ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩ ২০:৫৭ Asia/Dhaka
  • সূরা আত-তাগাবুন: ১-৬ (পর্ব-১)

আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা মুনাফিকুনের আলোচনা শেষ করেছিলাম। আজ আমরা এর পরবর্তী সূরা অর্থাৎ সূরা তাগ্বাবুনের সংক্ষিপ্ত তাফসির শুরু করব। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরাটিতে ১৮টি আয়াত রয়েছে। এই সূরার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে আল্লাহর পরিচয় এবং কিয়ামতের কঠিন দিনের জন্য মানুষের প্রস্তুতি। কিয়ামতের দিন যাতে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয় সেজন্য এই সূরায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমেই এই সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (1) هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (
2)

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”

“আসমানসমূহে যা কিছু আছে এবং যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে।  সার্বভৌমত্ব তারই এবং প্রশংসাও তারই; আর তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (৬৪:১)

“তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফির এবং কেউ হয় মুমিন। আর তোমরা যে আমল করো আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা।” (৬৪:২)

পবিত্র কুরআনের আরো কয়েকটি সূরার মতো সূরা তাগ্বাবুনও মহান আল্লাহর ‘হামদ ও তাসবিহ’ বা স্তুতি ও প্রশংসা দিয়ে শুরু হয়েছে। আমরা যখন তাসবিহ পাঠ করি তখন আল্লাহ তায়ালাকে সব ধরনের দোষ, ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত মনে করি এবং তিনি কোনো অজ্ঞতাপ্রসূত বা নিপীড়নমূলক কাজ করেন না বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। পক্ষান্তরে হামদ পাঠের সময় আল্লাহর সৃষ্টির বিশালতা ও তিনি আমাদের জন্য যে অসংখ্য নেয়ামতরাজি প্রস্তুত করে রেখেছেন সেজন্য তাঁর প্রশংসা ও গুণগান করি। ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল এবং এর মধ্যবর্তী স্থানে যা কিছু আছে তার সবকিছু তাদের নিজস্ব ভাষা ও পদ্ধতিতে আল্লাহর হামদ ও তাসবিহ পাঠ করে এবং এই সৃষ্টিজগতের ওপর তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ও সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেয়। আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে শুধুমাত্র মানুষকে তিনি কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন বলে এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অনেক মানুষ সৃষ্টিজগতের অন্য সকল সৃষ্টির চিরায়ত রীতির উল্টো কাজ করে। তারা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের হামদ ও তাসবিহ পাঠ তো করেই না বরং উল্টো মহান আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- আমাদের পক্ষে বোধগম্য না হলেও মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, জড় পদার্থ, গাছপালা, লতাগুল্ম, পশুপাখী ও প্রাণীসহ জগতের সকল সৃষ্টির বোধশক্তি রয়েছে এবং নিজস্ব বোধশক্তি অনুযায়ী তারা মহান আল্লাহর স্তুতি ও প্রশংসা করে।

২- কিছু মানুষ বিশ্বজগতের অন্য সকল সৃষ্টির বিপরীত ধারায় চলে; তারা আল্লাহতে বিশ্বাসী নয় এবং তারা তাঁরা অকৃতজ্ঞতা ও অবাধ্যতায় লিপ্ত।

৩- মহান আল্লাহ এমন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক যে, তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। পার্থিব জগতের ক্ষমতার মালিকরা অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে বলে দাবি করলেও তারা আসলে তেমন কিছুই করতে পারে না।

৪- মানুষের কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে, সে কোনো কিছু করতে বাধ্য নয়।

এবারে সূরা তাগ্বাবুনের ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ (3) يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَيَعْلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعْلِنُونَ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (4)

“তিনি আসমানসমূহ ও যমীন যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে [মাতৃগর্ভে] আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি করেছেন সুশোভিত। আর [সকলের] প্রত্যাবর্তন তো তারই কাছে।”  (৬৪:৩)

“আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সমস্তই তিনি জানেন এবং তিনি জানেন তোমরা যা গোপন কর ও তোমরা যা প্রকাশ কর। আর আল্লাহ অন্তরসমূহে যা কিছু আছে সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত।”(৬৪:৪)

পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর মহাজ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। কারণ, তাঁর পক্ষে উদ্দেশ্যহীন ও অনর্থক কাজ শোভা পায় না। আল্লাহর কাজে কোনো ভুল-ভ্রান্তি নেই এবং তাঁর প্রতিটি কাজ সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এসব সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং তাকে শ্রেষ্ঠতম আকৃতি ও প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।

নিঃসন্দেহে মানুষ আল্লাহর একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। এই সৃষ্টিতে সব ধরনের শিল্প, সূক্ষ্মকাজ ও পরিকল্পনা ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এক বিন্দু পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মাতৃগর্ভ নামক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাকে সুন্দরতম আকৃতি দান করেছেন।

আরো বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে: জন্মের সময় মাথা, মুখমণ্ডল, চোখ, কান, নাক, হাত, পা’সহ মানুষের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিজ নিজ স্থানে থাকে এবং এসব কিছুর সমন্বয়ে একটি পূর্ণ মানবসন্তান হিসেবে সে পৃথিবীতে আসে।

