দেখব ঘুরে ইরান এবার: বন্দর নগরী অস্তরা
কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম উপকূলীয় বন্দর নগরী অস্তরা’। অন্যভাবে বলা যায় গিলান প্রদেশের একেবারে উত্তর দিকে এবং ইরানের সাথে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত সংলগ্ন শহর এটি। এলাকার নাম অনুসারেই শহরটির নামকরণ করা হয়েছে, ফলে অস্তরা’ অঞ্চলের কেন্দ্রিয় শহর হিসেবে পরিচিত। অস্তরা’ শহরটির পূবদিকে রয়েছে কাস্পিয়ান ষাগর, উত্তর দিকে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র, পশ্চিমে আর্দেবিল প্রদেশ আর দক্ষিণে রয়েছে গিলান প্রদেশের আরেকটি শহর তলেশ।
অস্তরা’র বুক চিরে দুটি ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্রের সীমান্ত রেখা অঙ্কিত হয়েছে। একাংশ পড়েছে ইরানের গিলানে আর অপর অংশটি পড়েছে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রে। তবে দু দেশের অস্তরা’কে বিচ্ছিন্ন করেছে একটি নদী। নদীটির নাম অস্তরা’চয়ি। অস্তরা’র আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য, নাতিশীতোষ্ণ এবং আর্দ্র। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় দেড় হাজার মিলিমিটারের মতো। অস্তরা’ এলাকায় আজারবাইজানি তুর্কি ভাষার প্রচলনের পাশাপাশি স্থানীয় তলেশি ভাষারও ব্যবহার আছে ব্যাপক। ভৌগোলিক দিক থেকে এই শহর তে’মাথায় পড়েছে।
দক্ষিণের রাস্তাটি কাস্পিয়ান সাগরের তীর ঘেঁষে চলে গেছে আনযালি বন্দরের দিকে। উত্তর দিককার রাস্তাটি এই সাগরেরই তীর ঘেঁষে চলে গেছে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের দিকে। আর তে’মাথার পশ্চিম দিকের রাস্তাটি গিয়ে পৌঁছেছে আর্দেবিল প্রদেশে। অস্তরা’র ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে বিগত শতাব্দিতে এই শহরটি ছিল অস্তরা’নদীর পানি গড়িয়ে পড়া ধারার পাশে। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে, অস্তরা’ ছিল পার্বত্য একটি শহর।

পার্বত্য অঞ্চল হবার কারণে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ উপভোগ্য। ইরানের সীমান্ত অঞ্চলের অপরাপর শহরগুলোর তুলনায় অস্তরা’ শহরটি একটু আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তেহরান থেকে ৫৩০ কিলোমিটার দূরে এবং গিলানের কেন্দ্রিয় শহর থেকে ১৯০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই শহরটি। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় পরবর্তীকালে এই শহরটির বেশ উন্নতি হয়েছে। কেননা শহরটি একটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। আর্দেবিলের সাথে যোগাযোগের মহাসড়কের মোহনায় অবস্থিত হবার কারণে শহরটির গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। সেজন্যেই শহরটিকে আরো বিস্তৃত করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে সীমান্ত পারাপার এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই শহরটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে তার প্রভাব পড়ে সমাজের ওপর। সামাজিক কাঠামো বিশেষ করে সেখানকার বাড়িঘরগুলোর অবস্থা পাল্টে যায়। সুন্দর সুন্দর স্থাপত্য ডিজাইনের ভবন গড়ে উঠে দ্রুততার সাথে।

