অক্টোবর ১৬, ২০২২ ১৯:২৫ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা মধ্যযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিখ্যাত ইরানি মনীষী আল খাওয়ারিজমির নানা আবিষ্কার ও গবেষণাকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানেও আমরা ইরানের আরেকজন মনীষীর অবদান সম্পর্কে আলোচনা করবো।

প্রাচীন পারস্য সভ্যতা এবং আজকের ইরানেও গণিতশাস্ত্র সবসময়ই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ত্রিকোণমিতি, বীজগণিত ও জ্যামিতির মতো গণিতশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোসহ  বিভিন্ন গাণিতিক হিসাব ও ডেরাইভেটিভগুলোর ক্ষেত্রে অনেক তত্বের আবিষ্কার ও বিকাশ মূলত ইরানি মনীষীদের মাধ্যমেই হয়েছে। ডেরাইভেটিভ হচ্ছে গাণিতিক হিসাব-নিকাশের বিশেষ টার্ম।  ডেরাইভেটিভগুলো হল বিশেষ ধরনের আর্থিক যন্ত্র যা অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তির একটি সংখ্যা থেকে তাদের মূল্য নির্ধারণ করে। ইরানি মনীষীরা এমন এক যুগে এসব ক্ষেত্রে বিস্ময়কর তত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন যখন বিশ্বের বিরাট অংশ অজ্ঞতা, মূর্খতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক পরিবেশে বজায় ছিল।

কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ইউরোপের ইতিহাসের একটি সময়কে অন্ধকার যুগ বা কালো অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করা হতো। ঠিক সে সময়টিতে প্রাচীন পারস্য ও ইসলামি সভ্যতা জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্প ক্ষেত্রে নজিরবিহীন অবদান রেখেছিল।

অর্থাৎ ইউরোপ যখন অজ্ঞতা ও মূর্খতায় ডুবে ছিল এবং সে যুগে যারাই নতুন নতুন আবিষ্কার ও জ্ঞানগবেষণায় জড়িত থাকতো তাদেরকে শুলে চড়ানো হতো অথবা আগুনে নিক্ষেপ কর হতো তখন মুসলিম সমাজে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও চোখ ধাঁধানো বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তুরস্কের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক খালিল ইনালচিক তৎকালীন ইউরোপ ও ইসলামি সভ্যতার অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,  'ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইরানিসহ অন্যান্য মুসলিম মনীষীদের ইসলামি দর্শন ও কালাম শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানার্জন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও নতুন নতুন তত্বের আবিষ্কার ইসলামি সভ্যতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। হিজরি চতুর্দশ শতাব্দির ওই সময়টিকে বলা হতো ইসলামের স্বর্ণালী যুগ। ইরানি ও ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল বিশাল ইসলামি সভ্যতা। অন্যদিকে আজকের ইউরোপ তখন ছিল অজ্ঞতা, মূর্খতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন'।

এ ব্যাপারে ইরানের ইতিহাসবিদ ড.মুসা নাজাফি বলেছেন, হিজরি চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দি ছিল ইসলামি সভ্যতা বিকাশের যুগ এবং উন্নয়নের এ ধারা বহু শতাব্দি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, হিজরি নবম শতাব্দিতেও ইরানের সাভাফি শাসনামলে, তুরস্কের ওসমানি শাসনামলে এবং কোনো কোনো আরব অঞ্চলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইবনে সিনা, আবু রেইহান বিরুনি, ফারাবি, গাজ্জালি, খাজা নেজামদ্দিন তুসিসহ আরো অনেক বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও মনীষীর কথা উল্লেখ করা যায় যারা জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নয়ন ঘটিয়ে সমগ্র মানব সভ্যতার বিকাশে বিরাট অবদান রেখে গেছেন। ইসলামি সভ্যতার ওই সোনালী যুগে দর্শনশাস্ত্রেও বহু চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং এর প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী শতাব্দিগুলোতে।

মৌলিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো গণিতশাস্ত্রও ইরানি সভ্যতা বিকাশে বিরাট অবদান রেখেছে। বিশেষ করে ত্রিকোণমিতি, বীজগণিত ও জ্যামিতির ওপর তাত্বিক ও ব্যবহারিক গবেষণা হয়েছে ইরানে। ইরানে গণিতের ব্যাপক উন্নয়ন ও ব্যবহারের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে দর্শনশাস্ত্রসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো কোনো শাখায় গবেষণার জন্য গণিতের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। এ কারণে দর্শন ও গণিতশাস্ত্রে বিশ্বখ্যাত বহু ইরানি মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে। তুরস্কের খ্যাতনামা ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদ ড. ফুয়াদ সেজগিন ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উন্নতির পেছনে গণিতশাস্ত্রে মুসলিম মনীষীদের তাত্বিক ও ব্যবহারিক দিকের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, 'দুঃখজনকভাবে মুসলিম মনীষীরা এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা নতুন নতুন তত্ব দাঁড় করালেও তাদের নামে কোথাও কোনো কিছু নথিভুক্ত বা রেকর্ড হয়নি। আমি মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এমন কিছু যন্ত্রপাতির কথা বলতে চাই যা গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসে কখনোই নথিভুক্ত করা হয়নি'।

আবু রেইহান বিরুনি

ড. ফুয়াদ সেজগিন বলেন, আবু রেইহান বিরুনির আবিষ্কৃত কম্পাসের কথা উল্লেখ করা যায় যা দিয়ে তিনি পৃথিবীর মডেলে বৃত্ত আঁকানো শিখিয়েছিলেন। যদি এ ধরণের যন্ত্র না থাকতো তাহলে সূক্ষ্মভাবে পৃথিবীর মডেলে বৃত্ত আঁকা সম্ভব হতো না।

এ কম্পাস ছাড়াও এ ধরণের চিত্রাঙ্কনের আরো অনেক পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ আবু রেইহান বিরুনি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বিরুনির উভয়পাশে ব্যবহৃত বিশেষ পদ্ধতির স্কেল আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করা যায় যা দিয়ে পৃথিবীর মডেল বা প্লেটের উভয় পাশের একটি আকৃতি আঁকতে ব্যবহৃত হতো। বিরুনি পৃথিবীর আয়তন বা ক্ষেত্রফল নির্ণয় করেছিলেন এবং তিনি পৃথিবীর ব্যাসার্ধ মাপার সমীকরণও শিখিয়েছেন। তার চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি খ্রিষ্টীয় উনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত গণিত শাস্ত্রের ইতিহাসে সবার কাছে ছিল অজানা। এ ছাড়া বিরুনি ত্রিকোণমিতি এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশ কষে এর দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। বিরুনিই সর্বপ্রথম কোনো প্রাচ্য মনীষী যিনি বলেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে।

আবু রেইহান বিরুনির জন্ম হয়েছিল ৩৬২ হিজরির ৩ জিলহজ মোতাবেক খ্রিষ্টীয় ৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। প্রাচীন ইরানের খারেজম প্রদেশের কাস শহরে তার জন্ম হয়। বর্তমানে এ অঞ্চলটি মূলত উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের অংশ। ভূগোল ছাড়াও গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার বিরাট অবদান ছিল। তিনি বিশ্বের বহু অঞ্চল ও শহর সফর করেন। তিনি যে শহরেই যেতেন সেখানকার দৈর্ঘ্য প্রস্তের মাপ নিতেন এবং ওই শহরের ভৌগোলিক অবস্থানকে বিশ্বের মানচিত্রে নির্দিষ্ট করতেন। ফলে তিনি অনেক বছর পরও মানচিত্র দেখে ওই স্থানটিকে চিহ্নিত করতেন। বলা যায়, কার্টোগ্রাফি বিজ্ঞানের সূচনা করেছিলেন তিনি। কার্টোগ্রাফি হ'ল শৃঙ্খল পদ্ধতি যা মানচিত্রের ধারণা, উত্পাদন, প্রচার এবং অধ্যয়নের সাথে সম্পর্কিত। কৌশলগুলির সেট বা মানচিত্র তৈরির শিল্প হিসাবেও পরিচিত। বর্তমানে এটি ভূগোলশাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।

বিরুনিই ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভূগোল বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং বিজ্ঞান-চর্চাকে গণিতের ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। মানচিত্র তৈরির যে নতুন পদ্ধতি তিনি উপহার দেন তার ভিত্তি ছিল গণিত ও জ্যামিতির মিশ্রণ। বালখ শহরের যে ভৌগোলিক পরিমাপ বিরুনি নির্ণয় করেছিলেন তা আধুনিক পরিমাপের খুব কাছাকাছি ছিল। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।