গল্প ও প্রবাদের গল্প:
সত্য কথা লেপের নীচে থেকে বলতে হয়
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: সত্য কথা লেপের নীচে থেকে বলতে হয়। গল্পটি এরকম:
প্রাচীনকালে এক রাজা ছিলেন যিনি দাবা খেলা খুব পছন্দ করতেন। সে কারণে যেখানেই তিনি অতিথি হিসেবে বেড়াতে যেতেন সবখানেই দাবার বোর্ড থাকতো। স্বাভাবিকভাবেই রাজা দাবা খেলা প্রতিযোগিতায় জয়ী হতেন। তিনি যেহেতু একজন ভাল দাবা খেলোয়াড় ছিলেন সে কারণে দাবাড়ু হিসেবে সবসময় গর্ব করতেন। শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা নিশ্চয়ই এ মুহূর্তে ভাবছেন রাজা খুব অহংকারী, তাই না? কিন্তু না। ব্যাপারটা মোটেও সেরকম ছিল না।
তাহলে কেমন ছিল? সত্যি বলতে কি! শাহ যেহেতু দাবা খেলা পছন্দ করতেন, তাই অন্যরা এমনভাবে খেলতো যেন তারা শাহের কাছে হেরে যায় এবং রাজা বিরক্ত না হয়ে আনন্দিত থাকে সবসময়। আসলে তিনি নিজে একজন দক্ষ দাবা খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু রাজার পারিষদের মধ্যে এমন একজন ছিল যে রাজার ওই আনন্দের ব্যাপারটিতে মনোযোগ দেয় নি। সে ছিল দরবারের সঙ মানে ভাঁড়। ভাঁড়ের কাজ ছিল রাজাকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে এবং মজার মজার কাজ করে হাসানো। এ কারণে ভাঁড় সারাক্ষণই রাজার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতো এবং এমন সব কাজ করতো যেন রাজা মজা পায়।
একদিন রাজা বিরক্ত হয়ে ভাঁড়কে বললেনঃ চল এক গেম দাবা খেলি। ভাঁড় বললো: এক শর্তে খেলতে পারি। রাজা বললেনঃ কী শর্ত? ভাঁড় বললঃ এই শর্তে যে আপনি যদি হেরে যান, বিরক্ত হতে পারবেন না। রাজা বললেন: আমি হেরে যাবো? তাও আবার তোমার কাছে? আমার সামান্য ভাঁড়ের কাছে? সকল পেশাদার ও ঝানু দাবাড়ুরা আমার সাথে খেলে হার মানে, আর তুমি ভাবছো আমি তোমার কাছে হেরে যাবো? ভাঁড় বললো: ঠিক আছে, এই নিন দাবার বোর্ড আর এই হলো গুটি। রাজা আর ভাঁড় খেলা শুরু করল। কিছুক্ষণ খেলার পর রাজার বুঝতে বাকি রইলো না যে তার চাল দেওয়ার কোনো উপায় নেই। ভাঁড় তখন হা হা করে হেসে দিয়ে একটা চাল দিয়ে বললো: 'চেক'।
রাজা তো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে সে হেরে যাবে! ভীষণরকম বিরক্ত হয়ে গেল এবং দাবার সব গুটি এক এক করে ভাঁড়ের মাথায় পেটালো। ভাঁড় ব্যথা পেয়ে আহ, উহ্ করলো সশব্দে। অবশেষে বললো: বলেছি না? হেরে গেলে বিরক্ত হতে পারবেন না? রাজা এবার নিজেকে সংযত করে বললো: তুমি যে দাবা খেলতে জানো আমি সেটা ভাবিই নি। সে কারণে খেলায় কোনো মনযোগ দিই নি। চলো আরেকবার খেলা যাক। ভাঁড় বললো: দুই শর্তে খেলতে পারি। রাজা বললেনঃ কী শর্ত। ভাঁড় বললো: প্রথম শর্ত হল আপনি আগের মতো বিরক্ত হবেন না। দ্বিতীয় শর্ত হল: আমি জিতলে সবাইকে বলবেন যে আপনি আমার কাছে হেরে গেছেন।
ভাঁড়ের শর্ত রাজা মেনে নিলো। এবার রাজা গভীর মনোযোগের সঙ্গে দাবা খেলায় মন দিলো। রাজা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে জিততে চাইলো। প্রতিটি চাল চালবার আগে পরিপূর্ণ মনোযোগ দিলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। ভাঁড় তার শেষ চাল দিয়ে 'চেক' বলে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে এক কোণে গিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। রাজা ভাঁড়ের এই ব্যবহারে অবাক হয়ে গেল। ভাঁড়ের কাছে গিয়ে বললো: এটা কী রকম দাবা খেলা? এখন কি মজা করা কিংবা হাসানোর সময়? উঠে বসো! তোমার চাল দাও! খেলা শেষ করো! ভাঁড় বললো: আমি এখান থেকে কিছুতেই উঠবো না। এক চুলও নড়বো না এখান থেকে। রাজা বললো: কিন্তু কেন? কেন এরকম করছো? কী হয়েছে তোমার? ভাঁড় বললো: তোমার জন্য আমার জীবন উৎসর্গ হোক! আমি তোমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম। সেজন্যই আমি চাদরের নিচে নিজেকে আবৃত করেছি।
রাজা বললো: তোমার যা খুশি বলো, সমস্যা নেই। লেপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসো! কী বলতে চাও খুলে বলো! কথা বলার জন্য লেপের নীচে ঢুকতে হয়, এরকম কথা কে কবে শুনেছে। কথা বলার জায়গা কি লেপের ভেতর? ভাঁড় এবার বললো: না রাজামহাশয়! সেরকম নয়। আপনার জন্য আমার প্রাণ উৎসর্গিত। ঠিকই বলেছেন আপনি। কথা বলার জন্য লেপের নীচে ঢোকার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু সত্য কথা বলার জন্য লেপের নীচে ঢোকাই কখনও কখনও ভালো। কারণ, তাহলে মানুষ মাথায় গুটির আঘাত থেকে অন্তত নিরাপদ থাকবে। রাজা বললেন: ঠিক আছে, এতোই যদি ভয় করে তোমার তাহলে লেপের নীচে থেকেই বলো! কী বলতে চাও!
ভাঁড় লেপের নীচে থেকেই বললো: আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে এই গেমটাও আপনি হেরে গেছেন। আমি শেষ চাল দিয়ে 'চেক' দিয়েছি, দেখেন আপনি চাল দিতে পারেন কিনা! রাজা এবার হন্তদন্ত হয়ে দাবার বোর্ডে গেল এবং মনোযোগের সেঙ্গ দেখলো। দেখে দেখে ভাবলো: ভাঁড় তো ঠিকই বলেছে! রাজার আর চাল দেওয়ার কোনো জো নেই। রাজা এবারও হেরে গেছে। এতো গভীর মনোযোগের সঙ্গে খেলেও জিততে পারে নি রাজা। সুতরাং রাজা মনে মনে ভাবলো দাবার গুটি আর ভাঁড়ের মাথায় পিটিয়ে কী লাভ! লেপের নীচে যে শুয়ে আছে তার ওপর এগুলো ছুঁড়ে মেরে তো কোনো ফায়দা নেই।
এই ঘটনার পর থেকে যখনই কোনো সত্য কথা অকপটে বলার মতো পরিবেশ না থাকে তখনই মানুষ মজা করে বলতে শুরু করলো: 'সত্য কথা লেপের নীচে থেকে বলতে হয়'।
পার্সটুডে/এনএম/১২/৭৯
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