রংধনু আসর: আহলে বাইতের ইমামদের কয়েকটি ঘটনা
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, বিশ্বের সর্বকালের সর্বসেরা পরিবার হচ্ছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবার। নবী-পরিবারের মনোনীত কয়েকজন সদস্যকে অর্থাৎ হযরত ফাতিমা যাহরা (সা. আ.), হযরত আলী (আ.) এবং তাঁদের দুই পুত্র হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.)-এই চারজন এবং নবী বংশেরই পরবর্তী আরও ৯ জন নিষ্পাপ ইমামকে মহানবীর আহলে বাইত হিসেবে গণ্য করা হয়।
পবিত্র কুরআনে আহলে বাইত সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)
আহলে বাইতের সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে হাদিসে অনেক বর্ণনা এসেছে। বিখ্যাত হাদীসে সাকালাইন-এ বলা হয়েছে : ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দুটি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি। একটি হলো- আল্লাহর কিতাব কুরআন এবং অন্যাটি হলো আমার আহলে বাইত। এ দু'টি জিনিস হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’
আরেকটি সহীহ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মনে রেখ! আমার আহলে বাইত হলো নূহের তরীসদৃশ, যে এতে আরোহণ করবে সে মুক্তি পাবে আর যে এর থেকে দূরে সরে যাবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’
বন্ধুরা, আহলে বাইত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা পেল। আজকের আসরে আমরা আহলে বাইতের কয়েকজন ইমামের জীবন থেকে নেয়া কয়েকটি ঘটনা শোনাব। আর সবশেষে থাকবে তেহরান প্রবাসী এক ছোট্ট বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের এ অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন সহকর্মী আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই আহলে বাইতের ইমামদের কয়েকটি শিক্ষণীয় ঘটনা শোনা যাক।
(এক মুসলমান ও এক আহলে কিতাব)
বন্ধুরা, আমরা যে সময়ের কথা বলছি সে সময় ইরাকের কুফা নগরী ছিল ইসলামী শাসনেরা প্রাণকেন্দ্র। সিরিয়া ছাড়াও ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্য সব জায়গার সব মানুষের নজর তখন সে নগরীর দিকেই নিবন্ধ থাকত।
একবার ওই শহর থেকে অনেক দূরে দুই ব্যক্তির রাস্তায় দেখা হলো। একজন মুসলমান আর অপরজন আহলে কিতাব। আহলে কিতাব মানে হচ্ছে ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারি।
যাইহোক, ওই দুই জনেই একে অন্যের গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। জানা গেল যে, মুসলমান লোকটি কুফা শহরে যাবে। আর আহলে কিতাব লোকটি কুফার নিকটেই অন্য একটা স্থানে যাবে। দুইজনে মিলে স্থির করলে যে, তারা এক সাথেই সফর করবে। কেননা, অনেক দূর পর্যন্ত দুইজনের রাস্তা একই। এক সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে পথ চললে ভালোই কাটবে।
দুজনের আন্তরিক আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে পথ শেষ হয়ে এলো। অবশেষে তারা একটি দুই রাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হলো যেখান থেকে দু’ জনের রাস্তা দু’ দিকে চলে গেছে। আহলে কিতাব লোকটি তার নিজের পথ ধরে চলতে লাগল। কিছু দূর পথ চলার পর পিছনে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। সে দেখতে পেল তার মুসলমান বন্ধুটি কুফার দিকে না গিয়ে তারই পিছে পিছে চলে আসছে। এ অবস্থা দেখে সে দাঁড়িয়ে গেল এবং তার মুসলমান বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করল: ‘কি ভাই! তুমি না বলেছিলে যে, কুফা শহরে যাবে’ ?
