ইরানি উপজাতি সমাজে নারীই পরিবারের প্রধান স্তম্ভ
সুখের নীড় - পর্ব ২৩ ( ইরানের যাযাবর শ্রেণীর উপজাতি-পরিবার )
সমাজ-জীবনে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। নারী, পুরুষ, মা-বাবা ও সন্তানদের মানসিক সুস্থতা এবং সমাজের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য ও সর্বোপরি মানুষের মত মানুষ হওয়ার জন্য পরিবার গঠন জরুরি।
পবিত্র কুরআনে সুরা ফুরক্বানের ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: এবং যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর। - এ আয়াত থেকে স্পষ্ট সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক ও পরিবারের মর্যাদা নির্ভর করে পরিবারের সদস্যদের খোদাভিরুতার ওপর। সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার জন্য নারী-পুরুষ বা স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের সুস্থ ও আন্তরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা জরুরি। পরিবারের অভিভাবক ও বড় সদস্যরা বিশেষ করে বাবা-মা হচ্ছেন সন্তানদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। বাবা-মায়ের বিশ্বাস, ধর্ম, স্বভাব, জীবন-যাপনের পদ্ধতি ও ঝোঁক প্রবণতা এসবই সন্তানদের ওপর প্রভাব ফেলে। স্বামী-স্ত্রীর সহৃদয় সুস্থ সম্পর্ক ও পারস্পরিক ভালবাসাও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। পরিবারকে দায়িত্বশীল ও মজবুত করার জন্যও এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
এবার ইরানের যাযাবর শ্রেণীর উপজাতি-পরিবার সম্পর্কে কিছু কথা বলব। ইরানের এ ধরনের পরিবারগুলোতে নারীর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা পুরুষের তুলনায় কোনো অংশেই কম শ্রদ্ধাভাজন নন। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো কোনো অঞ্চলের এ ধরনের গোত্রে পুরুষের ভূমিকাকেই মুখ্য বলে মনে হবে এবং অতীতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের উপজাতীয় সমাজের অনেক নারীই যথাযোগ্য মর্যাদা হয়ত পাননি। কিন্তু এ অবস্থা সামগ্রিক চিত্র নয়। বাস্তবে সুদূর অতীত যুগ থেকেই ইরানি উপজাতীয় সমাজে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে সম্মান পেয়ে আসছেন।
ইরানি উপজাতি সমাজে নারীই পরিবারের প্রধান স্তম্ভ। কারণ পুরুষরা খুব কম সময়ই ঘরে থাকেন। এ ধরনের পরিবারে নারীই উৎপাদনমূলক তৎপরতায় সিংহভাগ ভূমিকা রাখেন। তারা পরিবারে পুরুষের তুলনায় বেশি পরিশ্রম করেন নিবেদিত চিত্তে ও পরিবারকে বেশি সময় দেন। কিন্তু তাই বলে তারা পুরুষদের কাছে অহংকার বা হামবড়া ভাব দেখান না।
ইরানি উপজাতি সমাজে স্ত্রী বা নারীর ওপর কখনও স্বামী বা পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিপীড়নমূলক আচরণ করলেও তারা তা নীরবে সয়ে নিয়ে সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমেই পুরুষের মন জয় করে নেন। বিনম্রতা, সরলতা, অল্পে তুষ্টি, আত্মমর্যাদাবোধ ও সাহসিকতা ইরানের লোরেস্তান অঞ্চলের উপজাতি নারীদের বৈশিষ্ট্য। ফলে এ ধরনের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দেখা যায় আন্তরিক ও দুশ্চিন্তামুক্ত পরিবেশ এবং এ পরিবারগুলো স্নেহময়ী জননীর হাতে হয়ে ওঠে শান্তি ও সুখের নীড়।
