রিজার্ভ সংকট: মুখে কৃচ্ছতা- বাস্তবায়ন নেই
'অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় জনগণকে আস্থায় নিতে হবে'
যে জনগণের জন্য দেশের অর্থনীতি। সেই অর্থনীতির সংকট কিংবা সফলতা যেকোনো ব্যাপারে সরকার, সরকার-বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনগণের মধ্যে বোঝাপড়ার যে দুর্বল জায়গাগুলো আছে তা দূর করতে হবে। আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।
তিনি আরও বলেন, মুখে বলা হল সংকট এবং কৃচ্ছতাসাধনের আহ্বান করা হলো অথচ বাস্তবায়ন করা হলো না। কিংবা বিশেষ একটা শ্রেণি সুবিধাভোগী হলো তাহলে হবে না অবশ্যই সাযুজ্যপূর্ণ হতে হবে। তাহলে যেকোনো সংকটকে সবাই মিলে মোকাবেলা করা সম্ভব।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, প্রথম পর্বের আলোচনার শেষ দিকে আপনি রিজার্ভ গড়ার এবং খরচের ব্যাপারে স্বচ্ছতার বিষয়টি চমৎকার উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন। তো রিজার্ভ তো অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেকথা আপনার আলোচনায় এসেছে একইসাথে বিষয়টির সাথে সাধারণ মানুষেরও তো একটা বোঝাপড়ার জায়গা থাকে। তাদের জীবন , দ্রব্যমূল্য ইত্যাদির সাথেও তো সম্পর্ক আছে। এই যেমন ধরুন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে এবং এরসাথে অন্যান্য পণ্য এবং সেবামূল্য বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যতটা সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে এর সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্য এবং দেশীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি কি খুব সাযুজ্যপূর্ণ?
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখুন, সাযুজ্য বা অসাযুজ্য এই দুইয়ের মাঝখানে থাকতে চাই। বিষয়টি এরকম- সাযুজ্য হবে- কোনো একটি জিনিষের মূল্য দেশের বাজারে বাড়তেই পারে। তবে সেই জিনিষের আমার প্রয়োজন কত, আমার স্টক কত, আমি কত দামে কিনতে পারি, কেনার ব্যাপারে আমার চেষ্টা এসব বিষয়কে যদি আমি ফয়সালা না করি তাহলে বারবার বাইরের জিনিষের দাম বেড়েছে বলে আমি খরচ দেখালাম এই পথে যাওয়াটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমি একটি উদাহরণ দিয়ে বলি। যেমন ধরুন- ব্রুনাইয়ের সাথে বছর তিনেক আগে আমাদের এমও ইউ সই করা ছিল। সেখানে বলা ছিল প্রয়োজনের সময় আমরা তোমাদের কাছ থেকে জ্বালানী নেব। তারা আমাদের খুব বন্ধু দেশ। অথচ পুরো আড়াইটা বছর এতবড় একটা সংকটের সময় আমাদের একবারও ব্রুনাইয়ের কথা মনে পড়ল না। অথচ তাদের সাথে চুক্তি আছে। আমরা এর পরিবর্তে কি করলাম- বাইরের অন্যান্য জায়গা থেকে নানানভাবে, কঠিন-জটিল পরিস্থিতির মধ্যে গেলাম। আমার সক্ষমতা এবং অক্ষমতার বিষয়টিকে আমাদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে সতর্কতা অবলমন্বন করতে হবে সেটি না করে যদি অমনোযোগী হই কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয়ের দিকে যাব, অথবা স্বার্থসহ অন্যান্য বিষয়ের দিকে যাবে-তাতে ভালো কিছু হবে না। এক্ষেত্রে এই দুইয়ের মধ্যে সাযুজ্য হতে হবে।
