এপ্রিল ১২, ২০২৩ ২৩:০৬ Asia/Dhaka

আপনার কী হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরে যায়। বসা থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যায়? মাইল্ড স্ট্রোকের লক্ষণ এসব। এমন লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যেতে একদম দেরি করবেন না।

সুপ্রিয় শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ।  আশা করছি সবাই ভালো আছেন ও সুস্থ আছেন। স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল একথা দিয়ে আমরা স্নায়ুরোগ বা নার্ভের রোগ নিয়ে পঞ্চম পর্বের আলোচনায় যাব। আর আমাদের সঙ্গে যথারীতি আছেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহ দিদার ইমাম। তিনি মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তো আমরা আজকের আলোচনা শুরু করছি।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে স্নায়ুরোগ কী সে সম্পর্কে পুরনো আলোচনা থেকে তুলে ধরছি। মানবদেহ কোনও অলৌকিকতার চেয়ে কম নয়। আমাদের শরীর জটিল এবং অবিশ্বাস্য সিস্টেম দ্বারা গঠিত, এর অবিশ্বাস্য কার্যকলাপ চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে। এইরকম একটি সিস্টেম হল মানব দেহের স্নায়ুতন্ত্র। কোটি কোটি স্নায়ু কোষ এবং নিউরোনের সাহায্যে আমাদের দেহ আমাদের প্রতিদিনের স্বেচ্ছামূলক এবং অনিচ্ছাকৃত ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করতে সহায়তা করে।

স্নায়ুরোগ হলে কি হয়?

স্নায়ুতন্ত্রের যদি কোনও সমস্যা হয় তাহলে একজন ব্যক্তির চলাফেরা, কথা বলা, গিলে ফেলা, শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে হান্টিংটন রোগ, মাইগ্রেনস, ডিজেনারেটিভ ডিজিজ, মৃগী, ব্রেন টিউমার এবং মেনিনজাইটিসসহ ৬০০ টিরও বেশি স্নায়ু সম্বন্ধীয় রোগ রয়েছে। এবার মূল আলোচনায় যাচ্ছি।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

জনাব ডা. শাহ দিদার ইমাম রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: স্নায়ুরোগ কী, এর ধরণ লক্ষণ কী, বয়সভেদে এবং নারী পুরুষভেদে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার তারতম্য এসব বিষয়ে আপনি খুব সুন্দর করে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন। তো আজ পঞ্চম পর্বের আলোচনার শুরুতে জানতে চাইব-স্নায়ুরোগের ঝুঁকি কতটা বা এটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না?

ডা. শাহ দিদার ইমাম: দেখুন, স্নায়ুরোগ অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ আবার অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম থাকে। মহান আল্লাহতায়ালা আসলে আমাদের দেহকে এমনভাবে গঠন করে সৃষ্টি করেছেন সেগুলো আমরা জানিনা বিধায় আমরা বুঝিনা।

অনেক সময় রোগীর মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে যায় অথচ রোগীরা তাকে পাত্তা দেয় না। আবার সে অটোমেটিক ভালো হয়ে যায়। তবে এই ভালো হয়ে যাওয়াটা তার জন্য ভালো তা কিন্তু না। সাময়িকভাবে সে হয়তো ভালো হচ্ছে কিন্তু পরবর্তীতে কিন্তু আবার স্ট্রোক নিয়ে সে আসতে পারে এবং তখন কিন্তু মৃত্যু ঝুঁকি থেকে যায়। ফলে মাইল্ড স্ট্রোক হলে রোগীরা যে পাত্তা দেয় না, চিকিৎসকের কাছে আসতে চায় না বা স্ট্রোকের কারণটা কি  তা নির্ণয় করে না।

