কুরআনের আলো
সূরা আস- সফ: ৭-১৪ (পর্ব-২)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা সফের ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৭ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন শুরু করব। প্রথমেই সূরাটির ৭ থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক।
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُوَ يُدْعَى إِلَى الْإِسْلَامِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (7) يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ (8) هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ (9)
“আর সে ব্যক্তির চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে? অথচ তাকে ইসলামের দিকে আহবান করা হয়। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।” (৬১:৭)
“তারা তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর নূরকে পূর্ণতাদানকারী, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।” (৬১:৮)
“তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীন দিয়ে [মানুষের কাছে] প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (৬১:৯)
আল্লাহর নবী হযরত ঈসা (আ.) তাঁর পর যে আরেকজন নবী আসবেন সেকথা তাঁর উম্মতকে জানিয়েছিলেন। গত আসরে আমরা সে প্রসঙ্গে কথা বলেছি। এরপর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: আহলে কিতাবদের কাছে যখন সর্বশেষ নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) দ্বীনের দাওয়াত দেন তখন তাদের একাংশ আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে বলে: আল্লাহ তোমাকে নবুওয়াত দেননি। এই আচরণের মাধ্যমে তারা আল্লাহর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয় এবং নিজেদের প্রতি জুলুম করে।
এ ধরনের মানুষ ভাবে, আল্লাহর নূর মোমবাতির মতোই হীনবল এবং তারা মুখের ফুঁৎকারে সে আলো নিভিয়ে ফেলতে পারবে। অথচ আল্লাহ তায়ালা স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশ্বনবীর মাধ্যমে তিনি তাঁর হেদায়েতের নূর সূর্যের আলোর মতো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবেন এবং সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করবেন। আর এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহর সিদ্ধান্ত ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কারো নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিগত ১৪শ’ বছর ধরে সকল প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ইসলাম সামনের দিকে এগিয়ে গেছে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে মুসলমানের সংখ্যা প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- মানবতার প্রতি সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে, আল্লাহর বাণী মানুষের কানে পৌঁছে দিতে বাধা প্রদান করা এবং মানব সমাজে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।
২- পবিত্র কুরআনের ভাষায় দ্বীনে ইসলাম হচ্ছে নূর বা আলোর সমতুল্য।
৩- ইসলামের শত্রুরা সব সময় হেদায়েতের আলো নিভিয়ে ফেলার চেষ্টা করে এবং এই কাজে তারা যেকোনো উপায় অবলম্বনে দ্বিধা করে না।
৪- সকল ধর্মের মধ্যে একমাত্র ইসলাম চিরস্থায়ী ধর্ম এবং এর সত্যতাই অন্য ধর্মগুলোর ওপর এর আধিপত্যের কারণ।
৫- নিঃসন্দেহে মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয় আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত। কাজেই কাফির ও মুশরিকদের সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবেই।
এবারে এই সূরার ১০ থেকে ১৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ (10) تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (11) يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (12) وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ (13)
“হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে রক্ষা করবে [পরকালের] যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে?” (৬১:১০)
“[তা এই যে,] তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য শ্ৰেয় যদি তোমরা জানতে!”(৬১:১১)
“[এটা করতে পারলে] আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন [জান্নাতের] বাগানে যার [বৃক্ষরাজির] পাদদেশে নদী প্রবাহিত, এবং স্থায়ী জান্নাতের উত্তম বাসগৃহে। এটাই মহাসাফল্য।”(৬১:১২)
“এবং [তিনি দান করবেন] আরও একটি অনুগ্রহ, যা তোমরা পছন্দ কর। [আর তা হলো] আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও আসন্ন বিজয়; আর [হে নবী!] আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিন।”(৬১:১৩)
আগের আয়াতগুলোতে ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুদের ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা হয়েছে। এরপর এই আয়াতগুলোতে মুমিন মুসলমানদেরকে শত্রুদের মোকাবিলায় তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে বলা হচ্ছে: তোমরা যখন ঈমান আনা এবং নিজেদেরকে রাসূলের অনুসারী বলে দাবি করছ তখন আল্লাহর দ্বীন রক্ষার্থে জিহাদে অংশ নাও। আর এই জিহাদে অংশ নিতে গিয়ে নিজেদের জান ও মাল উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করো না। জেনে রেখো, আল্লাহর রাস্তায় তোমরা যা উৎসর্গ করছো তা আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মূল্যে কিনে নিচ্ছেন।
