সেপ্টেম্বর ০২, ২০২৩ ১৪:২৪ Asia/Dhaka

আগেই বলেছিলাম ফারাবির জন্মস্থান নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন কাজাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে আধুনিক আত্রাই শহরের কাছে ফারাব অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন ফারাবি। আবার কেউ কেউ মনে করেন তিনি প্রাচীন ইরানের বৃহত্তম খোরাসানের ফারিয়াব বা বারিয়াব অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন। এ অঞ্চল বর্তমানে আফগানিস্তানের অংশ।

তবে, ইবনে খালকান দাবি করেন ফারাবি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং তিনি ৭০টি ভাষা জানতেন। ফারাবির তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়ার বিষয়ে ইবনে খালকানের দাবি অতিরঞ্জিত বলে অনেকে মনে করেন। কারণ তিনি যদি সত্যিই তুর্কি হয়ে থাকতেন এবং বহু ভাষা জানতেন তাহলে এটা নিশ্চিত যে তিনি তুর্কি ভাষাও জানতেন। অথচ তুর্কি ভাষায় তার লেখা কোনো গ্রন্থ নেই। অবশ্য ফার্সি ভাষায়ও ফারাবির কোনো গ্রন্থ নেই যদিও ফার্সি ভাষায় তার দক্ষতা ছিল। তাই তার লেখনিতে সোগদিয়ান ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি আরবি ভাষায় লেখালেখি করলেও ইরানি মনীষী হিসেবেই বিশ্বে পরিচিত।

ফারাবি যখন প্রথম বাগদাদে প্রবেশ করেন তখন তাকে প্রাচ্য থেকে আসা ব্যক্তি হিসেবে সবাই গণ্য করতো। তখন প্রাচ্য বলতে ইরানের খোরাসান ও এর আশেপাশের এলাকাকে বোঝাতো। ফারাবির জন্মের সময় এবং তার পরে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ফারাব এলাকাটি সম্পূর্ণ ইরানী ছিল এবং এর অধিবাসীরাও ছিল ইরানী। তবে ফারাবির পরিচয় কোনো দেশ, জাতি বা এলাকার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন মনীষী। যাইহোক, হাকিম আবু নাসর ফারাবী ইরানী ও ইসলামী সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও লেখক।

মুসলিম বিশ্বে ফারাবির অতুলনীয় প্রতিপত্তি ও খ্যাতির কারণে তাঁর মৃত্যুর পর দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা বা অন্য বিজ্ঞান সংক্রান্ত তার রচিত অনেক গ্রন্থের তালিকা সারা বিশ্বের বড় বড় গ্রন্থাগারগুলোতে পাওয়া যায়। আরবি ও ফার্সি ভাষায় ফারাবির কিছু কবিতার বইও আছে যেকারনে তিনি কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।

যাইহোক, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফারাবীর খ্যাতির কারণে কিছু লেখক, পণ্ডিত এবং কবি তাদের নিজস্ব কাজ, চিন্তাভাবনা ও কাব্য সংরক্ষণের জন্য বা প্রচারের জন্য ফারাবীর খ্যাতিকে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ ফারাবির নামে তারা চালিয়ে দিতেন নিজস্ব রচনাবলী। আবার এমনও হয়েছে কেউ কেউ দর্শনের পণ্ডিতদের বদনাম করার জন্য ফারাবিকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো কিংবা সমাজের কাছে তাকে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে, ফারাবির কিছু গ্রন্থ হারিয়ে গেলেও তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এখনো রয়ে গেছে। মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটলেও এমনকি অনেক পণ্ডিত-মনীষী হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হলেও ফারাবির রচিত অবশিষ্ট মূল্যবান গ্রন্থগুলো এখনও টিকে আছে। ফারাবী বহু বিষয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা করলেও সেসবের আকার খুব বড় নয় এবং দুর্ভাগ্যবশত সেসবের অনেকগুলো আজ হারিয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, ১৯ শতকের আগে ফারাবির রচনাগুলো সংগ্রহ করার কোনও চেষ্টা করা হয়নি এবং সেসবের বেশিরভাগই যা ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে তা এখন ইউরোপীয় হস্তলিখিত বইয়ের লাইব্রেরিগুলোতে রাখা হয়েছে।