মাইল্ড স্ট্রোক

স্ট্রোক বলতে সাধারণত মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাকে বুঝানো হয়। এটা দুই ধরনের হয়, একটা রক্তক্ষরণ জনিত বা হেমোরেজিক স্ট্রোক এবং আরেকটি হলো স্কিমিক স্ট্রোক, এতে রক্তক্ষরণ হয় না।  মাইল্ড স্ট্রোক, স্কিমিক স্ট্রোক ও হেমোরেজিক স্ট্রোক- কি সে সম্পর্কে একটু জানিয়ে রাখি। মাইল্ড স্ট্রোকে রোগীর মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ সাময়িক বন্ধ হয়ে আবারও চালু হয়। এটি মূলত বড় ধরণের স্ট্রোকের পূর্ব লক্ষণ। স্কিমিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কের ও শরীরের অন্যান্য স্থানের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধে।

স্কিমিক স্ট্রোকের কারণ হলো, মস্তিষ্কে যে রক্ত যায় তা ক্যারোটিড আর্টারী অর্থাৎ গলার ভেতর দিয়ে যায় যে সব রক্তনালী, তাতে চর্বি জমে। যে কারণে রক্তনালী সংকীর্ণ হয়ে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। এর ফলে স্কিমিক স্ট্রোক হয়। এই স্ট্রোক কত বড় হবে বা ক্ষয়ক্ষতি কত ব্যাপক হবে, তা নির্ভর করবে, রক্তনালী কতটা সংকীর্ণ হয়েছে, তার ওপর।

 ট্রানজিয়েন্ট স্কিমিক অ্যাটাক বা মাইল্ড স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণ হলো, অল্প সময়ের জন্য কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। সেটি ১৫ সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরতে পারে। বসা থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরতে পারে। আর পরের দিকে, যখন সেরিব্রাল ইনফ্লাক্স হয়ে যায়, তখন রোগী অচেতন হয়ে পড়তে পারে। অবস্থা আরো খারাপ হলে সেই সঙ্গে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়া এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। অন্যদিকে, হেমোরেজিক স্ট্রোকের লক্ষণ নির্ভর করে মস্তিষ্কে কতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে তার ওপর।

যদি অল্প রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে মাথাব্যথা, ভার্টিগো বা মাথা ঘোরা থাকবে। রক্তক্ষরণের পরিমাণ একটু বেশি হলে শরীরের কোন একটি অংশ অবশ হয়ে যেতে পারে।

প্রাথমিকভাবে যদি দেখা যায় কোন আপাত সুস্থ মানুষ হঠাৎ হাঁটাচলায় ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, অথবা মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে, অথবা যদি দেখা যায় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরের কোন অংশ হঠাৎ অবশ হয়ে গেছে,তাহলে বুঝতে হবে তার মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। এছাড়া হয়ত দেখা যাবে কেউ হঠাৎ হাত বা পা নাড়াতে পারছে না, কিংবা মুখটা এক পাশে বাঁকা হয়ে গেছে।

করণীয় কী?

লক্ষণগুলো দেখা মাত্র দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এরপর সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করে দেখতে হবে এটা কি স্কিমিক স্ট্রোক না হেমোরেজিক স্ট্রোক। এক্ষেত্রে ডায়াগনোসিস বা রোগ নির্ণয় খুব জরুরি। যত আগে চিকিৎসা শুরু হবে, রোগীর সুস্থ হবার সুযোগ তত বেশি থাকবে।

আমাদের দেশে স্ট্রোকের মূল কারণ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ। আর এই দুটো রোগের জটিলতা এমন যে অনেক রোগী নিজেও জানে না সে ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। রোগীরা এই দুটি রোগকে অবহেলা করে। তারা চিকিৎসা না নেয়ার কারণে একসময় বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনে। যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন রোগী আসে চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু দেখা যায় তখন অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে রোগীর। ফলে এসব ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা অনেক বেশি।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা ডা. শাহ দিদার ইমাম, স্নায়ুরোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা কীভাবে করা হয়? কোথায় যাবেন রোগীরা এবং তার জন্য ব্যয়ও বা কিরকম?