ইসলামের শত্রুরা যদি ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করতে সকল পন্থা অবলম্বন করে থাকে তাহলে তোমরাও তাদের মোকাবিলায় তোমাদের সকল অবলম্বন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। জেনে রেখো, তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ তোমাদের প্রচেষ্টা ও জিহাদের ওপর নির্ভর করছে। যদি নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করো তাহলে পার্থিব জীবনে আল্লাহর সাহায্য পাবে এবং কিয়ামতের কঠিন দিনে তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন। তোমরা জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে এবং চিরস্থায়ী সুখের আবাস জান্নাতে প্রবেশ করবে।
এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- ব্যবসা শুধুমাত্র বস্তু এবং পার্থিব জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আল্লাহ এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষদের সঙ্গে লেনদেন একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এই ব্যবসায় পার্থিব জীবনেও লাভবান হওয়া যায় এবং আখিরাতেও চিরস্থায়ী সুখের আবাস জান্নাত লাভ করা সম্ভব।
২- মুমিন ব্যক্তিদেরকে নিজেদের ঈমান রক্ষা করার পাশাপাশি আল্লাহর দ্বীন রক্ষার্থে নিজেদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এখানে প্রস্তুতিটি গুরুত্বপূর্ণ। সব সময় জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু প্রয়োজনের সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করতে কুণ্ঠাবোধ করা যাবে না।
৩- আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী মুজাহিদগণ এই দুটি নেকির যেকোনো একটি লাভ করবেন। হয় তারা শহীদ হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন যা হচ্ছে মহা সাফল্য। অথবা আল্লাহর ইচ্ছায় জিহাদে বিজয়ী হবেন। এটিও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
৪- মুমিন ব্যক্তির কাছে তার জীবন ও সম্পদের চেয়ে দ্বীন রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে তিনি যেকোনো সময় জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকেন।
এবারে সূরা সফের শেষ আয়াত অর্থাৎ ১৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
ونُوا أَنْصَارَ اللَّهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّينَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللَّهِ فَآَمَنَتْ طَائِفَةٌ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَكَفَرَتْ طَائِفَةٌ فَأَيَّدْنَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَى عَدُوِّهِمْ فَأَ (14)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর [দ্বীনের] সাহায্যকারী হও, যেমন মার্ইয়াম-পুত্র ঈসা [স্বীয় বিশেষ সঙ্গী] হাওয়ারীগণকে বলেছিলেন, আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী হবে? হাওয়ারীগণ বলেছিলেন, আমরাই আল্লাহর [দ্বীনের] সাহায্যকারী। তারপর বনী ইসরাঈলের একদল ঈমান আনল এবং একদল কাফের হয়ে গেল। তখন যারা ঈমান এনেছিল, শক্ৰদের মুকাবিলায় আমি তাদেরকে শক্তিশালী করলাম, ফলে তারা বিজয়ী হলো।” (৬১:১৪)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মুমিনদেরকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে উৎসাহিত করে বলা হচ্ছে: জীবনের সর্বক্ষেত্রে তোমাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত যে, আল্লাহ আমাদের মতো মানুষদের সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহকে সাহায্য বলতে এখানে আল্লাহর দ্বীন ও নবী-রাসূলদেরকে সাহায্য করার কথা বোঝানো হয়েছে।
আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য দুই ভাগে বিভক্ত। এর একভাগে রয়েছে, বিশ্বব্যাপী দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটানো এবং এ কাজে প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করা। আর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে, ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করে সঠিক উপায়ে তাদের মোকাবিলা করা।
আয়াতের পরের অংশে আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করার একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলা হচ্ছে, হযরত ঈসা (আ.) তার বিশেষ ১২ জন সঙ্গী যাদেরকে হাওয়ারি বলা হতো তাদের কাছে সাহায্যের আহ্বান জানালেন। হাওয়ারিগণ আল্লাহর নবীকে সাহায্য করতে নিজেদের প্রস্তুতি ঘোষণা করলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কেউ কেউ আল্লাহর নবীকে সাহায্য না করে ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশেষ রহমতে শত্রুদের বিরুদ্ধে হাওয়ারিগণকে বিজয় দান করেছেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- ঈমান থাকা এবং তা রক্ষা করাই যথেষ্ট নয়। বরং ঈমানদারের দাবি করলে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের কাজে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
২- আমরা যদি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করি তাহলে আল্লাহও আমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে বিজয় দান করবেন।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ বাবুল আখতার/৩১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।