কিন পুলিশ ৯৯৬ জন পুরুষ এবং ৫৬ জন নারীকে গুলি করে হত্যা করেছে। চলতি বছর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত মার্কিন পুলিশ ৬৮২ জন পুরুষ এবং ৩২ জন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করেছে। গত ৫ বছরে ৮৯ জন নিরপরাধ নারীর বাসায় পুলিশ জোর করে ঢুকে তাদের হত্যা করেছে। আর এসব হত্যাকারী পুলিশের মাত্র শতকরা ২ জনের বিচার হয়েছে সেখানে। অর্থাৎ কোনো বিচার হয়নি বললেই চলে। অথচ মার্কিন পুলিশের সহিংসতা, হিংস্রতা ও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পশ্চিমারা কোনো সমালোচনা করছে না, কোনো কথা বলছে না, জনগণকে উসকানি দিচ্ছে না এসব বিষয়ে আন্দোলন করতে।

ফলে বলা চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে ইরানে গোলযোগ, অশান্তি, ফেতনা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতিগত দ্বন্দ্ব ছড়ানোর চেষ্টা করছে। মাহসা আমিনির মৃত্যুকে বাহানা করে তারা এসব করছে একটি কৃত্রিম বিদ্রোহ ঘটিয়ে। এটাকে আমি বলব কৃত্রিম, মেকি বিদ্রোহ।

পশ্চিমা গণমাধ্যম

পশ্চিমা মিডিয়াগুলো অপপ্রচার চালিয়ে বলছে যে, ইরানের অধিকাংশ নারী ও জনগণ ইসলামি হিজাব চাইছে না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এখানকার অধিকাংশ নারী এবং জনগণ মুসলিম হওয়ার কারণে তারা হিজাবের পক্ষে। যার প্রমাণ ২৩ ও ২৫ সেপ্টেম্বর গোটা ইরানে কোটি কোটি মানুষ যাদের অর্ধেক ছিল হিজাব পরিহিত নারী-তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র, ইসলামি বিপ্লব এবং হিজাবের পক্ষে এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের বিপক্ষে মিছিল বের করেছিলেন।

রেডিও তেহরান: জ্বি জনাব মুনীর হুসাইন খান, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এই সহিংস আন্দোলনের পেছনে আমেরিকা এবং ইসরাইল সক্রিয় রয়েছে বলে বক্তব্য দিয়েছেন। সর্বোচ্চ নেতার এই বক্তব্য কতটা যৌক্তিক?

মুনীর হুসাইন খান: জ্বি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং তাদের মিত্রদের হাত রয়েছে ইরানের ভেতর গোলযোগ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে-বিষয়টি নিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পুরোপুরি যৌক্তিক এবং সঠিক। মার্কিন কর্মকর্তারা এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম ইরানে গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের প্রকাশ্য ইন্ধন যোগাচ্ছে এবং উসকানি দিচ্ছে। এছাড়া সিআইএ প্রধান  নিজে সম্প্রতি স্বীকার করেছে যে ইরানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তাদের হাত রয়েছে। গত ৪৩ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়াও- ইসলামি বিপ্লব, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও সরকারের পতনের জন্য নাশকতামূলক কার্যকলাপ অব্যাহতভাবে করেই যাচ্ছে। ইরানের ভেতরে অশান্তি, গোলযোগ, দাঙ্গা, সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে এবং বর্তমানেও তা অব্যাহত রেখেছে। শুধুমাত্র ইরানেই নয়- মার্কিনবিরোধী দেশগুলোতে তারা এবং তাদের মিত্ররা সরকার পরিবর্তনের পাঁয়তারাও করছে।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা, চলমান সহিংস কর্মকাণ্ডের সুযোগে অনেকেই ইরানে নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে ইরানে আছেন, আপনি ইরানে নারীর অধিকারকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন? অর্থাৎ বলতে চাইছি ইরানের নারীরা কতটা অধিকার বা স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন?

মুনীর হুসাইন খান: দেখুন, ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত আছে। নারীদের অগ্রগতি কোনোভাবেই পুরুষদের চেয়ে কম হয়নি। নারীরা এখানে পুরোপুরি তাদের অধিকার ভোগ করছে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ইসলামি ইরানের নারীদের অধিকার পুরোমাত্রায় দিয়েছে। এ বিষয়টি আমরা দেখতে পাই ইরানে সরকারি চাকরি, স্কুল কলেজ,  বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, গবেষণা কর্ম সর্বত্রই নারীদের উপস্থিতি আছে। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানি নারীদের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। এমনকি ক্রীড়া জগতেও ইসলামি হিজাব পরে নারীরা অলিম্পিকসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রঞ্জ মেডেল পেয়েছেন। তাই বলা চলে ইসলামি বিপ্লব ইরানি নারীকে তাঁর সঠিক মর্যাদার আসনে বসিয়েছে এবং সঠিক অধিকার দিয়েছে। হিজাব এক্ষেত্রে অন্তরায় তো হয়নি বরং নারীদেরকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে গেছে। ইসলামি বিপ্লব ব্যবস্থায় নারীরা নিরাপদ এবং নিরাপত্তার সাথে সর্বত্র এমনকি একাকি চলাফেরা করতে পারে।

রেডিও তেহরান: জনাব মো. মুনীর হুসাইন খান, সব শেষ যে বিষয়টি জানতে চাইব সেটি হচ্ছে, অনেকে ইরানের নারীদেরকে হিজাব পরার বিদ্যমান আইনের বিরোধিতা করে থাকেন। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

মুনীর হুসাইন খান: দেখুন, ইরানে নারীদের জন্য যে হিজাব আইন রয়েছে তার বিরোধিতা করছে মুষ্টিমেয় কিছু নারী। আসলে তাদের উদ্দেশ্য হিজাব নয়; এটি বাহনামাত্র। তাদের উদ্দেশ্য ইরানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। আমি যতটুকু জানি এবং দেখেছি অধিকাংশ ইরানি নারী সম্মানের সাথে হিজাবের বিধান মেনে চলে। এমনকি শাহের আমল থেকেই অধিকাংশ নারী হিজাব পালন করে আসছে। হিজাব নারীকে সামাজিক মর্যাদা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। হিজাব ইরানের নারীদেরকে পাশ্চাত্যের নারীদের মতো ভোগ্যপণ্য বানানোর পর্যায় থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে ইসলামি হিজাব আইন নারীদের জন্য অপরিহার্য। যে মুষ্টিমেয় নারী এর বিরোধিতা করছে তারা আসলে পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট বিপথগামী। ইরানের অধিকাংশ নারী ধর্মীয় অনুভূতির জায়গা থেকে ইসলামি হিজাব মেনে চলে। অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস ও অনুভূতি থেকে তারা হিজাব পালন করে থাকে।

জনাব মুনীর হুসাইন খান- মাহসা আমিনির মৃত্যু এবং একে কেন্দ্র করে যে সহিংস গোলযোগ সে সম্পর্কে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। #

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৮

ট্যাগ