ডা. শাহ দিদার ইমাম: ধন্যবাদ আপনাকে। স্নায়ুরোগের ক্ষেত্রে প্রধানত আমরা স্ট্রোকের রোগী বেশি পাই। তাছাড়া মৃগীরোগ ও প্রচুর মাথা ব্যথার রোগীও পাওয়া যায়। আর মাথা ব্যথার কারণ হিসেবে ব্রেন টিউমারের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু যারা মাথা ব্যথায় ভোগেন তাদের মধ্যে একটা সন্দেহ দেখা যায় যে হয়তো মাথার মধ্যে কোনো সিরিয়াস রোগ হয়েছে। হয়তোবা ব্রেন টিউমার হয়েছে। এখন রোগী যে ব্রেন টিউমারে ভুগছেন না বা তার ব্রেন টিউমার না এটি অনেক সময় বলাটা কষ্টকর হয়ে যায় আর তখন পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে সিটি স্ক্যান করানো হয়। ব্রেনের সিটি স্ক্যান করা লাগে।

স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা.শাহ দিদার ইমামের আলোচনা শুনছেন। আমাদের সঙ্গেই থাকুন। ফিরছি শিগগিরি।

রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। আচ্ছা আপনি সিটি স্ক্যানের কথা বলছিলেন এই সিটি স্ক্যান কি সবখানে করা সম্ভব এখন?

ডা. শাহ দিদার ইমাম: জ্বি আশার কথা হলো যে সিটি স্ক্যান মেশিন এখন আমাদের দেশে থানা পর্যায়েও চলে গেছে। প্রতিটি জেলা পর্যায়ে তো আছেই। যদিও কিছুটা ব্যয়বহুল কিন্তু আমরা খুব সহজেই সিটি স্ক্যান করে ব্রেন টিউমার কিংবা স্ট্রোকের রোগীগুলোকে আমরা বুঝতে পারি।

স্ট্রোকের রোগীর ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিষয় হতে পারে। একটা হচ্ছে মাথায় রক্তক্ষরণ আরেকটি হচ্ছে মাথায় রক্ত জমাট বেধে যাওয়া। আর প্রকারভেদে স্ট্রোকের রোগীর ম্যানেজমেন্ট বা চিকিৎসা পদ্ধতি আলাদা।

রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকে ভুগছেন যে রোগী তাকে যদি সেই অনুযায়ী চিকিৎসা না দিয়ে রক্তজমাট বাধা স্ট্রোকের চিকিৎসা দেয়া হয় তখন রক্তক্ষরণ আরো বেশি হবে। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। যে কারণে আমরা যারা নিউরোলজিস্ট বা মেডিসিনের ডাক্তার আমরা স্ট্রোকের রোগীদের ম্যানেজমেন্ট দিয়ে থাকি তবে তার আগে নিশ্চিত হয়ে নেই যে এটি কি রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক নাকি রক্তজমাট বাধাজনিত স্ট্রোক। ফলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিটি স্ক্যান করতেই হবে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয়ের জন্য। এছাড়া বল্লাম যারা দীর্ঘদিন ধরে মাথা ব্যথায় ভুগছেন তাঁদের মনে যে সন্দেহ আছে যে ব্রেন টিউমার হলো কি না বা ব্রেনের কোনো জটিল রোগে ভুগছেন কি না যে কারণে তার মাথা ব্যথা কমছে না সেজন্যও আমরা সিটি স্ক্যান করে থাকি।

তো অধ্যাপক ডা. শাহ দিদার ইমাম, স্নায়ুরোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা বিষয়ে এবং ঝুঁকি নিয়ে পঞ্চম পর্বে রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ। আর শ্রোতাবন্ধুরা! স্নায়রোগ নিয়ে যেসব আলোচনা করলেন এ পর্যন্ত অধ্যাপক শাহ দিদার ইমাম তাতে আমাদের বেশিরভাগ রোগ দেখা যাচ্ছে স্নায়ুজনিত কারণে হচ্ছে। স্ট্রোক, হাত পা অবশ হয়ে যাওয়া, মুখ বেকে যাওয়া, হাত পা দুর্বল হয়ে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া,  কোমায় চলে যাওয়া, মৃগিরোগ-এসবই স্নায়ু বা নার্ভের রোগ। তাই এই স্নায়ুরোগ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। যে কোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং চিকিৎসা নিতে হবে।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১২


 

ট্যাগ