রেডিও তেহরান: ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, আমি আবারও জানতে চাইব, রিজার্ভর কারণে জিনিষপত্রের দাম বাড়লে তো সাধারণ মানুষের উপর তার প্রভাব পড়ে তাই না? এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: আপনি যেমনটি বলছিলেন যে বাইরের কারণে জিনিষপত্রের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের উপর তার প্রভাব পড়ে। আমি সবকিছুর উপর এটাই বলব, বাইরের কারণে জিনিষপত্রের দাম বাড়া কিংবা রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ার বিষয়টির সরাসরি প্রভাব পড়ছে জনগণের ওপর। সুতরাং সেই জনগণকে আস্থায় নিয়েই কিন্তু রিজার্ভ সংকটের মোকাবেলায় যেতে হবে। আমি শুধু মুখে বললাম একদিকে ভাই, সংকট বাড়ছে অন্যদিকে ঠিক খরচের আগের সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে। আমি কথার কথা বললাম- এরা এরা বিদেশ যেতে পারবে না। কিন্তু বস্তুত দেখা গেল তার কোনো বাস্তবায়ন হলো না। সবাই দেখছে-যে যার সুযোগ সুবিধামতো কাজ করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে খরচের ব্যাপারে এমনভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছি যে সেখান থেকে আলাদাভাবে বসে একটু আলাপ আলোচনা করে শর্তগুলো বুঝে সমঝোতা করার যে একটা সুযোগ আছে তার দিকে না তাকিয়ে আমি যদি আমার বাহুল্য খরচ চালাতেই থাকলাম অন্যদিকে সবাইকে বললাম- কৃচ্ছতাসাধন করেন। আপনারা কষ্ট পাচ্ছেন। কৃচ্ছতাসাধন না করলে আপনারা অসুবিধায় পড়বেন। এই দুইয়ের মধ্যে সাযুজ্য হতে হবে।
সবকিছুর ওপর সাধারণভাবে আমি যেটি মনে করি-সেটি হচ্ছে-যে জনগণের জন্য অর্থনীতি সেই জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। জনগণ যেন দেখে বা বোঝে যে দেশের অর্থ এদিক সেদিক হচ্ছে না বা অস্বচ্ছতা নেই। তাহলে কিন্তু মানুষ মনে করবে যে না আমরা কষ্টে পড়েছি ফলে আমাদের এ বিষয়টিকে মেনে নিতে হবে। সেই বিশ্বাস, সেই আস্থা তৈরি করা জরুরি। শুধু বাংলাদেশ কেন সংকটাপন্ন যেকোনো দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদের অন্যতম প্রধান কাজ এবং দায়িত্ব।
রেডিও তেহরান: ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, আপনি বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ছিলেন এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। দীর্ঘদিন দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন। তো সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ জোরেশোরে বলা হচ্ছে-বাংলাদেশ ব্যাংকে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে তা খুবই নিরাপদ। তবে অনেক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কাঙ্খিত মাত্রায় নিরাপদ নয়। আপনার পর্যবেক্ষণ কি বলবেন?
