স্বাস্থ্যকথা: শিশুর অতিরিক্ত চঞ্চলতা (এডিএইচডি) -পর্ব ১
শিশুর অতি চঞ্চলতা বা অমনোযোগিতা কি এডিএইচডি?
সুস্থ–স্বাভাবিক শিশু খানিকটা চঞ্চল হবেই। সুস্থ শিশু মানেই হাসিখুশি ও দুরন্তপনা। তবে অতিচঞ্চল শিশুর সমস্যাকে বলা হয় অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি)। বাংলায় এ সমস্যাকে বলে অতিচঞ্চল অমনোযোগিতা।
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন সুস্থ আছেন। দেহের মতো মনেরও রোগ হয় এবং তা দেহের রোগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও দেহের রোগের চেয়ে বেশি মারাত্মক হতে পারে। মনের বহু রকম রোগ আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি ৪ জনের ভিতর একজন মানুষ কোনো একটি মানসিক রোগের শিকার হয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ মিলিয়ে একশ কোটির বেশি মানুষ বর্তমানে মানসিক রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে পৌনে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
আমরা আজ বড়দের মনের রোগ নিয়ে কথা বলব না-আমরা আমাদের শিশু সন্তানের মনের রোগ নিয়ে কথা বলব। সুস্থ–স্বাভাবিক শিশু খানিকটা চঞ্চল হবেই। সুস্থ শিশু মানেই হাসিখুশি ও দুরন্তপনা। তবে অতিচঞ্চল শিশুর সমস্যাকে বলা হয় অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি)। বাংলায় এ সমস্যাকে বলে অতিচঞ্চল অমনোযোগিতা। এটি শিশুর একধরনের স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা। আর বিষয়টি নিয়ে আমরা বাবা মায়েরা খুবই দুঃশ্চিন্তায় থাকি যদি আমাদের শিশু অতি চঞ্চল ও অমনোযোগী হয়। তো চলুন আজ এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিস্টিউটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলামের সাথে কথা বলব।
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
স্বাস্থ্যকথার সাক্ষাৎকারগ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম নতুন একটি বিষয় যা অতি গুরুত্বপূর্ণ-বাবা মায়ের কাছে। সেটি হচ্ছে শিশুর অতিরিক্ত চঞ্চলতা যাকে এডিএইচডি বলা হয় এ বিষয়ে জানতে চাইব। আসলে এই এডিএইচডি কি যদি একটু বুঝিয়ে বলেন? শিশুর সব চঞ্চলতাই কি এডিএইচডি?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: ধন্যবাদ। দেখুন, আমাদের মানুষের তো নানাবিধ রোগ আছে। রোগ হয়ে থাকে। তো এরমধ্যে কিছু শিশু মানসিক রোগ আছে। childhood mental disorder যেগুলো তারমধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অটিজম। তাছাড়া mental disorder, language disorder আছে। এরসঙ্গে এডিএইচডি (Attention-deficit hyperactivity disorder) একটি গুরুত্বপূর্ণ শিশু মানসিক রোগ। তবে এই রোগটির স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে।
যেমন ধরুন- কিছু শিশু আছে যারা একটু চঞ্চল থাকে। যেটাকে আমরা হাইপার অ্যাক্টিভ বলা হয়। অর্থাৎ শিশুরা একটু দুষ্টুমি করে, একটু বেশি ঘোরাফেরা করে, একটু বেশি চঞ্চলতা দেখায়। এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। এই চঞ্চলতাকে আমরা রোগের পর্যায়ে ফেলি না।
রেডিও তেহরান: শিশুর সব চঞ্চলতাই যদি এডিএইচডি না হয় সেক্ষেত্রে কোনটিকে এডিএইচডি বলা হবে?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: দেখুন, শিশুর সব চঞ্চলতা এডিএইচডি না। মূলত এডিএইচডি বলতে আমরা যেটাকে বলি-সেটি শিশুর মানসিক একটি রোগের পর্যায়ে পড়ে। Attention-deficit hyperactivity disorder বা এডিএইচডি এর মানে হচ্ছে এখানে Attention-deficit থাকে। ঐ আক্রান্ত বাচ্চাটা তার অ্যাটেনশান বা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। তার মানে হচ্ছে বাচ্চাটি তার মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। যেকোনো ব্যাপারে সে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। দেখা