ফারাবী বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রায় ৭০টি গ্রন্থ রেখে গেছেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তার প্রায় সব রচনাগুলোই তার পঞ্চাশ বছর পর এবং বাগদাদ ও আলেপ্পোতে থাকার সময় লেখা হয়েছিল। তার কাজগুলোকে যুক্তিবিদ্যা এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এ দুইভাগে ভাগ করা যায়। তার যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থগুলো এ্যারিস্টটলের অর্গানন গ্রন্থের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কিত। এসব গ্রন্থ এখনও পাণ্ডুলিপি আকারে রক্ষিত আছে। দ্বিতীয় বিভাগের গ্রন্থগুলো অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লিখিত। এসব বিষয়ের মধ্যে আছে দর্শনের বিভিন্ন শাখা, পদার্থবিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র, অধিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা এবং রাজনৈতিক দর্শন। দ্বিতীয় বিভাগের অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে অনেকগুলো গ্রন্থ পাওয়া যায়। এর ফলে আল-ফারাবীর দর্শনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ফারাবির বেশিরভাগ কাজই ছিল অ্যারিস্টটল, প্লেটো ও গ্যালেনের দর্শন ব্যাখ্যা করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।

আল-কিন্দির পর দ্বিতীয় প্রবীণ এবং কারও মতে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক আবু নসর আল-ফারাবী মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। আল-কিন্দির দার্শনিক ধারা বজায় রেখে তিনি মুসলিম দর্শনকে আরও সুষ্ঠু এবং পূর্ণরূপ দান করেন। আল-কিন্দির দুর্বোধ্য কিছু বিষয়কে তিনি বোধগম্য করে প্রকাশ করার ফলে ইবনে সিনার দর্শন আরও প্রাঞ্জল ও সমন্বয়ধর্মী করে তোলা ইবনে সিনার পক্ষে সম্ভব হয়। আল-ফারাবীর কৃতিত্ব এবং খ্যাতির আরেকটি মূল কারণ হল এ্যারিস্টটলের দর্শনের ব্যাখ্যা। তিনি এ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে অতি সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং অধিবিদ্যাকে প্রাঞ্জল করে প্রকাশ করেন। প্লেটোর দর্শনকেও তিনি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে মুসলিম দর্শনকে সমৃদ্ধ করেন।

আল-ফারাবীর লেখার ধরন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁর গ্রন্থ সংক্ষিপ্ত এবং পরিচ্ছন্ন। তিনি তাঁর লেখায় প্রতিটি শব্দ বেছে নিয়ে তাঁর নিজস্ব ধারণা ও চিন্তাকে প্রকাশ করেন। এজন্য তাঁর লেখা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি এবং আড়ম্বরপূর্ণ শব্দাবলীর ব্যবহার পরিহার করেন।

ফারাবি তার লেখায় তথ্য সাজিয়েছেন, সমন্বয় সাধন করেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর গ্রন্থে বিভাগ, উপ-বিভাগ এবং শ্রেণীকরণ তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। তাঁর কোনো কোনো গ্রন্থে বিভাগ এবং শ্রেণীকরণ করাই মুখ্য উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। তিনি প্রধানত এ্যারিস্টটলের গ্রন্থের উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য রাখতেন। মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানের শ্রেণীকরণ করেন আলফারাবী।

আল-ফারাবীর গ্রন্থগুলো দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে প্রাচ্যের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে তার রচিত গ্রন্থগুলো পাশ্চাত্যেও পৌঁছে যায়। ফলে আন্দালুসীয় বা স্পেন ও পর্তুগিজে তার কিছু শিষ্য বা ভক্ত গড়ে ওঠে। তাঁর কিছু গ্রন্থ হিব্রু ও ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং অনেক খ্রিষ্টান ও ইহুদী পণ্ডিত তার লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়। এসব গ্রন্থের মধ্যে বেশ কিছু গ্রন্থ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় এবং তাঁর জ্ঞানের পরিচয় সেসব দেশে ছড়িয়ে পড়ে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন  

ট্যাগ