বন্দর নগরী হবার সুবাদে বাজার-ঘাট গড়ে উঠেছে প্রচুর। বিভিন্ন রকমের বাণিজ্যিক কাজ কারবার হয় এখানে। তাই বহু দূর দূরান্ত থেকে এমনকি দেশের বাইরে থেকেও বহু মানুষ এই শহরে আসে। যারা বাণিজ্যিক কারণে আসে তারাও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারে না। এ এলাকার মানুষও যথেষ্ট অতিথি পরায়ন। সেজন্যে দিনের পর দিন এই শহরে পর্যটকদের আনাগোণা বেড়েই যাচ্ছে।
অস্তরা’ শহরের লোকজনের সাধারণ পেশা হলো কৃষিকাজ। ধান চাষ, গম চাষ এখানে প্রচুর পরিমাণে হয়। ভালো ফলনের কারণে ধান এবং গম অস্তরা’ এলাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রেখেছে। অস্তরা’র আরেকটি চাষের পণ্য হলো মধু। মধুচাষীরা প্রতি বছরই এখানে ব্যাপক পরিমাণে মধু উৎপন্ন করে থাকেন। তাছাড়া কাস্পিয়ান সাগরের উপস্থিতির কারণে এখানে মাছের উৎপাদন যেমন চোখে পড়ার মতো তেমনি মাছ এবং পাখির খাবার উৎপাদনের অসংখ্য কারখানাও এখানে গড়ে উঠেছে প্রচুর। সাগর উপকূলে যেসব শামুক বা ঝিনুক এবং এ জাতীয় সামুদ্রিক জীব পাওয়া যায় সেগুলো থেকেই ঐসব খাদ্যপণ্য তৈরি করা হয়। পর্যটন শিল্পও অস্তরা’র আরেকটি অর্থকরী দিক।

অস্তরা’ অঞ্চলটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ কারণে প্রতি বছরই বিশেষ করে বসন্ত এবং গ্রীষ্ম ঋতুতে বহু পর্যটক বা ভ্রমণপ্রিয় লোকের আগমন ঘটে এখানে। ভ্রমণ পিপাসু লোকের ভিড়ে অস্তরা’ ভরে যায় এ সময়। কী আছে এখানে দেখার মতো..নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগে, তাই না? চলুন জেনে নেওয়া যাক, আর মেটানো যাক কৌতূহলের কিছুটা।
এক শ পাঁচ মিটার উঁচু ‘লতুন’ ঝর্ণাধারার কথা সবার আগে উল্লেখ করা যাক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য একটি নিদর্শন এটি। অস্তরা’ শহর থেকে ১৫ কিলোমিটারের মতো দক্ষিণে এবং ‘কুতেকুমে’ গ্রাম থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে এই ঝর্ণাটি অবস্থিত। জঙ্গলাকীর্ণ বহু টিলা পেরিয়ে বয়ে যাওয়া এই ঝর্ণাধারাটির পানি ঠাণ্ডা এবং সুপেয়। কেবল এই ঝর্ণাটিই নয় আরো অনেক পানির খনিজ উৎস লক্ষ্য করা যাবে এ এলাকায়। ঝর্ণাধারাটির শেষ প্রান্তে একটি খাড়া উঁচু পাহাড় আছে খুবই ভয়াবহ, কেননা আপাত দৃষ্টিতে ঐ পাহাড়ের উচ্চতা থেকে পড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।

এই যে জঙ্গলের কথা বললাম, ঐ জঙ্গলে রয়েছে বিচিত্র ফলফলাদির প্রাকৃতিক আয়োজন। পুরো নয় মাস জুড়ে প্রাকৃতিক এই জঙ্গল তার এই সবুজ শ্যামল রূপটি যত্নের সাথে রক্ষা করে। লতুন ঝর্ণাটির পানির পরিমান ঋতুভেদে কমবেশি হয় ঠিকই, তবে সারা বছর ধরেই এই ঝর্ণাটি তার অস্তিত্ব বজায় রাখে। শ্রোতাবন্ধুরা! বলেছিলাম যে আজকের আসরের মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি টানবো গিলান ভ্রমণের। তো গিলান ছাড়ার আগে এখানকার ‘রুদখন কেল্লা’র সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো।
বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, এই কেল্লাটি সাসানীয় আমলে অর্থাৎ খ্রিষ্টিয় তৃতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টিয় সপ্তম শতকের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। খ্রিষ্টিয় ১১ এবং ১২ শতকে সেলজুকি শাসনামলে কেল্লাটির পুনর্নির্মাণ করা হয়। ইসমাইলিয়াদের সংগ্রামকালে এই দূর্গটিকে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই কেল্লাটির আরো কয়েকটি নাম প্রচলিত আছে। যেমন প্রাচীন কেল্লা, হেসামি কেল্লা এবং হাজার সিঁড়ি কেল্লা ইত্যাদি।
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/১১/ ৬৬