ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৩ ২৩:৪৮ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের আলোচনায় আমরা প্রাচীন গ্রিসে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আজ আমরা প্রাচীন রোমের নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করব।


ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী প্রাচীন রোম সমাজে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হত না। নতুন প্রজন্মের প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে পরিবারের যে গুরুত্ব রয়েছে সে বিষয়ে তারা ছিল উদাসীন। ফলে নারীর মর্যাদারও কোনো গুরুত্ব ছিল না প্রাচীন রোমান সমাজে।  বরং সেখানে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হত। 

প্রাচীন রোমে আদালতে বা বিচারের ঘটনায় নারীরা উপস্থিত থাকার অধিকার রাখতেন না। এমনকি সাক্ষী হিসেবেও বিচার-কার্যে উপস্থিত হতে পারতেন না তারা। যখন কোনো নারী বিধবা হতেন তখন স্বামীর সম্পদের ওপর কোনো অধিকার তারা দাবি করতে পারতেন না। বিধবা হওয়ার পর তারা নিজের পুত্র, ভাই ও বাবার তত্ত্বাবধানে থাকতেন। 

 প্রাচীন রোমে নারী বেচা-কেনার প্রচলন ছিল। তাই পুরুষরা বিয়ে করতে ও পরিবার গঠনে আগ্রহী ছিল না। যৌতুকের প্রলোভন দেখিয়ে পুরুষদেরকে বিয়ে করার জন্য উৎসাহ দেয়া হত। সে যুগে রোমান পুরুষরা বিয়ের পর স্ত্রীর যৌতুকের মালিক হত।  অনেক রোমান পুরুষ অভিজাত, ধনী বা এলিট পরিবারগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য ওইসব পরিবারের নারীদের বিয়ে করতে আগ্রহী হত। রাজনৈতিক স্বার্থসহ নানা স্বার্থ হাসিল হওয়া মাত্রই তারা অন্য নারীর পেছনে ছুটত যাতে আরও বড় পদ বা বেশি সম্পদ অর্জন করা যায়!

রোম শহর 

 

রোমান পুরুষরা খুব সহজেই স্ত্রীকে তালাক দিত ও পৃথক হয়ে পড়ত। তালাক দেয়ার কারণ উল্লেখ করাও তাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। তারা স্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তালাকের বিষয়টি ঘোষণা করত। কোনো কোনো রোমান পুরুষ কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করত না এবং নারীর ঔদ্ধত্যের প্রতি ঘৃণাকে তারা এর কারণ বলে উল্লেখ করত।  খ্রিস্টপূর্ব ৪১৩ সাল পর্যন্ত প্রাচীন রোমের আইন অনুযায়ী বংশধর বা নতুন প্রজন্ম বৃদ্ধির লক্ষ্যে রোমান পুরুষদের জন্য বিয়ে করাটা ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু ক্যামিল্লুস-এর শাসনামলে রোম সরকার স্ত্রীবিহীন পুরুষদের জন্য কর দেয়ার প্রথা চালু করে। ফলে যারা এই কর দিত তাদের জন্য বিয়ে করাটা আর বাধ্যতামূলক থাকতো না।

প্রাচীন রোমের সমাজ-ব্যবস্থা ছিল পিতৃশাসনকেন্দ্রীক এবং নারীকে সেখানে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হত। পরিবারে সব ধরনের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত পুরুষরা। রোমের নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখত না। একজন পুরুষ তার সন্তানদেরকে বিক্রি করার ও এমনকি হত্যারও অধিকার রাখত। কোনো আইনি কর্তৃপক্ষই এ ধরনের কাজকে বেআইনি বা নিষিদ্ধ মনে করত না।  কোনো  রোমান নারী যদি কোনো অপরাধ করত তাহলে তার স্বামী তাকে হত্যা করতে পারত। অ্যালবার্ট ম্যালে জুল ইসহাক রোমের ইতিহাস নামক বইয়ে লিখেছেন, প্রাচীন রোমে স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার ছিল অসীম। স্ত্রী কোনো ভুল করলে স্বামী তাকে শাস্তি দিতে পারত। স্ত্রী মদ পান করলে স্বামী তার নিন্দা জানাত। স্ত্রী ব্যভিচার করলে স্বামী তাকে হত্যার অধিকার রাখত। মোট কথা প্রাচীন রোমে নারীর সঙ্গে ক্রীতদাসী বা বাঁদীর মত আচরণ করা হত।  তাদের কোনো সম্মান ছিল না। রোমান পুরুষরা নারীদেরকে অপরিপক্ব বা ত্রুটিপূর্ণ অস্তিত্ব বলে মনে করত।