যাচ্ছে কোনো একটি কাজ করছে সেটি রেখে অন্য একটি কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ল। তার মনোযোগে ফোকাস থাকে না। ফলে মনোযোগটা শিফট হয়ে একবার এখানে তো আরেকবার ওখানে। এভাবে চলতে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে ঘন ঘন একাজ থেকে সেকাজ সেকাজ থেকে অন্য কাজা এভাবে লাফালাফি ফালাফালি করতেই থাকে। আর এই সমস্যার কারণে তাদের লেখাপড়ার ঘাটতি হয়। পড়াশুনা করতে তাদের বেশ কিছুটা বেগ পেতে হয়। কারণ পড়াশুনা করতে গেলে অ্যাটেনশান লাগবে। সেটি তো স্থির থাকে ঐসব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। ফলে এডিএইচডি হচ্ছে- A chronic condition including attention difficulty, hyperactivity, and impulsiveness. এডিএইচডিকে এভাবে বলা যেতে পারে- কখন বলব অতিচঞ্চলতা যখন শিশুর চঞ্চলতার কারণে সে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় (পড়ে যাওয়া, আঘাত পাওয়া ইত্যাদি), অন্যের ক্ষতির কারণ হয়, প্রায়ই এমন আচরণ করে (জিনিসপত্র ভাঙা, অযথা ছোটাছুটি করে অন্যের কাজে বাধা দেওয়া ইত্যাদি) কিংবা শিশুর সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় (যেমন চঞ্চলতার কারণে কেউ তার সঙ্গে মেশে না, খেলে না এবং তাকে এড়িয়ে চলে), তখন সেই চঞ্চলতাকে অতিচঞ্চলতা বলে।
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাস্থ্যকথার আসরে শিশুর অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা এডিএইচি নিয়ে অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলামের আলোচনা শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরিই আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও আলোচনায় ফিরলাম।অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, এই যে শিশু ছুটাছুটি দৌঁড়াদৌঁড়ি করতেই থাকে এটা কি স্বাভাবিক?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: দেখুন, অ্যাটেনশন তো ডিফিসিটি হয় অর্থাৎ মনোযোগের ঘাটতি থাকে, একইসাথে থাকে হাইপার অ্যাক্টিভিটি বা কর্মচঞ্চলতা বেশি থাকে।
যেসব লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে শিশুটির চঞ্চলতা এডিএইচডির মধ্যে পড়ে
■ কোনো বিষয়ের প্রতি বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
■ সারাক্ষণ ছোটাছুটি করা, চিন্তাভাবনা না করে হঠাৎ কিছু করে ফেলা।
■ স্থির হয়ে বসে থাকতে না পারা।
■ বই-কলম প্রায়ই হারিয়ে ফেলা।
■ লাফিয়ে উঁচুতে উঠে যাওয়া।
■ প্রশ্ন শোনার আগে জবাব দেওয়া।
■ পড়ালেখা এমনকি খেলাধুলায় মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
■ বড়দের কাজে বা কথার মধ্যে বাধা দেওয়া।
■ একসঙ্গে অনেক কিছু করার চেষ্টা করা, তবে কোনোটাই শেষ করতে না পারা।
অতিচঞ্চলতার এই লক্ষণগুলো যদি সাত বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে কমপক্ষে ছয় মাস ধরে দেখা যায় এবং এ কারণে যদি তার পড়ালেখা বাধাগ্রস্ত হতে থাকে, তখন সেটিকে এডিএইচডি বলা হয়।
আমরা কখনও কখনও বাচ্চাদের বলি অতি চঞ্চল কিন্তু তার সঙ্গে যে মনোযোগের অভাব আছে সেটি আমরা অনেকেই বুঝি না বা লক্ষ্য করি না। আমরা আগেই বলেছি- কিছু বাচ্চা চঞ্চল ও দুরন্ত থাকতে পারে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু যাদের চঞ্চলতা ও দুরন্তপনা অত্যাধিক উপরের যে লক্ষণগুলোর কথা বলা হলো অর্থাৎ একবার এদিকে একবার সেদিকে, একবার লাফ দিয়ে টেবিলে উঠবে এভাবে চলতেই থাকবে। দেখা যাচ্ছে মা বাবা বা পরিবারের সবাই একজায়গায় বসে কথা বলছে গল্প করছে কিন্তু ঐ বাচ্চা কিন্তু একজায়গায় স্থির থাকতে পারবে না। সে দৌঁড়াদৌঁড়ি, লাফালাফি করতেই থাকবে।
রেডিও তেহরান: ডা.অধ্যাপক তাজুল ইসলাম: এই শিশু দৌঁড়াদৌঁড়ি লাফালাফি করতেই থাকে-এটি কি স্বাভাবিক?