জবাবে মুসলমান বন্ধুটি বলল: ‘আমি তো এখনো বলছি যে, আমি কুফা যাব।’
আহলে কিতাব লোকটি বলল, ‘তাহলে তুমি এদিকে আসছ কেন? এটা তো কুফার রাস্তা নয়। কুফা যাবার রাস্তা তো ওইটা।
মুসলমান বন্ধুটি বলল, ‘আমি জানি। কিন্তু আমার মন চাইল যে, কিছু দূর পর্যন্ত আমি তোমার সঙ্গ দেব। কেননা আমাদের নবী বলেছেন- যখন দু' ব্যক্তি এক সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পথ চলে তখন একে অপরের প্রতি অধিকার লাভ করে। এখন তোমারও আমার ওপর অধিকার রয়েছে। আমি সেই অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্য কিছু দূর পর্যন্ত তোমার সাথে চলতে চাই। এরপর তো আমি আমার পথেই ফিরে যাব।
আহলে কিতাব বলল, ‘ওহ্! তোমাদের নবী মানুষের ওপর এতোই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে কারণে ইসলাম ধর্ম এতো দ্রুত বিশ্বে প্রসার লাভ করেছিল, এটা নিশ্চয় তাঁর এই উত্তম চরিত্রেরই গুণ ছিল।’
এরপর আহলে কিতাব লোকটি আরো বেশী অবাক হলো তখন যখন সে জানতে পারল যে, তার সফরসঙ্গী মুসলিম বন্ধুটি আর কেউ নন, বরং মুসলিম জাহানের বর্তমান খলিফা হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (আ.)। তৎক্ষণাৎ সে আহলে কিতাব লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেল এবং হযরত আলীর একজন বিশ্বস্তও অনুগত সাথীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো।
(হজযাত্রী এক কাফেলা)
অনেক দিন আগের কথা। মুসলমানদের একটি কাফেলা যাচ্ছিল মক্কা নগরীতে। মদীনা পৌঁছেই কাফেলার লোকেরা কয়েক দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করল। কয়েক দিন বিশ্রাম গ্রহণের পর তারা আবার মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা হলো।
মক্কা ও মদীনার মাঝে এক স্থানে এসে কাফেলা আবার বিশ্রাম গ্রহণের জন্য যাত্রা বিরতি করল। এ সময় কাফেলার লোকদের সঙ্গে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ ঘটল যিনি কাফেলার সব লোককে চিনতেন ও জানতেন। লোকটি যখন কাফেলার লোকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত তখন তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি অত্যন্ত হাসি মুখে কাফেলার লোকদের খেদমতে ব্যস্ত ছিলেন। লোকটি প্রথম দৃষ্টিতেই সে ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন, যিনি খুব আনন্দমনে লোকদের খেদমত করে চলছিলেন। তাই অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে কাফেলার লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কি এ ব্যক্তিকে চেনো যিনি তোমাদের খেদমতে লেগে আছেন?’
জবাবে তারা বলল, ‘না, আমরা এ লোকটিকে মোটেই চিনি না। এ লোকটি তো মদীনা থেকে আমাদের কাফেলার সাথে শামিল হয়েছে। তবে এ কয়েক দিনের সফরের সাথী হিসেবে এটুকু বলতে পারি যে, এ লোকটি একজন সৎ লোক এবং অত্যন্ত মোত্তাকী-পরহেজগার। আমরা তাকে বলিনি, আমাদের কাজ করে দাও। কিন্তু সে নিজেই অপরের খেদমতে লেগে আছে এবং সকলেরই সাহায্য-সহযোগিতা করে চলছে।’
কাফেলার লোকদের বন্ধুটি বললেন,‘ আমি জানি তোমরা তাকে মোটেও চেনো না। যদি তোমরা তাকে চিনতেই পারতে তাহলে কখনও এমন অপরাধজনক কাজ করতে পারতে না যে, একজন সাধারণ খাদেমের ন্যায় তোমাদের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যেতে থাকবেন তিনি।’ এ কথা শুনে সকলে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তিনি কে ?
