পবিত্র বলতে দৈহিক ও আত্মিক উভয় ধরনের পবিত্রতাকেই বোঝায়
আসমাউল হুসনা-৯৮ (ত্ব'হির নামের তাৎপর্য)
মহান আল্লাহ'র আসমায়ুল হুসনার তালিকাভুক্ত আরও একটি নাম ত্ব'হির طاهر। মহান আল্লাহর এই নাম ত্ব'হির অর্থ পবিত্র। মহান আল্লাহ তাঁর পছন্দের মানুষকে বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করেন। আত্মিক পবিত্রতা বলতে বোঝায় অনৈতিকতার কদর্যতা ও দূষণ থেকে আত্মাকে পবিত্র করা।
নানা রূপান্তরসহ মহান আল্লাহর এই নাম তথা ত্বহির শব্দটি পবিত্র কুরআনে ৩১ বার এসেছে। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদেরকে সব ধরনের চরমপন্থা থেকে পবিত্র হওয়ার বিষয়টি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যাতে তারা ভারসাম্যপূর্ণ জীবন অর্জন করতে পারেন। যেমন, মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের মনকে দানশীলতার দিকে ঝুঁকিয়ে দেন এবং কৃপণতা ও অপব্যয় হতে পবিত্র করেন। অন্যদিকে তিনি তাদেরকে বীরত্বের গুণও দান করেন এবং নানা বিষয়ে পরোয়াহীনতা ও কাপুরুষতা থেকেও আল্লাহ তাদের পবিত্র করেন। যে যত বেশি পাপাচার থেকে মুক্ত থাকবে সে তত বেশি পবিত্র হবে।
মহান আল্লাহ পবিত্র। তাই তিনি পবিত্রতামুখী মানুষকে বেশি পছন্দ করবেন-এটাই স্বাভাবিক। মহানবী-সা. বলেছেন, হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর গুণগুলোর প্রতিফলন গড়ে তোলো তোমাদের মধ্যে। -অন্য কথায় মানুষের উচিত খোদায়ি নৈতিকতার সাজে নিজেদের সজ্জিত করা।
মানুষের পবিত্র হওয়ার রয়েছে নানা পর্যায়। পবিত্রতম মানুষেরা হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত। মহান আল্লাহ সুরা আহজাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে মহানবীর -সা. আহলে বাইতকে সকল পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখার ও পবিত্র রাখার ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেছেন। আর মহান আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা অবশ্যই বাস্তবায়ন হয়।-মহানবীর আহলে বাইত ও পবিত্র কুরআন উভয়ই পবিত্র তথা ভুল-ত্রুটি ও বিচ্যুতি থেকেও মুক্ত। তাই এ দুই অস্তিত্ব পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা দিতে অন্য কেউ সক্ষম নন। তাই মহানবী-সা ও তাঁর আহলে বাইতের পবিত্র হওয়া তথা ভুল-ত্রুটি আর পাপ থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টি ছিল অপরিহার্য।
কেবল পবিত্ররা পবিত্র কুরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী হবেন ও এর ব্যাখ্যা জানবেন-এ বাস্তবতা সুরা ওয়াক্বিয়ার ৭৭ থেকে ৭৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে:
নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে এক গোপন কিতাবে, যারা পাক-পবিত্র, তারা ছাড়া অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না তথা তারা ছাড়া অন্য কেউই এর রহস্যগুলো ও বাস্তবতার নাগাল পাবে না।-মহানবীর যুগে অনেকেই এটা জানতো যে পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু সত্য গ্রহণ করতে তারা প্রস্তুত ছিল না অন্ধ-বিদ্বেষ ও গোঁড়ামির কারণে। অন্যদিকে যারা সামান্য মাত্রায় হলেও নিজেদের পবিত্র করেছিলেন তারা সত্য-সন্ধানী ও জ্ঞান-পিয়াসি হওয়ায় কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সুপথ লাভ করেন। মোট কথা যে ব্যক্তি যত বেশি পবিত্র ও খোদাভীরু হবেন তিনি ততই কুরআনের গভীর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করবেন ও কুরআন থেকে হবেন বেশি মাত্রায় উপকৃত। তাই সুরা ওয়াক্বিয়ার ওই আয়াতে পবিত্র বলতে দৈহিক ও আত্মিক উভয় ধরনের পবিত্রতাকেই যে বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট।