ইরানি উপজাতি সমাজের সদস্যরা প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যের কোলে বড় হওয়ার সময় পেশাগত স্বাধীনতা ও আনন্দদায়ক জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তারা পরিবারকে অগ্রগতির মাধ্যম বলে মনে করেন। এ ধরনের পরিবারে দাদা-দাদী ও বয়স্ক সদস্যরা নবীন সদস্যদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করেন এবং তরুণ বা নতুন প্রজন্মের সদস্যরা বয়োবৃদ্ধ বা বয়স্কদের উপস্থিতিকে তাদের জন্য প্রত্যাশিত বলে মনে করেন।
ইরানের লোরেস্তান অঞ্চলের উপজাতি-নারী ঘরের রান্না-বান্নার সব কাজ করা সত্ত্বেও সবার পরে খেতে বসেন। মেহমান আপ্যায়নের ক্ষেত্রেও তারা অত্যন্ত নিবেদিত-প্রাণ! ইরানের উপজাতীয় পরিবারগুলোতে নারীই যেন পরিবারের মূল প্রাণ-প্রবাহ! আর এ জন্যই ইরানের লোরেস্তান অঞ্চলে এ কথাটি প্রবাদের মত প্রচলিত যে পরিবারের গৃহিনী যদি মারা যান তাহলে সে সংসারের ঘটে সর্বনাশ বা সে সংসারের বিলুপ্তি অনিবার্য। আসলে বিষয়টি কেবল ইরানের লোরেস্তান অঞ্চলের উপজাতীয় নারীর জন্যই প্রযোজ্য তা নয়, বিষয়টি ইরানের গোটা নারী সমাজের জন্যই মহাসত্য। যেসব নারী তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, পরিশ্রম ও ভালবাসা দিয়ে গড়ে তোলে সংসার মা বা স্ত্রী হিসেবে তাদের ত্যাগ ও স্নেহের কাছে পরিবারগুলো ঋণী। আর পরিশ্রম ছাড়া কোনো পরিবার ও মানুষই জীবনে উন্নতি করতে পারে না।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে আমরা সফল বিয়ে সম্পর্কে কিছু কথা বলব। সফল বিয়ের জন্য জরুরি হল সঠিক নির্বাচন ও সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন। বিয়ের উদ্দেশ্য এমন হওয়া উচিত নয় যে স্ত্রী বা জীবনসঙ্গীর ওপর ভর করে বেকারত্ব বা অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা বা স্রেফ জৈবিক চাহিদা মেটানো, কিংবা মানুষের কাছে এটা প্রচারের জন্য বিয়ে করা যে দেখুন আমার জীবনসঙ্গী কতই না সুশ্রী! অথবা উচ্চতর সামাজিক স্ট্যাটাস অর্জনের জন্যই বিয়ে করা! অথবা নিঃসঙ্গতা কাটানোও বিয়ের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। সফল বিয়ে মানে এসব নয়! অনুরাগ বা ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে বিয়ে করাটাও সফল বিয়ের লক্ষণ নয়! আপনি যাকে বিয়ে করতে চান আগে তাকে ভালোভাবে চিনুন, তাকে বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাকে ভালো মানুষ বলে মনে হওয়ার পরই তার বিষয়ে অনুরাগী হউন। কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই যুবক যুবতীরা আবেগ বা অনুরাগকে প্রাধান্য দিয়ে পাত্র -পাত্রীকে ভালোভাবে না চিনেই বা পাত্র-পাত্রীর পারিবারিক অবস্থা ভালোভাবে না জেনেই অন্ধ প্রেমের টানে বিয়ের পিড়িতে বসছেন। কিন্তু বিয়ে করার অল্প কিছু দিন পরই তারা বুঝতে পারেন যে পরস্পরকে চিনতে তারা ভুল করেছেন!
একটি আদর্শ পরিবার গড়ে তুলতে হলে নীতি-নৈতিকতা, চিন্তাশীলতা, সামাজিকতা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং ধর্মীয় বিষয়েও যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে যাতে এইসব বিষয়ে সমাজকে সুসন্তান বা যোগ্য নাগরিক উপহার দেয়া যায়। পরিবারকে সফল করার জন্য স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা জরুরি। এ সংস্কৃতি পরিবারগুলোকে জীবনের নানা গভীর সংকটের সময়ও নিরাপদ রাখে। বিয়ের আগেই যদি উপযুক্ত জীবনসঙ্গী বাছাই করার জন্য প্রয়োজনীয় পারস্পরিক পরিচিতি অর্জন করা সম্ভব হয় তাহলে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস এবং সহমর্মিতা অর্জন সহজ হয়। ফলে পরিবার হয়ে উঠবে মজবুত ও সচল। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৭