অক্টোবর ১০, ২০১৬ ১৮:২৭ Asia/Dhaka

ব্রিটিশ নও-মুসলিম আবদুর রউফ শুকুইয়া জন্ম নিয়েছিলেন এক খ্রিস্টান পরিবারে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, "জীবনের প্রথম সাত বছরে বাবা-মাকে খুব একটা কাছে পেতাম না। সে সময় ব্রিটেনে বসবাসরত নাইজেরিয় পরিবারগুলো ব্রিটেনেই কোনো পরিবারকে খুঁজে নিয়ে ওই পরিবারের ওপর নিজ সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব অর্পণ করত। আর এভাবে তারা নিজের চাকরি বা পড়াশুনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় ও শ্রম দিতে পারত।

আমি ও আমার ছোট ভাই যে ব্রিটিশ পরিবারের তত্ত্বাবধানে থাকতাম তারা আমাদের বেশ কড়া শাসনে রাখতেন। আমাদের বাবা-মা প্রতি তিন সপ্তাহ অন্তর একবার আমাদের দেখতে আসতেন। বাবা-মা যখন স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছলেন তখন তাদের সঙ্গে লন্ডনে ফিরে আসি। এভাবে আমাদের পরিবারের সবাই একই জায়গায় বসবাসের সৌভাগ্য অর্জন করে।"

আবদুর রউফ শুকুইয়া ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ে পটভূমি প্রসঙ্গে বলেছেন, "ইসলাম সম্পর্কে প্রথম ধারণা পেয়েছিলাম পূর্ব লন্ডনে থাকার সময়। এখানকার বেশিরভাগ মুসলমান এসেছেন দক্ষিণ এশিয়া থেকে। তাদের বেশিরভাগই হল ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি। তাই ভাবতাম ইসলাম সম্ভবত কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই সীমিত। তাই ইসলাম সম্পর্কে কোনো বিশেষ আকর্ষণ বা আগ্রহ জন্ম নেয়নি আমার মধ্যে। এভাবে কেটে গেছে জীবনের প্রথম ১১টি বছর। ১২ বছর বয়সের দিকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে শুরু করি। এ সময় স্রস্টা বা আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে মনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দেয়। একজন খ্রিস্টান হিসেবে এই ধর্মের শিক্ষাগুলো মনে মনে গ্রহণ করে নেয়ার চেষ্টা করতাম এবং এসব শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করতাম না। অর্থাৎ বাহ্যিক দিক থেকে একজন খ্রিস্টানই থাকতে চেয়েছি।"

নওমুসলিম আবদুর রউফ শুকুইয়া ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেছেন, "প্রথম যখন নাইজেরিয়া সফর করি তখন আমার বয়স ছিল প্রায় ১২ বছর। আমাদের পরিবার খ্রিস্টান হলেও আমার মায়ের কোনো কোনো বোন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। নাইজেরিয়া যাওয়ার পর আমার কোনো এক মুসলমান খালার বাসায় মেহমান হই। তখনও ভাবতাম যে, ইসলাম খুবই কঠিন সংকটের ধর্ম। মাঝে মধ্যে বাইরে যাওয়ার জন্য খুব ভোরে জেগে উঠতাম। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতাম যে আমার খালাম্মা নামাজ আদায় করছেন। নামাজ আদায়ের পর আমার খালাম্মা পবিত্র কুরআন পড়তেন। যখন খ্রিস্ট ধর্মের ইবাদতের সঙ্গে এই নামাজের তুলনা করলাম তখন একে বেশ কঠিন বলে মনে হল। তখন ভাবতাম প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়া কতই না কঠিন কাজ!  প্রতি সপ্তাহে একবার তথা রোববারে গির্জায় যাওয়া খ্রিস্টানদের ধর্মীয় রীতি। কিন্তু আমাদের পরিবার এত একনিষ্ঠ খ্রিস্টান ছিল না যে, প্রতি রোববার গির্জায় যেতাম।  আমার কাছে এ বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন জাগে যে, কিসের আকর্ষণে মুসলমানরা প্রতিদিন ভোরে এভাবে ইবাদত করতে আগ্রহী হয়? সে সময়ই এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে, স্রষ্টা বা খোদার অস্তিত্ব রয়েছে। আমার মনে হয় মুসলমানরা ইসলামের বিধি-বিধান ও ইবাদত পালন করত বলে তা আমার মধ্যে ঠিকই প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এই প্রভাবের বিষয়টি তখন পর্যন্ত নিজেই টের পাইনি।"

ইরানের প্রেসটিভিকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন আবদুর রউফ শুকুইয়া

আবদুর রউফ শুকুইয়ার কাছে কেবল মুসলমানদের আচরণই নয়, ইসলাম ধর্মের শিক্ষাগুলোও বিস্ময়কর আকর্ষণের আধার বলে মনে হয়েছে। যেমন, নামাজ, রোজা, আজান, বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পরিচিত ব্যক্তি বা আত্মীয়দের ইসলামী নৈতিকতা। ফলে ধীরে ধীরে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন রউফ। অবশেষে এক মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় ইসলাম সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ এনে দেয়। এ প্রসঙ্গে রউফ বলেছেন :

“আমার বয়স যখন ২২ তখন ইসলামের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয় এক মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে আলোচনার সুবাদে। সে সময় ধর্ম নিয়ে আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলাম সম্পর্কে ওই বন্ধুর দেয়া কথা ও তথ্যগুলো আমাকে বেশ আকৃষ্ট  করেছিল।”