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম: না, এটি কোনোভাবেই স্বাভাবিক দুরন্তপনা নয়। তারা ঐ অতিচঞ্চলতার কারণে কিন্তু মারামারিও করে থাকে। অন্যের ওপর আঘাতও করতে পারে। আরেকটি বিষয় এখানে বলে রাখছি-এইসব শিশুদের কিন্তু কিছুটা conduct disorder বা আচরণগত সমস্যাও থাকতে পারে। তবে যেটি সরাসরি এডিএইচডি- সেখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে অতিরিক্ত চঞ্চলতা। এদের পেশীসঞ্চালনটা অতিরিক্তমাত্রায় থাকে। তারা এটা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। লাফালাফি দৌঁড়াদৌঁড়ির পাশাপাশি মনোসংযোগের অভাব দুটো একইসাথে থাকে। মোটাদাগে অতিরিক্ত পেশীসঞ্চালনজাত কর্মতৎপরতা থাকবে একইসাথে মনোযোগের ঘাটতি থাকবে এমন শিশুকে এডিএইচডি হিসাবে আমরা মনে করব।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক তাজুল ইসলাম আপনি এডিএইচডির লক্ষণগুলো বললেন। তো এ অবস্থায় তো শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তো এজন্য করণীয় কী ?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: জ্বি আপনি ঠিকই বলেছেন। এডিএইচডিতে আক্রান্ত শিশুর ক্ষতি হতে পারে না-ক্ষতি হয়। তার পড়াশুনা হয় না। পরিবারের জন্য একটা বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়। স্কুলে গেলে অশান্তি সৃষ্টি হয়। কারণ সেটি তো একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ জায়গা। সেখানে গিয়ে যদি সে লাফ দিয়ে বেঞ্চে উঠে দাঁড়ায়- দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে থাকে তাহলে তো ক্লাসের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়। ফলে সেখানে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া তারা দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে পড়ে। দেখা গেল গাছের ডালে উঠে পড়েছে। দুরন্তপনার ফলে দেখা যায় নানারকম দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। দেখা গেল হাত পা ভেঙ্গে গেছে। মাথায় আঘাত পেয়েছে। এভাবে নানারকমের ক্ষতি হতে পারে। শুধু যে নিজের ক্ষতি করে তাই নয়-অন্যেরও ক্ষতি করে থাকে। কারণ তারা সঙ্গীসাথাীদের সাথে মারপিট করে থাকে। ফলে লেখাপড়ার ক্ষতি হয়, শারিরীক ক্ষতি হয়, সামাজিক জীবন যাপন ব্যহত হয়। কারণ তার ফোকাস বা অ্যাটেনশান থাকে না বলে কারও সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে না। কারও সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। এতে তার পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিজীবন সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা যায় তারা বেশ মেধাবি কিন্তু তার তো মনোযোগ নেই সে ভালো করবে কীভাবে! ফলে নানা রকমের সমস্যায় তারা পড়ে।
ফলে যে প্রশ্নটি করলেন- করণীয় কী? করণীয় সম্পর্কে এভাবে বলা যায়
■ যদি শিশুর মধ্যে অতিচঞ্চলতার লক্ষণ থাকে, তাহলে একজন মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
■ শিশুর জন্য একটি রুটিন তৈরি করুন। বাড়ির সবাই সঠিক নিয়ম মেনে চলুন। যেমন নিদি৴ষ্ট সময়ে ঘুমানো, সঠিক সময়ে খাবার খাওয়া ও খেলার সময়ে খেলা ইত্যাদি।
■ শিশুকে কোনো নির্দেশ দিলে সেটি তাকে বুঝিয়ে বলবেন। রূঢ় আচরণ করবেন না।
■ শিশুর ভালো কাজের প্রশংসা করুন, কখনো তাকে পুরস্কৃত করুন।
■ শিশুর খাদ্যতালিকায় কৃত্রিম রং ও মিষ্টির পরিমাণ কমিয়ে তাজা ফলমূল যুক্ত করুন।
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম শিশুর অতি চঞ্চলতা বা এডিএইচডি প্রথম পর্বের আলোচনায় রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাদের হাতে আজ আর সময় নেই-আগামী সপ্তায় গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা হবে। সে আসরেও আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না। সবাই ভালো, সুস্থ ও সুন্দর থাকুন।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৯