নভেম্বর ১৯, ২০২৩ ১৫:৩৩ Asia/Dhaka

খ্রিস্টান পণ্ডিতরা যুক্তিবিদ্যায় মুসলমানদের গবেষণাকর্মের প্রতি যে পরিমাণ মনোযোগ দিয়েছেন তা অধিবিদ্যা, জীববিদ্যা এবং (exact sciences) এ্যাক্সাক্ট সায়েন্সের তুলনায় অনেক কম।

তৎকালীন মুসলিম শাসিত দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়ার বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ইউরোপীয়দের সরাসরি প্রবেশাধিকার এবং খোরাসান, বাগদাদ, কায়রো ও উত্তর আফ্রিকার বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর সাথে আন্দালুসিয়ার ওই শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর সংযোগের ফলে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে সফর বিনিময় বা আসা যাওয়া বজায় থাকে। ফলে জ্ঞানবিজ্ঞানের  বিভিন্ন শাখায় মুসলিম পণ্ডিত ও গবেষকদের জ্ঞানগুলো ইউরোপে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থানান্তরিত হয়। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের চাইতে মুসলমানদের চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মৌলিকবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয় ইউরোপে সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করে। আর সমাজবিজ্ঞানের যে বিষয়গুলা ইউরোপে প্রবেশ করেছে তাতে ফারাবির চিন্তাগবেষণার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে যার কিছু অংশ অনুবাদের মাধ্যমে এবং কিছু অংশ সরাসরি পাঠ্যের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করেছে।

প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের কাজগুলো বোঝা এবং ব্যাখ্যা করার জন্য মুসলিম দার্শনিক বিশেষ করে ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ এবং আন্দালুসীয়ার মুসলিম দার্শনিকদের গবেষণাকর্মগুলোর দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়েছিল। বিশেষ করে ইউরোপের গীর্জা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু যে মুসলিম দার্শনিকদের নিয়ে আগ্রহ ছিল তাই নয় একই সাথে সেখানকার শিক্ষকরাও তাদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইউরোপের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ফারাবির গ্রন্থগুলো সরাসরি অনুবাদ করা হয়েছিল এবং সেখানে এইসব মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের গ্রন্থগুলো গভীর মনোযোগ ও গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হতো। যদিও ইবনে রুশদ এবং ইবনে সিনার চিন্তাদর্শন ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু ফারাবির খ্যাতিও কোনো অংশে কম ছিল না।

এ পর্যন্ত আলোচনায় আমরা এটা বুঝতে পেরেছি যে, খ্রিস্টান দর্শনে ফারাবি এবং তার রচনার প্রভাব ইহুদি দর্শনের তুলনায় কম ছিল এবং তুলনামূলক তার কম সংখ্যক বই ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, পাশ্চাত্যের ল্যাটিন ভাষীদের কাছে ফারাবির চেয়ে ইবনে সিনার অগ্রাধিকার সবচেয়ে বেশি ছিল। যেহেতু ইবনে সিনা ফারাবির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং ফারাবির দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে ছিল সেকারণে, ইবনে সিনার কাজের ল্যাটিন অনুবাদগুলোর মাধ্যমে ফারাবির দৃষ্টিভঙ্গিও পরোক্ষভাবে পশ্চিমে পরিচিতি লাভ করে। উল্লেখিত বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ফারাবির রচনাগুলোর অনুবাদ এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার চিন্তাদর্শন ইউরোপে শেখানোর বিষয়টি চালু ছিল, তবে তা ছিল হিব্রু অনুবাদ এবং ভাষ্যের তুলনায় কিছুটা কম।

যাইহোক, এটা নিশ্চিত যে মধ্যযুগের ল্যাটিন ভাষার দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে ফারাবির উচ্চ ও সম্মানজনক অবস্থান ছিল এবং "আল-ফারাবিউস" এর মতো শিরোনাম থেকে এটি স্পষ্ট যে কিছু খ্রিস্টান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ফারাবিকে নিয়ে গর্ব করতেন। ফারাবির সুনাম ও খ্যাতি খ্রিস্টান শিক্ষা ও ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোকেও প্রভাবিত করেছিল। 

