অক্টোবর ০৪, ২০২৩ ১৭:৪২ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি এক অত্যাচারী বাদশাহকে নিয়ে।

কথিত আছে যে, প্রাচীনকালে একজন জালেম বাদশাহ ছিল। ওই বাদশাহর নিষ্ঠুরতার কারণে প্রজাদের গলা দিয়ে পানি পর্যন্ত পেটে যেত না। নানা অজুহাতে অত্যাচারী রাজা নিপীড়িত মানুষকে বন্দি করে কারাগার পূর্ণ করে রেখেছিল। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার কিংবা সাহস কারো ছিল না।

একদিন ওই নিষ্ঠুর রাজা তার সৈন্যদের আদেশ দিলো তারা যেন গ্রামে গ্রামে চলে যায় এবং যত গাধা দেখতে পাবে সমস্ত গাধা তাদের মালিকদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আসে। রাজার আদেশে যে গাধাগুলি সংগ্রহ করা হয়েছিল  সেগুলোপ্রচণ্ড ক্ষুধা ও ভারী বোঝা টানার কারণে দিনে দিনে দুর্বল ও হালকা হয়ে যেতে লাগলো। কারণ শাহের সৈন্যরা তাদের সাধ্যমতো ব্যবহার করলেও পর্যাপ্ত খাবার, পানি ও ঘাস দিতো না। সে কারণে ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে বহু গাধা মারাও গেছে। এদিকে রাজার সেনারা যে লোকদের কাছ থেকে গাধাগুলো জোর করে নিয়ে এসেছিল সেইসব গরীব মানুষ গাধা হারিয়ে প্রাণভয়ে প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারে নি। এভাবে কাটছিল দিন। 

একদিন নিষ্ঠুর রাজা তার বন্ধুদের সাথে শিকারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। শিকারে গিয়ে রাত হয়ে এলো এবং রাজা পথ হারাল। রাত কোথায় কাটাবে, কোথায় ঘুমাবে জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলো না। অবশেষে এক বৃদ্ধের বাড়ির কাছে গেল ঘোড়ার পিঠ থেকে জিনটি নিয়ে। জিনকে বালিশের পরিবর্তে ব্যবহার করলো যাতে রাতটা কোনোভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায়। সে বৃদ্ধের বাড়ির এত কাছে ছিল যে বৃদ্ধ তাকে দেখেই চিনতে পেরেছিল। বৃদ্ধের ছেলের একটি গাধা ছিল, রাজার সৈন্যরা সেদিন পর্যন্ত তাকে স্পর্শ করে নি। বৃদ্ধ যখন বুঝতে পারল যে রাজার বন্ধু এবং সৈন্যরা তাদের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে, ভয়ে সে তার ছেলের গাধাটিকে বাঁচানোর জন্য কী করা যায়-ভাবতে লাগলো। ছেলেকে ডেকে ফিসফিস করে বললো: আমি আস্তে আস্তে কথা বলবো যাতে ওই খবিস বাদশাহ আমাদের কথাবার্তা শুনতে না পারে।

বৃদ্ধ ছেলেকে আরও বললো: রাজা ও তার সৈন্যদের চোখ যাতে গাধার ওপর না পড়ে সেজন্য আজ রাত এবং আগামীকাল তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে। এরপর বিরক্তির সাথে বলল: হায়রে কপাল আমাদের! আমাদের গাধাগুলোও রাজার অত্যাচার থেকে নিরাপদ থাকতে পারে না। আল্লাহ এই রাজাকে ধ্বংস করে দিন। পিতা আরও বলল: এই দুষ্ট রাজা যেহেতু এখনও বেঁচে আছে সেহেতু আমাদের কিছুই করার নেই। কিন্তু যদি তুমি তোমার গাধাটিকে হারাতে না চাও তাহলে কাল সকালে অবশ্যই তাকে শহরে নিয়ে যেও না। যদি  গাধাটিকে বাসা থেকে বের করো তাহলে তারা দেখে ফেলবে এবং জোর করে তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। ছেলে বললঃ কী করব তাহলে? পথ তো বেশ দীর্ঘ। আমি তো হেঁটে যেতে পারবো না। একটু চিন্তাভাবনা করে আমাকে একটা সমাধান দেন। 

