মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪২
গত পর্বে আমরা বিশিষ্ট মুসলিম ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ঔষধবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ আবু রেইহান বিরুনির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। আশা করি তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যৎসামান্য হলেও ধারণা পেয়েছেন। এ পর্বে আপনাদের সাথে পরিচয় করাবো আরেক বিশিষ্ট মুসলিম ভূগোলবিদ নাসের খসরু কাবাদিয়ানীর সাথে।
নাসের খসরু কাবাদিয়ানী এক হাজার চার খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আবু রেইহান বিরুনির সমসাময়িক। নাসের খসরু কেবল ভূগোলবিদই ছিলেন না, তিনি একজন পর্যটকও ছিলেন। যদিও তাঁর খ্যাতি ইসমাইলিয়া ফের্কা, দর্শন বিষয়ক সৃষ্টিকর্ম এবং কাব্যশিল্পের জন্যেই বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা তিনি ভ্রমণ করেছেন। ফার্সি ভাষায় লেখা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে ভূগোল, বিভিন্ন গোত্র এবং পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- তিনি মিশরের ফাতেমি খলিফা মুস্তানসারের আমলে সেদেশের ভবিষ্যৎ জনজীবন সম্পর্কে চমৎকার পটভূমি রচনা করেছেন। তাঁর ভ্রমণ কাহিনীটা ছিল বেশ দীর্ঘ একটি সফরের ওপর প্রতিবেদন। হিজরী ৪৩৭ এর জমাদিউস সানীতে মারভ থেকে এই সফর শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ৪৪৪ হিজরির জমাদিউস সানীতে বালখে গিয়ে।
দীর্ঘ সাত বছরের এই সফরের ফলাফল হলো নাসের খসরুর জন্যে চিন্তার উৎকর্ষ সাধন আর আমাদের জন্যে তাঁর সফরে দেখাশোনার মূল্যবান স্মৃতি। তাঁর স্মৃতিগুলো খুবই স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য, গালগল্পের কৃত্রিমতা মুক্ত। কেননা তিনি নিজ চোখে দেখে, নিজ কানে শুনে এসে আপন অভিজ্ঞতাগুলোকে গ্রন্থ আকারে লিখে সাজিয়েছেন। তাঁর এই ভ্রমণ কাহিনীটি পড়ে হিজরি পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধের জনগণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে খুব সহজেই পরিচিত হওয়া যাবে। হিজরি পঞ্চম শতাব্দির পর থেকে বিশেষ করে ষষ্ঠ শতকে ভূগোল বিষয়ের ভূবনে নতুন আরেকটি তথ্য সূত্রের সংযোজন ঘটলো। এ সময় ভৌগোলিক সংস্কৃতিগুলো এবং বিশ্ব সংক্রান্ত ব্যাখ্যা প্রদান-যা ভৌগোলিক মানচিত্র হিসেবে পরিগণিত ছিল-ইত্যাদির প্রচলন শুরু হয় যা ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র একটি বিষয়। মিশরে বিশ্বকোষ এবং অভিধান রচিত হবার ফলে ভূগোল বিষয়ক জ্ঞান আলাদা মর্যাদা পায়। এভাবেই ইসলামী ভৌগোলিক ঐতিহ্যে নতুন একটি যুগের সূচনা হয়। এরপর অবক্ষয়ের কালে আর নতুন কোনো সৃষ্টিকর্মের জন্ম হয়নি। ফলে সবাই নির্ভর করতো আগেকার নিদর্শনগুলোর ওপর।
জার্মানির বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ এবং ইসলাম বিশেষজ্ঞ ফ্রান্তিয তেশনার ইসলামী সভ্যতার ভূগোলে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে হিজরি ষষ্ঠ শতক থেকে দশম শতক পর্যন্ত সময়কে "যুগ সন্ধিক্ষণ" বলে অভিহিত করেছেন। এই সময়কার সৃষ্টিকর্মগুলোকে আটভাগে ভাগ করা যায়। যেমন বিশ্ব ভূগোলের বর্ণনা, বিশ্ব পরিচিতি সংক্রান্ত লেখা, ভূগোল বিষয়ক অভিধান বা বিশ্বকোষ, পবিত্র স্থাপনা পরিদর্শন সংক্রান্ত বই, ভ্রমণ কাহিনী, নৌযাত্রা বিষয়ক লেখালেখি, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত সৃষ্টিকর্ম এবং সবশেষে স্থানীয় ভূগোল বিষয়ক লেখালেখি ইত্যাদি এ সময়কার রচনা। ভূগোল বিষয়ক অভিধান বা বিশ্বকোষগুলোর মাঝে ইয়াকুত হামাভি'র লেখা 'মুজামুল বুলদান' নামক বিশ্বকোষটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই বিশ্বকোষটিতে সমকালীন ভৌগোলিক সামগ্রিক তথ্যগুলোর সংক্ষিপ্ত-সার যেমন রয়েছে তেমনি পূর্ববর্তী যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্যিক ঐতিহ্যসহ সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।
আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম তানজি'কে অনেকে হয়তো নাও চিনতে পারেন, তবে ইবনে বতুতার নাম নিশ্চয়ই সবাই শুনে থাকবেন। আসলে তানজি-ই 'ইবনে বতুতা' নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত একজন মুসলমান পর্যটক। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মরক্কোর তানেযে'তে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি মালেকি ফের্কা ভিত্তিক দ্বীনী জ্ঞান লাভ করেন। ইবনে বতুতা যেহেতু সেই তরুণ বয়সেই বিভিন্ন সফরে গিয়ে তাকদির বা নিয়তি সম্পর্কে কথা বলতেন তা থেকে অনুমিত হয় যে মালেকি ফেকা সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তিনি ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে আপন জন্মভূমি ত্যাগ করেন এবং প্রায় দুই দশক পর সুদূর ইস্তাম্বুল, পূর্বআফ্রিকার বিভিন্ন কেন্দ্র, ভারত এবং চীনের বন্দরগুলোতে দীর্ঘ সফর শেষে স্বদেশে ফিরে যান। অবশ্য কেবল এই সফরগুলোতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি। তাই প্রত্যাবর্তনের পরপরই তিনি তাঁর সর্বশেষ সফরে সুদান এবং নাইজেরিয়া অঞ্চল সফর করতে যান। ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে এই মনীষী ইহলোক ত্যাগ করেন।
মুসলিম এই ভূবন পর্যটক তাঁর জীবনটাকে সাজিয়েছিলেন ভ্রমণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে। এভাবে জীবনযাপন করার মজা উপভোগ করতেন তিনি। তাঁর পারিবারিক জীবন, পেশাগত জীবন সবই ভ্রমণকেন্দ্রিক ছিল। ভ্রমণের ঐতিহাসিক অর্জন হলো তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী "তোহফাতুন নাজ্জার"। এতে রয়েছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের প্রাকৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক ভূগোলের বিচিত্র বিষয়। ইউরোপীয় মধ্যযুগের সমসাময়িককালে আরবি ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ এই ভ্রমণকাহিনীটি প্রকাশিত হয়। ভারত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়াসহ উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশ নিয়ে এই ভ্রমণকাহিনীতে লেখা হয়েছে। তোহফাতুন নাজ্জার বইটি অধিকাংশ শিক্ষিত মহলে ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনী বা সফরনামা নামেই বেশিরভাগ পরিচিত। তিনি তাঁর সফরে অন্তত এক লাখ বারো হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন, যার ফলে তাঁকে শ্রেষ্ঠতম মুসলমান পর্যটক বলে মনে করা হয়।
ইবনে বতুতা যদিও ভূগোলবিদ ছিলেন না তবুও তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে নৃ-তাত্ত্বিক বর্ণনার পাশাপাশি বিভিন্ন ভূখণ্ডেরও বর্ণনা রয়েছে। মানুষের জীবনাচারের প্রতি তিনি যেভাবে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়েছেন তা একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী একটি বিষয়। সেইসাথে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়েরও বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ঐ লেখায়। তবে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাহলো মুসলমানদের নৌচালনা বা সমুদ্রযাত্রা বিষয়ক ভূগোলের ওপর খুব কমই বইপুস্তক লেখা হয়েছে। সেজন্যে এ সময়কার সমুদ্রযাত্রায় মুসলমানদের তৎপরতা মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা করা বেশ কষ্টকর। অবশ্য ভারত সাগরে মুসলমানরা সক্ষম হয়েছে নিজেদের শক্তি বা ক্ষমতা রক্ষা করতে,যতোদিন না পর্তুগিজরা এ পথের সন্ধান লাভ করেছিল। একজন বিখ্যাত মুসলমান সমুদ্রযাত্রী হলেন শাহাবুদ্দিন আহমাদ বিন মাজেদ, তিনি হিজরি নবম শতকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন ‘ভাস্কো দ্য গামা'র জাহাজকে আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল মালিন্দি থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল কালিকটে সরিয়ে দিতে। ইবনে মাজেদ তাঁর লেখা সমুদ্রযাত্রার মূলনীতি নামক গ্রন্থে নৌচালনা পদ্ধতি এবং কম্পাস বা দিকদর্শন যন্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়াও তিনি এ বইতে ভারত সাগর এবং রেড-সি সম্পর্কে বহু তথ্য দিয়েছেন। ইবনে মাজেদের সৃষ্টিকর্মসহ অন্যান্য মুসলমান সমুদ্র অভিযাত্রীর লেখালেখি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সামুদ্রিক ভূগোল বিষয়েও মুসলমানদের জ্ঞান গরিমা ছিল অনেক উচ্চস্তরে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৩০