দেখব ঘুরে ইরান এবার: মসূলেহ
গিলান প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহর রাশত থেকে পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে, কিংবা বলা যায় ফুমান শহর পেরুবার পর আরো পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এগিয়ে গেলে সবুজ গাছ গাছালি আর বন বনানীতে ঢাকা অপূর্ব এক পার্বত্য প্রকৃতির সৌন্দর্যময় এলাকাটিই হলো মসূলেহ।
এখানকার আকর্ষণীয় যে দিকটি সবার আগে নজরে পড়বে তাহলো অদ্ভুত স্থাপত্য শৈলী। মসূলেহ একটি পল্লী। গিলান প্রদেশের সবুজ প্রকৃতির আমেজে ভরপুর নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার মসূলেহ। স্বাভাবিকভাবেই দেশী বিদেশী হাজার হাজার দর্শনার্থী আর ভ্রামণিকের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই মসূলেহ। যারাই এখানে বেড়াতে যাবে তাদের ইচ্ছে করবে না দ্রুত সেখান থেকে ফিরে আসতে। সে কারণেই সারা বছর জুড়েই দেখা যাবে মসূলেতে অস্থায়ী তাঁবু গাড়া আছে। শহরের ব্যস্তময় জীবন থেকে একটু আড়ালে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা আর ক্লান্তি দূর করে প্রকৃতির মাঝে কিছুটা অবকাশ যাপন করার সুযোগটাকে কেউই হাতছাড়া করতে চাইবে না। সে জন্যেই মসূলেহ গিয়ে ঝটপট ফিরে না এসে কটা দিন সেখানে কাটাতে অনেকেই তাঁবু নিয়ে যায় সাথে করে এবং সেই তাঁবু খাটিয়ে কিছুটা অবকাশ যাপনের সুযোগ নিয়ে শহুরে জীবনের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করে সবাই।

হিজরি অষ্টম শতকের দিকে এই গ্রামটি গড়ে উঠেছে বলে ইতিহাসবিদগণ মনে করেন। অপূর্ব সুন্দর সবুজ প্রকৃতি ঘেরা এই পার্বত্য পল্লী মসূলের ঘরগুলো প্রাচীন আমলের পদ্ধতিতে তৈরি। এখানে আরো রয়েছে পুরাতাত্ত্বিক বহু নিদর্শন রয়েছে মন কেড়ে নেওয়া চমৎকার আবহাওয়া। এই মনোরম পরিবেশের কারণেই যে কেউই এখানে বেড়াতে যাবে ঐ বেড়ানোটা তার জন্যে সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই পার্বত্য এলাকার ওপর কাস্পিয়ান সাগরীয় আবহাওয়ার প্রভাব তো রয়েছেই, সেইসাথে এখানে রয়েছে ‘মসূলেহ দগ’ নামের সু-উচ্চ একটি চূড়া, তারই উপকূলে রয়েছে একটি নদী। মসূলেহ দগের উচ্চতা তিন হাজার পঞ্চাশ মিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই চূড়াটির ১০৫০ মিটার। তার মানে দাঁড়ায় পুরো পল্লীটা বেশ উঁচু নীচু। এই উচ্চতার তারতম্য ১২০ মিটারের বেশি। পাহাড়ের ক্রমশ ঢালুতে বাসাবাড়ি তৈরি করা সমগ্র মসূলের স্থাপত্যরীতিতে নিয়ে এসেছে অসাধারণ এক দৃশ্য।

