বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাদ শিশু সন্তানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে
সুখের নীড়- পর্ব ৪৭ (সুস্থ ও নৈরাজ্যময় পরিবার)
হযরত আদম ও বিবি হাওয়া ছিলেন দুই পৃথক মানব সত্ত্বা। কিন্তু মহান আল্লাহ তাদের জন্য প্রশান্তির ব্যবস্থা করেছেন বিয়ে ও পরিবার গঠনের মাধ্যমে।
এভাবে মানবজাতিকে বোঝানো হল যে পরিবার গঠন ছাড়া প্রশান্তি ও মানবীয় পূর্ণতা অর্জন সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ নর ও নারীর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন ঠিক এ কারণেই যাতে বিশ্ব জগতে মানব-ধারা বা মানব-প্রজন্ম টিকে থাকে। যে নারী ও নর এক সময় ছিল পরস্পরের পুরোপুরি অপরিচিত তারাও বিয়ের পর হয়ে পড়েন পরস্পরর প্রতি গভীর অনুরাগী ও আবেগপ্রবণ এবং পরস্পরের প্রশান্তির মাধ্যম। এ বিষয়টি যে মহান আল্লাহর অন্যতম ক্ষমতার নিদর্শন তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিয়েকে পবিত্র কুরআনে সুদৃঢ় অঙ্গীকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা নিসার ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: স্ত্রীরা তোমাদের কাছে থেকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে। মহানবী (সা) বলেছেন, ইসলামের কোনো দিক বা অংশই মহান আল্লাহর কাছে বিয়ে তথা পরিবার গঠনের চেয়ে বড় নয়।
দুঃখজনকভাবে পাশ্চাত্যের জীবন-ব্যবস্থায় পরিবার প্রথা মারাত্মক হুমকির মুখে। ফলে সেখানে বাড়ছে সামাজিক সংকট। বাড়ছে তালাক, একাকীত্ব, লিভ-টুগেদার নামক ব্যভিচার ও সমকামিতা। পশ্চিমা লেখক উইলিয়াম গার্ডনার 'পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নামক বইয়ে লিখেছেন: স্বা মী ও স্ত্রী বিয়ের সময় পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন বলে অঙ্গীকার করেন যা বিয়ের সবচেয়ে অর্থবহ মুহূর্ত! এই ওয়াদার অর্থ হল তারা ভালবাসাকে অবিশ্বাস থেকে মুক্ত রাখবেন এবং তা হবে পরিবার, সমাজ ও আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর লক্ষ্যগুলোর জন্য নিবেদিত! কিন্তু পরিবারের বিরুদ্ধে যেসব আগ্রাসন চালানো হচ্ছে তাতে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার পবিত্রতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!
গবেষণায় দেখা গেছে সন্তানরা নানা বিষয়ে বাবার চেয়েও মায়ের কাছ থেকেই নানা বিষয়ে শিক্ষা নেয় বা মায়ের অনুসরণই বেশি করে। এ ছাড়াও তারা বড় ভাই ও বড় বোন থেকেও অনেক কিছু শেখে। তাই সন্তানদের সুশিক্ষিত করার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সাফল্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানরা খোদাভীতি ও আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিও শেখে বাবা-মায়ের কাছ থেকে। গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি কোনো কোনো পরিবার সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে খুব কঠোরতা অথবা খুব বেশি শৈথিল্য বা স্বাধীনতা দিয়ে রাখেন। এ দুয়ের বাইরে এমন পরিবারও রয়েছে যেসব পরিবার নৈরাজ্য ও অনৈক্যের শিকার। এ ধরনের পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাদ শিশু সন্তানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কখনও কখনও এমন পরিবারের শিশু সন্তান হন বাবা-মায়ের জন্য বিচারক। কখনও শিশু সন্তান হয় এ ধরনের পরিবারে বাবা-মায়ের বিবাদের বলি। এ ধরনের পরিবারে শিশুরা মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে অপূর্ণ থেকে যায় এবং ধীরে ধীরে সহিংসতাকামী হয়ে ওঠে।