পিতা ভেবে বলল: আমার উপদেশ শুনলে রাজা এবং তার সৈন্যদের হাত থেকে গাধাটি নিরাপদ থাকবে। তুমি একটা পাথর দিয়ে গাধার মাথা, হাত, পা, রানে আঘাত করে করে আহত করে ফেলবে। ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, গাধাকে পাথর দিয়ে পেটাবো? কেন ? বেচারা গাধা কি পাপ করেছে যে আমি তাকে পাথর দিয়ে পেটাবো? পিতা বললেন: তোমার এই কাজ তার উপকারের জন্য। কারণ সে যদি রাজার সৈন্যদের হাতে পড়ে তাহলে সে অতিরিক্ত পরিশ্রম আর ক্ষুধা তৃষ্ণায় মারা যাবে। কিন্তু আমি যা বললাম তা করলে রাজা আর গাধাটা নেবে না। ছেলে বাবার কথা শুনে গাধাটিকে বাঁচাতে পিটিয়ে আহত করল। ছেলেটি চলে গেল এবং বৃদ্ধ লোকটি নামাজ পড়ে মোনাজাত দিলো। মোনাজাতে সে অত্যাচারীদের হাত থেকে জনগণকে বাঁচাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো। অত্যাচারী রাজার দ্রুত মৃত্যুও কামনা করলো। 

বৃদ্ধ যখন প্রার্থনা করছিল রাজা জেগেই ছিল এবং তার সব কথা শুনছিল। রাজা বাইরে তার ঘোড়ার জিনের উপর হেলান দিয়ে আরাম করছিল। বৃদ্ধ তা বুঝতে না পেরে ইচ্ছেমতো লানত দিচ্ছিলি। শাহ সব শুনে রেগে ছিল ঠিকই কিন্তু কিচ্ছু বললো না। বরং সারারাত ধরে বৃদ্ধের কথাগুলো নিয়ে ভাবলো এবং কিছু সময়ের জন্য অত্যাচারের কারণে অনুতাপ বোধ করলো। কিন্তু সকালেই সব ভুলে গেল এবং আগের সেই জালেম বাদশায় পরিণত হয়ে গেল। রাজার সঙ্গীদের সঙ্গে সকালে দেখা হলো। তারা যখন জানতে পারলো রাতে বাদশাহর খুব কষ্ট হয়েছে তাড়াতাড়ি ভালো ভালো খাবারের আয়োজন করলো। খাওয়া দাওয়া শেষে বৃদ্ধের কথাগুলো রাজার মনে পড়লো আবার। ওই বৃদ্ধকে ভদ্রভাবে নিয়ে আসার নির্দেশ দিল রাজা। বাদশাহ বৃদ্ধকে বলল: তুমি কি আল্লাহর কাছে আমার মৃত্যু চাও? সাহসী বৃদ্ধ ভয় না পেয়ে বলল: শুধু আমি কেন, সবাই তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছে।

জুলুম অত্যাচারকারীকে মানুষ ভালোভাবে মনে রাখবে না-এটাই স্বাভাবিক। এই কথায় রাজা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে তুমি কীসব বকছো? বৃদ্ধ বলল: আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইব কেন? মানুষের জীবন আল্লাহর হাতে। তুমি নিষ্ঠুর হও বা ন্যায়পরায়ণ হও একদিন মরবেই। ন্যায়বিচার করলে মানুষ মনে রাখবে আর অন্যায় করলে মৃত্যুর পরও মানুষ অভিশাপ দেবে। রাজা বলল: তুমি একজন বৃদ্ধ। মনে কর না যে এরকম  কথার জন্য তোমার অপরাধের বোঝা আরও ভারী হবে? বৃদ্ধ বলল: মহারাজ আমি তোমাকে একটা নসিহত করি। তুমি সবসময় প্রশংসিত হতে পছন্দ করো। কিন্তু তুমি জানো যারা প্রশংসা করে তারা সব মিথ্যা বলে। এরপর এক এক করে রাজার অত্যাচারের কথা সব উল্লেখ করলো বৃদ্ধ। তারপর জনগণের সেবার পথ অবলম্বন করার পরামর্শ দিলো। বৃদ্ধ লোকটি রাজাকে এতো বেশি বললো যে রাজা তার অজ্ঞতা ও অবহেলার বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হলো।
 
রাজা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বুড়োর কথার সত্যতা বুঝতে পারল। অজ্ঞতা আর জুলুমের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো বাদশাহ। রাজা বৃদ্ধকে ক্ষমা করে দিলো। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বৃদ্ধ রাজাকে বলল: সবসময় জ্ঞানীদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা  করো, সমকালীন মূর্খ, অজ্ঞ ও উদাসীন লোকদের কাছ থেকে নয়। কেননা ওই মূর্খ জাহেলরা প্রশংসা করে, পরামর্শ দেয় সোনার মুদ্রা পাওয়ার লোভে।#

পার্সটুডে/এনএম/৪/১০৮

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