অসাধারণ দৃশ্য বলার কারণটা হলো আপনি এই গ্রামের যেদিকেই বেড়াতে যাবেন দেখা যাবে কোনো না কোনো বাড়ির ছাদকেই রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করছেন। আপনি হয়তো জানেনও না, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তাই। কেননা এখানকার বাড়িগুলোই তৈরি করা হয়েছে একটি বাড়ির ছাদ আরেকটি বাড়ির আঙিনার মতো করে। দূর থেকে তাই তাই বাড়িগুলোকে মনে হবে একটি ওপরে আরেকটি বাড়ি। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে একটি বাড়ির ছাদ বা অন্যদের চলার পথের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ কারণে পুরো গ্রামটাকেই মনে হবে একটির সাথে আরেকটি গাঁথা। এখানকার ঘরগুলো বেশিরভাগই দোতলা। এক তলা কিংবা তিনতলা বিশিষ্ট ঘর খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। মসূলেতে একটি বৃহৎ ও পরিপূর্ণ ঘর বলতে বোঝায় দালান বা ছাদযুক্ত গলিপথ, স্টোর রুম, প্রথম তলা থেকে দ্বিতীয় তলা বা হলরুম পর্যন্ত সিঁড়ি ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে পরিপূর্ণ ঘর।
স্থাণীয় ভাষায় হলকে বলা হয় ‘চেগাম’। এই চেগাম হলো অতিথি অভ্যর্থনার জন্যে বিশাল কক্ষের মতো। তবে এই হলরুম ছাড়াও ছোট্ট একটি রুমও থাকে সাধারণত, যেই রুমটিকে বাসার লোকজন স্থায়ীভাবে ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহার করে। আরেকটি বিশেষ রুম থাকে যাকে ‘সুমেহ’ বলা হয়। পরিবারের লোকজনের শীতকালীন আবাসের জন্যে ব্যবহৃত হয় এই রুমটি। ঘরগুলোতে ঝুল বারান্দারও ব্যবস্থা রয়েছে। এই বারান্দা থেকে ঘরের অধিবাসীরা পুরো মসূলেহ গ্রামের প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে সহজেই। তবে ছোট ছোট ঘরও যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। এইসব ঘরে চেগাম বা সুমেহ’র মতো পরিপূর্ণ সুবিধা হয়তো থাকে না।

মসূলের স্থানীয় লোকজন সাধারণত তাদের ঘরগুলো বানায় ইট, পাথর, কাঠের সরঞ্জামাদি আর কাণ্ডবিহীন পাতা ও ডাঁটা বিশিষ্ট এক ধরনের উদ্ভিদ দিয়ে। ফার্সি ভাষায় এই উদ্ভিদটিকে বলা হয় ‘সারাখ্স’। বুনো সারাখস মসূলেহ এবং তার আশে পাশের এলাকায় প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমাণে জন্মে, তাছাড়া এগুলোর চাষও করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। মসূলের একটা সংস্কৃতি বেশ লক্ষণীয়। সেটা হলো সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই বছরে একবার নিজেদের ঘরবাড়ি নতুন করে ফুলে ফুলে সাজায়। ঘরের বাইরের দিকটাকে হলুদ রঙের ফুল দিয়ে আর ঘরের ছাদটাকে সাজানো হয় নীল রঙের ফুল দিয়ে। এই হলুদ আর নীল ফুলগুলো পার্শ্ববর্তী নদী ‘মসূলে রুদখান’ থেকে সংগ্রহ করা হয়। মসূলেহ বাজারের কথাটাও এখানে উল্লেখ্য। চারতলা বিশিষ্ট এই বাজারটি কেনাকাটার জন্যে খুবই উপযোগী এবং এখানকার পরিবেশটাও বেশ উপভোগ্য। এই পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় হস্তশিল্প সামগ্রীও এই বাজারে সহজলভ্য। সব মিলিয়ে মসূলেহ ইরানের মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী এবং অনন্য একটি এলাকা। এ কারণেই হয়তো ১৯৭৬ সালে মসূলেহ ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে।

মসূলের সৌন্দর্যের বর্ণনা তো আর দেওয়ার অপেক্ষাই রাখে না। এখানে চারটি চমৎকার ঝর্ণাও রয়েছে। মসূলেহ রুদখান নদীর কথা একটু আগেই বলেছিলাম। এই নদীটি আশপাশের পাহাড়গুলোর ঝর্ণাধারা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আর মসূলেহ’র অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে এই নদীটি আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কেননা মসূলেহ’র বুক চিরে বয়ে গেছে নদীটি। এখানে আরো রয়েছে অসংখ্য পর্বতচূড়া। কয়েকটি চূড়ার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে এখানেঃ মসূলেহ, শাহ মোয়াল্লেম, অসমনকূহ, লসেহ সারসহ আরো অনেক পর্বতচূড়া। গিলানের মসূলেহ পার্বত্য এলাকাটি আসলেই খুবই উপভোগ্য।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ টি-৬৩