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: আমার পর্যবেক্ষণ ওটাই সব পক্ষকেই, সরকার-বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনগণের মধ্যে বোঝাপড়ার যে দুর্বল জায়গাগুলো আছে তা দূর করতে হবে। তবে যেন এরকম না হয়, আমি বলতে থাকলাম আমার গোয়ালে অনেক গরু আছে, গরুগুলো সব ভালো। আবার একইসঙ্গে যদি দেখতে থাকি যে গরুগুলোর দুটোর খুরা রোগ, তিনটার গাল দিয়ে লালা ঝরছে বাকি তিনটার হিসাব নেই তাহলে তো আমার গোয়ালে সব গরু ভালো আছে একথা বলা যৌক্তিক হবে না, প্রতিভাত হবে না, প্রতিষ্ঠিত হবে না। সুতরাং আমি আবারও বলছি, যা স্বচ্ছ, যা বিষয় সেটি স্পষ্ট করা উচিত। এর আগে দেখা গেছে সংকটের সময় যেমন নব্বুইয়ের দশকে বা তার আগেও নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে তদারকি করা হয়েছে। কিন্তু এরকম কিছু এখন দেখা যাচ্ছে না। শুধু মুখে মুখে বলা হচ্ছে আমার অর্থনীতি নিরাপদ, আমার রিজার্ভ নিরাপদ। একথাটাও যেমন একদিকে ঠিক অন্যদিকে আপনি যেমনটি বললেন যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হ্যাকিং হয়ে চলে গেল। প্রচূর রিজার্ভ আছে এমন সন্তুষ্টিতে যিনি ভোগেন তার কাছে এটি সামান্য অর্থ মনে হতে পারে। কিন্তু টু দ্য পিপল টু দ্য মাইন্ড অব দ্য পিপল-It is something! কারণ তখন সে মনে করতে পারে সাধারণ একটি কোডের ভুলের জন্য আমাদের টাকা চলে যাবে তারপর সেটি যথাসময় রিপোর্ট হবে না। জানা যাবে অনেক পরে বাইরের কাছ থেকে। এই যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়াটা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। এগুলোর সাথে সাথে কি প্রতিকার কি ব্যবস্থা নেয়া হলো সেটা পরিস্কার থাকা দরকার। জনগণের সাথে বোঝাপড়ার বিষয়টি স্বচ্ছ হওয়া দরকার। কেননা আমরা এতবড় একটি মুক্তিযুদ্ধ করতে পেরেছিলাম কারণ জনগণ একটি সমঝোতার জায়গায় এসেছিল এবং একত্রিত হয়েছিল যে আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমাদের রক্ত দিতে হবে। সবাই রক্ত দিয়েছিল। কিন্তু রক্ত দেয়ার ব্যাপারে যদি কখনও সংশয় –সন্দেহ ও উৎকণ্ঠার ব্যাপার তৈরি হয়-যে রক্ত দিয়ে কি লাভ! কার রক্ত কে দিচ্ছি, কেন দিচ্ছি-এর সুফল কে ভোগ করছে-কে করছে না কিংবা আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম-আমার বলার কিছু ছিল না এ ধরনের প্রেক্ষাপট হলে সেটি মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়।
রেডিও তেহরান: জ্বি ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা সেই স্বাধীন দেশের অর্থনীতি, রিজার্ভ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেন প্রশ্ন না ওঠে-কি পেলাম কি পেলাম না-রক্ত দিলাম কেন, উন্নয়ন কাদের জন্য হচ্ছে-এর সুফল কারা পাচেছ... এসব বিষয়ে আপনি কি বলবেন:
ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: আমি সংক্ষিপ্ত একটা বর্ণনা দিয়ে এটাই বলি- একটি বৃটিশ প্রবাদ আছে যে, বোকারা কষ্ট করে খাবার তৈরি করে আর চালাকেরা তা খায়। এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে কৃষকরাসহ সবাই খেটেখুটে যে অর্থনীতি গড়ে তুলছে, যে উন্নয়নের ধারা তৈরি করছে-অথচ যদি দেখা যায় এসবের সুফল কতিপয় লোক যারা আড়াই শ টাকার আপেল ৫০০ টাকায় কেনার হিম্মত রাখে, কিংবা যারা সামান্য কোনো অনুষ্ঠানে দল বেঁধে রিসোর্টে যেতে পারে সেটি কেমন! এ বিষয়টি কি দেশের সবার জন্য সমানভাবে প্রতিভাত হচ্ছে? সেটি হয়নি। সুতরাং সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে এমনটি না করা পর্যন্ত যেকোনো সংকটকালকে সাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করা সহজ হবে না। যদি সমান সুযোগ থাকে তখন বিষয়টি সহজ হবে। সেই সেই সংকট থেকে উত্তরণের একটা ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস থাকবে। মতানৈক্যের যে বিভ্রান্তি তাতে নিশ্চয়ই কোনো কল্যাণ নেই। বরং মতঐক্যের ঐশ্বর্যটা তার মধ্যে ফুটে থাকে সাফল্যের শাপলা।
রেডিও তেহরান: তো ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৩