নৈরাজ্যময় পরিবারের সদস্যদের চেহারা প্রায়ই থাকে রুক্ষ, দুঃখ-ভারাক্রান্ত, বিষণ্ণ এবং অনুভূতিহীন। এমন পরিবারের সদস্যরা একে-অপরের কথাকে গুরুত্ব দেয় না এবং তারা পরস্পর উচ্চ-স্বরে কর্কশ ভাষায় কথা বলে অথবা তাদের কথা এমন লাগাতার বকবকানি ধরনের যা বুঝতে হলে খুব কষ্ট করে কান পেতে শুনতে হয়। এ ধরনের পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ, লক্ষ্যহীন, আত্মপরিচিতিহীন, হতাশ, অপরাধী, মাদকাসক্ত ও অসামাজিক হয়ে বেড়ে ওঠে। বলা হয় প্রতি একশতটি পরিবারের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক পরিবার জানে যে তাদের কি করা উচিত এবং তারা সঠিক জীবন-পদ্ধতি অবলম্বন করে সুস্থতা ও উল্লেখযোগ্য উন্নতির পর্যায় আয়ত্ত করে। এ ধরনের পরিবারকে বলা হয় শক্তিশালী ও সুস্থ পরিবার। এ ধরনের পরিবারে শিশুদের নির্ভরযোগ্য ও সুদৃঢ় পন্থায় স্বাধীন রাখা হয় এবং শিশুদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে উৎসাহ দেয়া হয়। অবশ্য স্বাধীনতা দেয়ার পাশাপাশি কিছু সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণও আরোপ করেন বাবা-মা। এ ধরনের পরিবারে শিশুদের সঙ্গে মা-বাবার মত-বিনিময়ের অনেক সুযোগ রয়েছে। মা-বাবা এমন পরিবারে শিশুদের প্রতি খুবই আন্তরিক ও যত্নশীল থাকেন। শিশুদের কোলে নেয়া ও আদর করে জড়িয়ে ধরা এমন পরিবারের স্বাভাবিক দৃশ্য।
সুস্থ পরিবারে মা-বাবা শিশুদের কোনো বিষয়ে নিষেধ করতে চাইলে সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন বা ভালোভাবে এর কারণ বুঝিয়ে দেন। এ ধরনের পরিবারে কে কোন কাজ করবে তা আগেই বলে দেয়া হয়। সম্পদ বণ্টন, আসা-যাওয়া, জীবন-যাপন পদ্ধতি ইত্যাদি নানা জরুরি বিষয়ে সুস্থ পরিবারে মত-বিনিময় ঘটে এবং যৌক্তিক ও যথাযোগ্য সমাধানকে সবাই মেনে নেন। এমন পরিবারে সবাই আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলেন এবং কেউ নিরব থাকলেও তা ভয় বা বিপদ এড়ানোর ভাবনা থেকে করা হয় না।শিশুদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হলে তাদের স্বাধীন চিন্তা ও আত্মবিশ্বাস জোরদার হবে এবং তা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশের সহায়ক হবে। এমন শিশু অন্য শিশুদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয় এবং এতে তার মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। এ ধরনের পরিবারের শিশুরা অন্য পরিবারের শিশুদের চেয়ে পড়াশুনায় বেশি সফল হয় এবং তাদের বুদ্ধিমত্তা, কৌতূহল ও সৃষ্টিশীলতাও অন্যদের চেয়ে বেশি হয়।
আপনি বাইরে যতই সম্মানিত, মহাব্যস্ত ও কর্ম-ক্লান্ত হন না কেন যখন পরিবারে বা ঘরে ফিরবেন তখন আপনাকে হতে হবে প্রফুল্ল এবং বিনোদনকামী ও হাস্য-রসিক। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে খেতে বসুন এবং একই পরিবেশে একই ধরনের খাবার খান। পরিবার পরিচালনার মানে এই নয় যে পরিবারকে সেনা-ঘাঁটিতে পরিণত করবেন। এখানে পরিচালনা বা নেতৃত্ব হতে হবে নৈতিক ও স্নেহশীলতায় ভরপুর। যৌক্তিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষামূলক ও ধর্মীয় বিষয়ে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি স্নেহের নেতৃত্ব দানেও হতে পারে পারদর্শী।আপনার স্ত্রী ও সন্তানরা আপনার প্রফুল্লতা বা হাস্য-রসিক মুখ দেখার জন্য কখনও উন্মুখ হয়ে থাকেন এবং সন্তানরা আপনাকে সঙ্গে নিয়ে খেলতে ও হাসি-তামাসায় মত্ত হতে চায়। বড় বড় সম্মানিত ব্যক্তি ও মহাপুরুষরাও সন্তানকে খুশি করতে নিজে ঘোড়া হয়ে সন্তানকে করেছেন সাওয়ারি বা যাত্রী যাতে তারা হয় আনন্দিত। পরিবারের সদস্যদের কেবল রুটি, খাবার ও থাকার জায়গা দেয়াই যথেষ্ট নয়। তাদেরকে মানসিকভাবে প্রফুল্ল রাখাও আপনার দায়িত্ব। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।