সব ঐশী বা খোদায়ী ধর্মের মূল ভিত্তি ও মূলনীতি অভিন্ন। যেমন, স্রস্টা বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, পুনরুত্থান ও বিচার-দিবস, সত্যবাদিতা, সততা, পাপ ও অন্যায় এড়িয়ে চলা। ইসলাম অতীতের খোদায়ী ধর্মগুলোরই পূর্ণাঙ্গ ও উন্নততম সংস্করণ। ইসলাম হযরত ঈসা (আ.)-সহ অতীতের সব নবী-রাসূলকে স্বীকৃতি দেয় ও সম্মান করে। যারা কোনো ধরনের বিদ্বেষী প্রচারণা ও পূর্ব অনুমানের মাধ্যমে প্রভাবিত না হয়ে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করেন তারা খুব শিগগিরই এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। নাইজেরিয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নও-মুসলিম আবদুর রউফ শুকুইয়া হলেন এমনই একজন ভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেছেন,

"আমার বন্ধুর কাছ থেকে যখন জানতে পারলাম যে, মুসলমানরা হযরত ঈসা (আ.)-কে খুবই সম্মান করেন ও তাঁকে ভালোবাসেন তখন এ বিষয়টি একজন খ্রিস্টান হিসেবে আমাকে খুবই বিস্মিত ও প্রভাবিত করে, যদিও আমি একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান ছিলাম না। ওই বন্ধুই প্রথমবার আমাকে জানান যে, হযরত আদম (আ.) থেকে শেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূলই একই উদ্দেশ্য নিয়ে একই কথা বলে গেছেন। তাঁরা সবাই একত্ববাদ তথা এক আল্লাহর ইবাদতের কথা বলে গেছেন। সেই থেকে ইসলাম সম্পর্কে আরও বেশি জানার  জন্য আগ্রহী হই।" 

নাইজেরিয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নও-মুসলিম আবদুর রউফ শুকুইয়া আরো বলেছেন, "এরপর থেকে যতবারই এই মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো তাকে নানা প্রশ্ন করতাম। এত বেশি প্রশ্ন করতাম যে কখনও কখনও আলোচনায় কেটে যেতে তিন থেকে চার ঘণ্টা, কখনও ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। কখনও নানা ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিতর্কের ভিডিও দেখতাম। যেমন, একজন ইহুদি বা খ্রিস্টান একজন মুসলমানের সঙ্গে ধর্মীয় নানা বিষয়ে বিতর্ক করছেন। সব সময়ই দেখতাম মুসলিম বক্তা অত্যন্ত জোরালো যুক্তি ও বক্তব্য তুলে ধরছেন। তাই আমি মুসলিম বক্তাদের প্রশংসা করতে বাধ্য হতাম।"

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.) ইসলামের ইতিহাসের এমন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন শত্রু-মিত্র ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই। বিখ্যাত খ্রিস্টান সাহিত্যিক ও কবি খলিল জিবরানের মতে, "হযরত আলী (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)'র পর আরবদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি সমস্ত পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী তার জাতির মধ্যে সঞ্চালিত করেছিলেন। যারা আলীর পথকে পছন্দ করে তারা আসলে মানুষের প্রকৃতির দিকেই ফিরে আসে। আর যারা তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তারা অজ্ঞতাকেই প্রাধান্য দেয়।" 

নও-মুসলিম আবদুর রউফ শুকুইয়া এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "সেই সময়টাতে আমি খুবই সাহায্য কামনা করতাম যাতে সত্য পথ পেতে পারি, কিন্তু আমাকে তেমন কোনো সহায়তা করা হত না। কিন্তু এক পাকিস্তানি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটার পর এ অবস্থা পাল্টে যায়। তাকে যখন আমি বললাম আমি ইসলামকে জানতে চাই, তিনি তখন হযরত আলী (আ.)'র পরিচয় তুলে ধরলেন আমার কাছে। বিশ্বনবী (সা.)'র পর এমন বহুমুখী ও পূর্ণাঙ্গ বা আদর্শ মানবের কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও ওই ভাই আমাকে কিছু বই দিলেন ও তথ্য-সূত্রের খবর দিলেন। আমি আলী (আ.)'র জীবনী পড়ে ইসলামকে আরো ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হলাম। সত্যি বলতে কী, আমি আলী (আ.)'র ব্যক্তিত্বের প্রেমিকে পরিণত হলাম। এই মহাপুরুষের জীবনী থেকে আমি অনেক মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করেছি।

 এভাবে আবদুর রউফ শুকুইয়া অনেক পড়াশুনা ও গবেষণার পর ঈমানের বাস্তবতা উপলব্ধি করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "আমার মুসলমান হওয়ার ঘটনাটি ছিল পর্যায়ক্রমিক। প্রতি দিনই আমি ইসলাম সম্পর্কে আগের চেয়েও বেশি তথ্য পাচ্ছিলাম। আর এই প্রক্রিয়া আমার জীবনের ওপর প্রভাব ফেলত। প্রথমদিকে আমার ভেতরের অবস্থা ছিল যুদ্ধ-পরিস্থিতির মতো। এ যুদ্ধ ছিল সত্য ও মিথ্যার সেনাদের লড়াইয়ের মত। আর যতই বেশি শিখছিলাম ততই ভাবতাম যে, এই শিক্ষাগুলো আমার আচরণেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত। তাই অপেক্ষাকৃত সহজ-সরল বিধান মানার মাধ্যমে এই কাজ শুরু করতে চাইলাম, আর ইসলামের সহজ-সরল বিধান মেনে চলার মধ্য দিয়েই তা শুরু করলাম। যেমন, শুকরের মাংস খাওয়া বর্জন করা, মদ বর্জন করা। এভাবে ধীরে ধীরে ইসলামের গভীরতর স্তরের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকি। এ অভিজ্ঞতা ছিল খুবই সুন্দর ও আনন্দদায়ক।"

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/১০