কুরআন শরীফের আয়াত স্পর্শ করার আগে কেবল ওজু-গোসল বা তায়াম্মুমই যথেষ্ট নয় মনকেও পবিত্র করতে হবে। মহানবী-সা, তাঁর পবিত্র আহলে বাইত, নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ হলেন আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তারা কুরআনের বাস্তবতাগুলো অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি হৃদয়ঙ্গম করেছেন।
ইসলামের বাহ্যিক পবিত্রতার বিধান অনুযায়ী পোশাক, শরীর ও খাবার ইত্যাদি পাক-পবিত্র হতে হবে ইসলামী আইন বা বিধানের শর্তগুলো পূরণ করার মাধ্যমে। যেমন,একটি হাসপাতালে কারো রক্ত মেঝে বা প্রকাশ্য স্থানে পড়ে গেলে সামান্য পানি ও জীবাণুনাশক তরল দ্রব্য বা পাউডার ছিটিয়ে দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু ইসলামী বিধান অনুযায়ী ওই স্থানকে সর্বোচ্চ মাত্রায় পবিত্র করতে তিন বার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। মহান আল্লাহ সুরা মায়েদায় অজু ও গোসলের বিধান বর্ণনার পর বলেছেন, আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান।
ইসলামী নানা বর্ণনা অনুযায়ী মানুষের পোশাক ও শরীরের বাহ্যিক পবিত্রতার সঙ্গে তাদের আত্মিক পবিত্রতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, ইমাম জাফর আস সাদিক্ব(আ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, শুক্রবারের গোসল এক শুক্রবার থেকে পরের শুক্রবার পর্যন্ত সব গোনাহ বা পাপ মুছে দেয়। তাই ওজু ও গোসলের মাধ্যমে বাহ্যিক যে পবিত্রতা অর্জন করা হয় তা আত্মারও পবিত্রতার প্রাথমিক পর্যায়। আত্মিক পবিত্রতার কারণেই মানুষের ইবাদত ও সৎকর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
মহান আল্লাহ সুরা শামস্-এ বেশ কয়েকটি বিষয়ের শপথ নেয়ার পর বলেছেন, যে নিজেকে শুদ্ধ বা পবিত্র করে, সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত তথা অপবিত্র করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।– এ আয়াত থেকে বোঝা যায় আত্মাকে পবিত্র করা শরীরকে পবিত্র করার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই যত কষ্টসাধ্য ও পরিশ্রমের ব্যাপারই হোক না কেন মানুষের মন বা ভেতরটাকে সব ধরনের কদর্যতা ও কলুষতা হতে পবিত্র করার পদক্ষেপ নিতে হবে। যে পানি অপবিত্র হয়ে গেছে নাপাক জিনিসের সংস্পর্শে তা পানযোগ্য নয় এবং তা দিয়ে ওজু গোসল করা যায় না। তদ্রূপ যে পোশাক অপবিত্র তা দিয়েও নামাজ পড়া যায় না।
যে পোশাক হারাম অর্থে কেনা বা চুরি করে আনা তা দিয়ে নামাজ আদায় করলে বা দখল করা জমিতে নামাজ আদায় করলে তা শুদ্ধ হবে না।- মুশরিকদেরকে পবিত্র কুরআনে অপবিত্র বলা হয়েছে। (সুরা তওবা, ২৮ দ্র.) মুশরিকরা নিজ প্রভুকে না চিনে বা তাকে স্বীকৃতি না দিয়ে অন্য প্রভুর ওপর ভরসা করে বলেই মুশরিক ও অপবিত্র। মক্কার মুশরিকরা জানতো যে মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রাসুল। অন্য নবী-রাসুলদের মত তিনিও সমাজে উচ্চতর কোনো কোনো মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু মুশরিকরা এসব মূল্যবোধ ও ইসলামের প্রভাব বিস্তারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয় যুদ্ধ ও অবরোধ এবং মহানবীকে হত্যার প্রচেষ্টাও চালায়। তাই এ ধরনের ব্যক্তিরা অবশ্যই নাপাক। যারা নবী-রাসুল ও খোদায়ি শিক্ষকদের প্রচারকার্যে বাধা দেয়; সমাজকে নৈতিক বিচ্যুতি ও সামাজিক দুর্নীতি থেকে মুক্ত করার নবুওতি মিশনকে সফল হতে দিতে চায় না এবং মানুষকে ইট, কাঠ ও পাথর-পূজা, ব্যভিচার আর অশ্লীলতা থেকে মুক্ত করার কাজে বাধা দেয় তারা অবশ্যই নোংরা ও অপবিত্র মানুষ। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।