পারিবারিক মূল্যবোধের বিপরীতে প্রাচীন রোমের পিতারা পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার কেন্দ্র বা আশ্রয়স্থল না হয়ে তারা ছিলেন পরিবারের সদস্যদের প্রতি নির্দয়। এমনকি তারা পরিবারের সদস্যদের জীবনও কেড়ে নিতে পারত! যেমন, স্ত্রী যদি বধির বা অন্ধ সন্তান জন্ম দিত অথবা কন্যা সন্তান জন্ম দিত তাহলে পিতা প্রচলিত প্রথার আলোকে তাকে হত্যার অধিকার রাখত। রোমানরা পুত্র সন্তানে বেশি আগ্রহী ছিল। কারণ তাদের দৃষ্টিতে পুত্র সন্তান হচ্ছে পরিবারের জন্য শক্তি ও মর্যাদার প্রতীক, তারা যুদ্ধের সময় দেশের হয়ে যুদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে নারী হচ্ছে যুদ্ধের সময় পুরুষদের জন্য বোঝা এবং বন্দি হলে তারা শত্রুপক্ষের দাসী হয়ে যায় যা সমাজের জন্য লজ্জাজনক! প্রাচীন রোমান সমাজে নারী ছিল সব সময়ই স্বামী বা পরিবারের অন্য কোনো পুরুষের তত্ত্বাবধানে থাকা অধিকারহীন মানবী। 

খ্রিস্ট ধর্মের আবির্ভাবের পর রোমের নারীদের মর্যাদা ও অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। অবশ্য তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অনেকে দিকেই তারা ছিল বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত। অবশ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রভাবে রোমান নারীদেরকে ধর্মীয় মাহফিলে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তবে হিজাব বা পর্দা করা ছাড়া এ ধরনের মাহফিলে তাদের অংশগ্রহণ ছিল নিষিদ্ধ। গির্জায় আসতে পারলেও সেখানে কোনো কথা বলা তাদের জন্য ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিছু চাইতে হলে তা আগের স্বামীর মাধ্যমে জানিয়ে রাখতে হত। খ্রিস্ট ধর্মের আবির্ভাবের আগে রোমান নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারত না। কিন্তু এ ধর্মের আবির্ভাবের পর তারা গির্জায় যাওয়ার সুযোগ পেলেও নানা শর্ত মেনে চলতে হত। অথচ পুরুষদের বেলায় এইসব শর্ত ছিল না। 

  
রোম-কেন্দ্রীক রোমান সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার পর সেখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থায় কিছু পরিবর্তন আসে। রোমান সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার আগে রোমের নারীরা কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারতেন না এবং সম্পদের অধিকার বা উইল তথা ওসিয়তনামা প্রণয়নের অধিকারও তাদের ছিল না। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার পর সেখানকার নারীরা ওসিয়তনামা প্রণয়নের ও তাতে স্বাক্ষর দেয়ার অধিকার পান। এ যুগের রোমান নারীরা আর আগের মত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অবশ্যই কোনো পুরুষ অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে থাকতেন না। বরং নারী জন্মের পর থেকে স্বাধীন ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অর্জন করে এবং স্বামীরা আর আগের মত নিজেদের মৃত্যুর কথা ভেবে স্ত্রী বা কন্যাকে অন্যের তত্ত্বাবধানে রাখার ওসিয়ত বা উইল লিখতে পারতেন না।  
 

 

পার্সটুডে/এমএএইচ/০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