লোকটি বললেন, ‘তিনি হলেন আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) অর্থাৎ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)।’
এ কথা শুনেই কাফেলার সমস্তলোক হতবাক হয়ে গেল এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য অত্যন্ত আদবের সাথে ইমামের দিকে এগিয়ে গেল। তারা ইমামের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অনুযোগের সুরে বলতে লাগল, ‘হে ইমাম! আপনি আমাদের সাথে এমনটি কেন করলেন? সম্ভাবনা ছিল যে, আমরা অজ্ঞতাবশত আপনার সাথে মারাত্মক কোনো অপরাধ করে বসতাম তাতে আমরা বড় গুণাহগার-পাপী হতাম।’
ইমাম বললেন, ‘যেহেতু তোমরা কেউ আমাকে চিনতে না, এ জন্যই আমি তোমাদের সফর সঙ্গী হয়েছি। কেননা আমি যখন চেনা-জানা লোকদের সাথে সফর করি তখন লোকেরা রাসূলেখোদা (সা.)-এর খাতিরে আমাকে অত্যন্ত ভালোবেসে আমার সাথে সদয় আচরণ করে। আর তারা আমাকে ছোটখাট কোনো কাজও করতে দেয় না। এ জন্যই আমি সফরের জন্য এমন একটি কাফেলা বেছে নিয়েছি যাদের কেউ আমাকে চেনে না যাতে করে আমি নিজের কাজ নিজেই আঞ্জাম দিতে পারি। আর আমি লোকদের কাছে আমার পরিচয় এজন্য গোপন রেখেছি যাতে করে আমি আমার সাথীদের খেদমত করার সুযোগ লাভ করতে পারি।’
(জুতার ফিতা)
বন্ধুরা, এবার আমরা ইমাম জয়নুল আবেদীনের নাতি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর জীবন থেকে নেয়া একটি ঘটনা শোনাব।
হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) একবার কতিপয় সাথীকে নিয়ে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে ইমামের জুতার ফিতা ছিড়ে গেল। তাতে ইমাম জুতা পায়ে দিয়ে চলতে পারছিলেন না। তিনি জুতা খুলে হাতে নিলেন এবং খালি পায়ে চলতে লাগলেন। এ অবস্থা দেখে তাঁর অন্যতম সঙ্গী ইবনে আবী ইয়াফুর তৎক্ষণাৎ নিজের পায়ের জুতা খুলে ফেলল। সে তার জুতার ফিতা খুলে ইমামের দিকে এগিয়ে দিল যাতে করে ইমাম জুতা পায়ে দিয়ে চলতে পারেন।
ইমাম সাদিক (আ.) আবদুল্লাহ ইবনে আবী ইয়াফুরের এ কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কোনো অবস্থাতেই তার ফিতা গ্রহণ নিতে রাজী হলেন না। তিনি বললেন, যদি কারো উপর কোনো বিপদ এসে পড়ে তখন সে বিপদ বহন করা তার জন্যই উত্তম কাজ। এটা কিছুতেই ঠিক কাজ হতে পারে না যে, বিপদ আসবে একজনের উপর আর তা বহন করবে অন্যজন।
(দোয়ার আবেদন)
এক ব্যক্তি খুবই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘আমি খুব দরিদ্র ও অভাবী মানুষ। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ আমার রিজিক বাড়িয়ে দেন। আর আমি যেন সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি।’
ইমাম সাদিক (আ) বললেন : ‘আমি তোমার জন্য কখনো এমন দোয়া করবো না।’
লোকটি একটা চাপা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল : ‘হে ইমাম! কি কারণে আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন না? ’
জবাবে ইমাম (আ.) বললেন: 'তুমি খুব ভালোভাবেই জানো যে, মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে একটা পন্থা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তিনি হুকুম দিয়েছেন যে, জীবিকা অর্জনের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ো এবং পরিশ্রম করো। কিন্তু তুমি চাচ্ছো যে, ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে জীবিকা অর্জনের পরিবর্তে দোয়ার দ্বারা রিজিক ঘরে ডেকে আনবে।'
(মেহনতের ঘাম)
জীবিত অর্জনের জন্য পরিশ্রমের বিকল্প নেই। বিশ্বনবী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। এবার এ সম্পর্কেই একটি ঘটনা শোনাচ্ছি।
আহলে বাইতের সপ্তম ইমাম ইমাম মূসা কাজেম (আ.) একবার নিজের ক্ষেতে কাজ করছিলেন। অত্যাধিক পরিশ্রমের কারণে তাঁর সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল। এমন সময় আলী ইবনে আবী হামযা নামক এক ব্যক্তি ইমামের কাছে এসে বলল, আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত হোক! আপনি এ কাজটি অন্য লোকের ওপর ন্যস্ত করেন না কেন ?
ইমাম (আ.) বললেন, আমি আমার এ কাজ অন্যকে দিয়ে করাবো কেন? আমার চেয়ে উত্তম লোকেরা সব সময় এ ধরনের কাজ নিজেরাই আঞ্জাম দিয়েছেন।
ইবনে হামযা বলল, সে সকল লোক কারা?
ইমাম বললেন, রাসূলে আকরাম (সা.), আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) এবং আমাদের বাপ-দাদা পূর্ব-পুরুষদের সকলেই এ জাতীয় কাজকর্ম নিজেরাই করেছেন। মূলত খেতে-খামারে কাজ করা আল্লাহর নবী-রাসূল, তাদের প্রতিনিধি, উত্তরসূরী ও আল্লাহর সুযোগ্য বান্দাদের সুন্নত।
বন্ধুরা, আহলে বাইতের মহান ইমামদের জীবন থেকে নেয়া কয়েকটি ঘটনা শুনলে। আশা করি এ গল্পগুলোর শিক্ষা নিজেদের জীবনে কাজে লাগাবে।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৪