আল্লাহ তায়ালা যেমন সকল সৃষ্টির উৎস তেমনি সবাইকে একদিন তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। কোনো সৃষ্টিই এই অলঙ্ঘনীয় প্রক্রিয়ার বাইরে থাকতে পারে না। কাজেই এমন স্রষ্টা মানুষসহ গোটা প্রকৃতিকে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেননি বরং প্রতি মূহূর্তে তাদের প্রতিপালন করছেন, তাদের দিকে দৃষ্টি রেখেছেন। মানুষের প্রকাশ্য ও গোপন যেকোনো কাজ এবং সে অন্তরে কী করার ইচ্ছা পোষণ করে তার সবকিছু সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- বিশ্বজগত সৃষ্টি কোনো দৈব বা পরিকল্পনাহীন ঘটনা নয় বরং সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনার অধীনে মানুষসহ অন্য সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে।

২- বিশ্বজগতের শুরু ও শেষ হচ্ছেন মহান আল্লাহ এবং বিশ্বজগত আল্লাহর নির্ধারণ করে দেওয়া লক্ষ্যপানে ছুটে চলেছে।

৩- আল্লাহ তায়ালা শুধু মানুষের গোপন কাজগুলো সম্পর্কেই অবহিত নন সেইসঙ্গে তার অন্তরের সকল কল্পনা ও ইচ্ছাশক্তি সম্পর্কেও সম্যক অবহিত।

৪- মানুষ যদি জানতে পারে তাকে সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠে তার নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া হয়নি বরং তার প্রতিটি কাজ আল্লাহর পর্যবেক্ষণে রয়েছে তাহলে সে অনর্থক কর্ম ও গুনাহের কাজ পরিত্যাগ করবে এবং অর্থবহ ও নেক কাজ করার জন্য সচেষ্ট হবে।

এবারে সূরা তাগ্বাবুনের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَبَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ فَذَاقُوا وَبَالَ أَمْرِهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (5) ذَلِكَ بِأَنَّهُ كَانَتْ تَأْتِيهِمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَقَالُوا أَبَشَرٌ يَهْدُونَنَا فَكَفَرُوا وَتَوَلَّوْا وَاسْتَغْنَى اللَّهُ وَاللَّهُ غَنِيٌّ حَمِيدٌ (6)

“ইতোপূর্বে যারা কুফরী করেছে তাদের বৃত্তান্ত কি তোমাদের কাছে পৌঁছেনি? অতঃপর তারা তাদের কাজের মন্দ ফল আস্বাদন করেছিল। আর তাদের জন্য [পরকালে] রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(৬৪:৫)

“এই [শাস্তি] এজন্য যে, তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এসেছিলেন কিন্তু তারা বলেছিল: ‘[ঠিক আমাদের মতো] মানুষই কি আমাদের হেদায়েত করবে?’ অতঃপর তারা কুফরী করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল এবং আল্লাহ্‌ও [তাদের ঈমান ও আনুগত্যের ব্যাপারে] ভ্রুক্ষেপহীন হলেন; আর আল্লাহ্ অভাবমুক্ত, সপ্রশংসিত।”(৬৪:৬)

আগের আয়াতগুলোতে কিছু মানুষের অবাধ্যতা ও আল্লাহকে অস্বীকার করার কথা বলা হয়েছিল। তারা কেন আল্লাহর অবাধ্য হয় তা এই দুই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে: যুগে যুগে পৃথিবীর বুকে প্রেরিত নবী-রাসূলগণ মানুষকে শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকার যে সুস্পষ্ট আহ্বান জানাতেন তা এসব মানুষ শুনত এবং নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত মুজিযা বা অলৌকিক নিদর্শনও তারা দেখতে পেত কিন্তু তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনার জন্য নানা ধরনের অজুহাত দাঁড় করাত।

এজন্য তারা কখনও বলত‍‍, যে নবী আমাদের মতোই মানুষ আমরা তার আনুগত্য করব না। তার সঙ্গে আমাদের এমন কি পার্থক্য রয়েছে যে, আমাদেরকে তার আনুগত্য করতে হবে? আবার কখনও একথা বলতে যে, আমাদের ঈমান বা ইবাদত পালনে আল্লাহর এমন কি-ই বা এসে যায়?

এর অর্থ হচ্ছে, দম্ভ, অহংকার ও আত্মম্ভরিতার কারণে মানুষ আল্লাহর বাণী প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নবী পাঠিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে হেদায়েতের যে মহা সুযোগ দান করেছিলেন তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর ফলে এসব কাফের দুনিয়াতে শাস্তি ভোগ করেছে এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে আরো মর্মন্তুদ শাস্তি।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস অধ্যয়ন করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য পবিত্র কুর‌আনে বিশেষ তাগি‌দ দেওয়া হয়েছে।

২- কিছু পাপ কাজের শাস্তি আল্লাহ তায়ালা এই দুনিয়াতেই মানুষকে দেন। আর পরকালে রয়েছে ওই পাপের পূর্ণাঙ্গ শাস্তি।

৩- সেইসব কাফির আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে যাদের কাছে সত্যের আহ্বান পৌঁছেছিল কিন্তু আত্মম্ভরিতা ও অহংকারের কারণে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২৪

ট্যাগ