ফারাবি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান জগতে একজন প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন একই সাথে তিনি তার সময়কালের বিভিন্ন সংকট সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। ওই সংকট সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আমরাও শিক্ষা  নিতে পারি যা আমাদের সময়ের জন্য উপযুক্ত। এটা জেনে রাখা জরুরি যে, ফারাবীর দর্শন লোক দেখানো বা প্রদর্শনীর জন্য ছিল না বরং তার যুগে চারপাশের বিশ্বকে বোঝার জন্য তা ছিল উপযোগী। এই মহান চিন্তাবিদ এমন এক সময় ইসলামি দর্শনের নানা দিক সুচারুভাবে তুলে ধরেছিলেন যখন তৎকালীন সমাজে অন্যান্য ধর্মের আবেদন বা গ্রহণযোগ্যতা তেমন ছিলনা বললেই চলে। 

খোরাসানের পরিবেশে ইরানি, ভারতীয় ও খ্রিস্টান দার্শনিকদের চর্চাকালীন সময়ে ফারাবির প্রাথমিক জীবন  শুরু হয়। এরপর তিনি খোরাসান থেকে আরো পশ্চিমে অর্থাৎ ইরানসহ অন্য মুসলিম অঞ্চলের দিকে যাত্রা শুরু করেন এবং জ্ঞানার্জনের দিকে মনোনিবেশ করেন। এ অঞ্চলের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে তিনি মিশরীয় ও গ্রিক দর্শনের সাথে আরো ভালোভাবে পরিচিত হন। মিশরে থাকা অবস্থায় তিনি তৎকালীন সময়ের নানা সামাজিক সংকট সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

প্লেটোর মতো ফারাবিও বিশ্বাস করতেন যে সামাজিক সংকটের মূল শিকড় রয়েছে চিন্তার দুর্বলতায়। ফারাবির মতে, মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে চিন্তার বৈচিত্র্য রয়েছে যা অসংখ্য ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। এতে বোঝা যায় সমাজচিন্তা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি এবং উপলব্ধির জন্য প্রয়োজনীয় যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অভাব রয়েছে যা থেকে বেরিয়ে এসে ব্যবহারিক পদ্ধতিতে আমরা আমাদের  আচরণ সংশোধন করতে পারি। ফারাবির মতে, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় সঠিক ও সুনির্দিষ্ট কর্মের ভিত্তি রচনা করতে পারে যার ব্যাখ্যা করা হয়েছে, খোসরুওয়ানি, প্রাচ্যের আধ্যাত্মদর্শন এবং প্লেটো ও প্লাটিনাসের দর্শনসহ কিছু গ্রিক দর্শনে।

যাহোক, রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে সংযোগ স্থাপন ফারাবীর আরেকটি কৃতিত্ব যা সব যুগেই চিন্তাবিদদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। কেননা এ নিয়ে মুসলিম বিশ্বে বিতর্ক রয়েছে এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তা অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া, ফারাবী ধর্ম ও দর্শনের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে সংলাপ ও পুনর্মিলনের দিকে পরিচালিত করেছিলেন।

'নীতিশাস্ত্র' দর্শনের একটি শাখা যেখানে নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়। ফারাবী একদিকে রাজনীতিকে নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক করা এবং অন্যদিকে এ উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন, যা তার চিন্তাদর্শনের আরেকটি দিক যা কিনা  ইসলামের ইতিহাস জুড়ে অন্যতম আকর্ষণের বিষয় হয়ে আছে। 

আল-ফারাবির দর্শনে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য পরিলক্ষিত হয়। তিনি তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মতামত গ্রহণ কোরে তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিবেশের  সাথে সেগুলোর সঙ্গতি বিধান করে এমন এক দার্শনিক মতবাদ গড়ে তোলেন, যার ফলে তার দার্শনিক মতবাদ সুসংবদ্ধ ও সুসংহত রূপ ধারণ করে। তিনি মনে করেন, দর্শন মূলত এমন একটি বিষয়, যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সত্যানুসন্ধান করা। সত্যের অনুশীলন ও ও অনুসন্ধান করাই যথার্থ  দার্শনিকের লক্ষ্য। তার মতে, সত্যনিষ্ঠ ও আত্মার বিশুদ্ধিকরণ দর্শনের অভীষ্ট লক্ষ্য। ফারাবি সত্যের নিষ্ঠাবান সাধক ছিলেন। তিনি দর্শনে কেবল একটি চিন্তাগোষ্ঠী, অর্থাৎ সত্যের চিন্তাগোষ্ঠীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। এজন্য তিনি সত্যের স্বার্থে প্রয়োজনে এরিস্টটলের মতকেও অস্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেননি।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