রোজা হচ্ছে এই তাকওয়ারই অনুশীলন
রমজান: খোদাপ্রেমের অনন্য উৎসব (পর্ব-৬)
গত কয়েক পর্বে রমজানের মূল লক্ষ্য অর্জন তথা খোদাভীতি বা তাকওয়া অর্জনের নানা উপায় সম্পর্কে আমরা কথা বলেছি।
এসবের মধ্যে অদৃশ্য নানা বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস, যেমন আল্লাহ ও তাঁর নবী-রাসুল, সমস্ত আসমানী ধর্মগ্রন্থ, ফেরেশতাকুল, পরকাল ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস এবং এইসব বিশ্বাসের পাশাপাশি নামাজ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। মুমিনের নানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে খোদাভীতি ও বিনম্রতা আর মনোযোগ দিয়ে সময়মত নামাজ সম্পন্ন করা, বিশেষ করে নামাজের সময় হওয়া মাত্রই নামাজ শুরু করা।
নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত হল নামাজ শেষে বিশেষ তাসবিহ যা হযরত ফাতিমা জাহরার তাসবিহ্ নামে খ্যাত সেই তাসবিহ পাঠ করা। এ তাসবিহ্তে পড়তে হয়: আল্লাহু আকবর, আলহামদুলিল্লাহ ও সুবাহান আল্লাহ। প্রথমটি অর্থাৎ আল্লাহু আকবর ৩৪ বার, পরের দু'টি ৩৩ বার এবং একবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করতে হয়।
একবার হযরত ফাতিমা পিতা মহানবীর (সা) কাছে সাংসারিক কাজে সহায়তার জন্য একজন দাসীর আবেদন করলে মহানবী তাঁকে এই তাসবিহ পাঠের পরামর্শ দেন। -
নামাজ আদায়ের পর দোয়া পাঠও নামাজের গুরুত্বপূর্ণ রীতি। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে, দোয়া ইবাদতের মূল অংশ বা সারাংশ।
রমজানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল অভাবগ্রস্ত ও ক্ষুধার্ত দরিদ্রদের কষ্ট উপলব্ধি করা। যে মুসলমান পেট পুরে খেলো অথচ তার প্রতিবেশী দরিদ্র কেউ অনাহারে রইল হাদিসে রাসুলে তাকে মুসলমান নয় বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও মহানবীর বক্তব্য অনুযায়ী রমজানের রোজার আরেকটি বড় লক্ষ্য হল রোজার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করে কিয়ামতের দিনের ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কথা স্মরণ করা।-পৃথিবীর এই জীবনের ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্টের সঙ্গে আসলে কিয়ামতের দিনের ক্ষুধা তৃষ্ণার কোনো তুলনাই হয় না। সেদিনটি হবে অনেক বেশি দীর্ঘ ও অনেক বেশি গরম।
রোজা রাখাকে আমরা যেন ভয় না পাই সেজন্য মহান আল্লাহ বলেছেন, অতীতের জাতিগুলোর জন্যও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। তাই রোজা কোনো নতুন বিষয় নয়। আর রোজার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য অর্জন যে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন তাও মহান আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তবে গ্যারান্টি দেননি আল্লাহ। তিনি বলেছেন, রোজা রাখলে মুমিন বা বিশ্বাসীরা সম্ভবত খোদাভীতি অর্জন করবে।
এখানে সম্ভবত বলার কারণ হল প্রকৃত রোজাদার হওয়া অনেক কঠিন সাধনা-সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সাধারণ মানের রোজা রাখলেই তাকওয়া বা খোদার বিষয়ে সদা-সতর্কতা বা সদা-সচেতনতা অর্জন সম্ভব নয়। চোখসহ পঞ্চেন্দ্রিয়ের রোজা, মনের রোজা-এসবই কঠিন বা সাধনা-সাপেক্ষ ব্যাপার। রোজা রেখেও গিবত করা, হিংসা লালন করা, কৃপণতা বজায় রাখা ইত্যাদি হারাম কাজ রোজার উদ্দেশ্যকে বানচাল করে দেয়। অনেকেই রোজা রেখে আসলে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট ভোগ ছাড়া আর কিছুই অর্জন করেন না বলে মহানবী (সা) সতর্ক করে দিয়েছেন।
তাকওয়া অর্জন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ২৩৭ বার খোদাভীতি বা তাকওয়া শব্দ উল্লেখ করেছেন। তাকওয়া বলতে আমরা সাদামাটা অর্থে খোদাভীতি বা ধার্মিকতার কথা উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু তাকওয়ার সবচেয়ে ভালো বাংলা প্রতিশব্দ খোদা-সচেতনতা হওয়া উচিত। কারণ মহান আল্লাহ যেমন দয়ালু ও ক্ষমাশীল তেমনি তিনি ন্যায়বিচারক এবং অন্যায়ের শাস্তিদাতাও বটে। তাই আমরা যেন আল্লাহর দয়া ও ক্ষমাশীলতার কথা ভেবে কাজে কর্মে অবিবেচক না হয়ে পড়ি। প্রতিটি কাজ ও আচরণের ক্ষেত্রে আল্লাহকে স্মরণ করা ও আল্লাহ আমার এ কথায় সন্তুষ্ট হবেন কিনা বা আমার এ কাজে সন্তুষ্ট হবেন কিনা তা ভেবে দেখা হল তাকওয়ার দাবি। অন্য কথায় তাকওয়া মানে আল্লাহকে ভয়ও করা আবার তার দয়া ও ক্ষমারও আশা রাখা।
তাকওয়া খুব বড় সম্পদ। কিন্তু ব্যাপক প্রচেষ্টা ও সাধনা ছাড়া তাকওয়া অর্জন করা যায় না। রোজা হচ্ছে এই তাকওয়ারই অনুশীলন। তাকওয়া হচ্ছে আত্মরক্ষার সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
যারা তাকওয়া অর্জন করেন আল্লাহ তাদের জন্য মানুষের মনে শ্রদ্ধা সৃষ্টি করে দেন এবং তাদের অন্য অনেক নেয়ামতও দান করতে থাকেন। এক সময় মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের নাম নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল উমাইয়া ও আব্বাসিয় চক্র। কিন্তু তাকওয়ার কারণে তাঁরা আজও সব মুসলমানের কাছে গভীর শ্রদ্ধার পাত্র।
সম্মান ও মর্যাদা আসে মহান আল্লাহর তরফ থেকেই। ক্ষমতা, অর্থ ও সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি -এসব কিছুর মালিকই হলেন আল্লাহ। তাই যারা আল্লাহর বন্ধু ও পরহিজগার বা তাকওয়ার অধিকারী তারা সহজেই এসবের মালিক হতে পারেন। তবে তাকওয়ার পরীক্ষায় পাস করার পরই আল্লাহর এইসব নেয়ামতের ফল্গুধারা খুলে দেয়া হয়। তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তি এই পরীক্ষাগুলোকেও মহান আল্লাহর দয়া মনে করেন। কারণ আল্লাহ যাদেরকে ভালবাসেন না তাদেরকে এ ধরনের পরীক্ষাও দেন না।
তাকওয়ার অধিকারীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে যাকাত, সদকা ও নানা ধরনের দান খয়রাত করা। এ সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব পরবর্তী অনুষ্ঠানে।

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/ ৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।