মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪৭
গত পর্বে আমরা ইরানে ইসলাম আগমনের ফলে ইরানের ভাষা, কবিতা ও সাহিত্যে যে পরিবর্তন এসেছিল তা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি।
বিশেষ করে সাদি, মৌলাভি, হাফেজের মতো জগদ্বিখ্যাত ইরানী মুসলিম কবিদের নিয়ে সংক্ষেপে কথা বলার চেষ্টা করেছি। এ পর্বে তুরস্কের কবিতা ও সাহিত্যের ওপর ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাবো।
সভ্যতার পরিবর্তনের ফলে তুর্কি ভাষাভাষী সমাজের সাহিত্যে তিনটি কালপর্ব পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম পূর্ববর্তী তুর্কি সাহিত্য, ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতা প্রভাবিত তুর্কি সাহিত্য এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি ও সভ্যতা প্রভাবিত তুর্কি সাহিত্য। ইসলাম পূর্ব তুর্কি সাহিত্যের লিখিত কোনো নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় না, তবে চিন, মোগল, আরব এবং পারস্যের শিল্প ও সাহিত্যকর্মে কেবল যুদ্ধের গল্প কাহিনী প্রসঙ্গে যেটুকু এসেছে, তাই অবশিষ্ট রয়েছে। তুর্কি ভাষার অবশিষ্ট শিল্পকর্মের মধ্যে সর্বপ্রথম যে নিদর্শনটি লিখিতরূপে রয়েছে তাহলো "কায়েম উরখুন" মাযারগুলোর পাথরের ওপরের লেখাগুলো। এ সময়কার আরো কিছু লিপিকর্মের নিদর্শন রয়েছে যেগুলো আফ্রাসিয়াবের হাতে সিয়াভাশের নিহত হবার ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
তুরস্কের সাহিত্য গড়ে ওঠার সূচনা থেকেই দ্বীনী বিষয়-আশয় বা উপাদানকে ধারণ করেছিল। হিজরি সালের প্রাথমিক চার শতকে তুর্কিরা ইসলামী দ্বীনের সাথে পরিচিত হয়। এ সময় ইসলাম পশ্চিম থেকে পূর্ব অর্থাৎ প্রাচ্যের দিকে ব্যাপকভাবে অগ্রসর হচ্ছিলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠির সংস্কৃতিতে ইসলামী ভাবার্থ বা উপাদানগুলো প্রবেশের পথ সুগম হয়। বর্ণিত আছে যে তুর্কিরা ইসলামের নবী (সা) কে সাফেজি উপাধি দিয়েছিল। সাফেজ শব্দটির উৎসমূল হলো 'সাফ' অর্থাৎ অদৃশ্যের বার্তা। একইভাবে আলী (আ) কে 'বাচির' উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বাচির মূলত 'বাতির' শব্দের ভিন্ন রূপ যার অর্থ হলো পালোয়ান বা বীর। এইসব উপাধিতেই তুর্কিরা নবী কারিম (সা) এবং আলী (আ) কে চিনতো।
তুর্কি ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলামের প্রবেশ শুরু হয়েছিল সেই হিজরি বর্ষের প্রথম শতাব্দিতে প্রাচীন ইরানের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় বৃহত্তর খোরাসান জয়ের মধ্য দিয়ে। অবশ্য হিজরি চতুর্থ শতকের প্রথমার্ধে তুরস্কের বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠির ইসলাম গ্রহণের ফলে কারাখনি সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে তুর্কিদের জীবনের সকল পর্যায়ে ব্যাপক পরিবর্তন আসে,সেইসাথে তুর্কি সাহিত্যও বিকাশ লাভ করে। ইসলামী সভ্যতার প্রভাবে তুর্কি সাহিত্যে মৌলিক দুটি বিভাজন আসে। একটি হলো পশ্চিমা তুর্কি সাহিত্য, অপরটি প্রাচ্য তুর্কি সাহিত্য। পশ্চিমা তুর্কি সাহিত্যটাকে আবার কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমনঃ কারাখনি সাহিত্য ( খানি এবং খাকানিয়া), খাওয়ারেযম সাহিত্য, অলতিন উর্দু (যাররিন উর্দু) এবং জোগতায়ি সাহিত্য। আর প্রাচ্য তুর্কি সাহিত্য রূপ লাভ করেছে আরবি ইসলামী সাহিত্য বিশেষ করে ফার্সি সাহিত্যের প্রভাবে। বহু কবি সাহিত্যিক লেখক এই দুই ধারার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে লেখালেখি করেছেন।
প্রাচ্য তুর্কির লিখিত সর্বপ্রথম নিদর্শন হলো "কুতাদ গুবিলিক"। হিজরি ৪৬২ সালে কারাখনি সরকারের আমলে এটি লেখা হয়েছিল। এটি নৈতিকতা ও দ্বীন বিষয়ক একটি মাসনাভি। মাসনাভিটির লেখক হলেন ইউসূফ খাস হাজেব ব্লাসাগুনি। গল্পধর্মী এই গ্রন্থটি ইসলামী তুর্কি সাহিত্যের সর্বপ্রথম নিদর্শন। জোগতায়ি সাহিত্যমালার জন্ম হয়েছিল হিজরি নবম শতাব্দিতে তৈমুরীয়ান শাসনামলে মোগলদের কর্তৃত্বের পর জোগতায়ি ভাষা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আর আমির আলী শিরনাভয়ির আবির্ভাবের পর এবং দিওয়ানি সাহিত্যের বিস্তারের পর এর পতন বা অবক্ষয়ের ধারা শুরু হয়।তুরস্কের ইসলামী পরিবেশে বেড়ে ওঠা কবি সাহিত্যিকদের একজন হলেন 'আদিব আহমাদে ইউকনাকি'। হিজরি পঞ্চম শতাব্দির শেষ এবং ষষ্ঠ শতকের শুরু ছিল তাঁর জীবনকাল। তিনিই ইসলামী তুর্কি সাহিত্যের স্বনামখ্যাত এবং সর্বপ্রথম শ্রেষ্ঠ কবি।
'আদিব আহমাদে ইউকনাকি' ইউকনাকে জন্মগ্রহণ করেন। এই এলাকাটি সম্ভবত সামারকান্দ অথবা তাসখন্দের দক্ষিণে অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে- তিনি জন্মের সময় অন্ধ অবস্থায় পৃথিবীতে আসেন। অন্ধ হয়েও তিনি ফার্সি এবং আরবি ভাষা আয়ত্ত করেন এবং তাফসির, হাদিসসহ অন্যান্য ইসলামী সাহিত্যে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন। সেইসাথে তিনি উপদেশমূলক প্রচুর কবিতাও লেখেন যেগুলোকে তিনি নিজের ভাষায় বলতেন ওয়াজ-নসিহত। তাঁর 'এইবাতুল হাকায়েক' নামক কাহিনীকাব্যটি 'কুতাদ গুবিলিক' এর পর ইসলামী তুর্কি সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। উপদেশমূলকভাবে তিনি এই কাহিনীকাব্যে আসলে নৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয়গুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তাঁর কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কোরআন এবং হাদিসের প্রেরণাকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
হিজরি পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতকে মধ্য এশিয়ার আমুদরিয়া এবং সমুদ্র ভ্রমণের ওপর যখন কারাখনিদের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় ছিল,তখন তুরস্কের পশ্চিমেও ইসলামী সাহিত্য বিস্তার লাভ করে। নিদর্শন হিসেবে খাজা আহমাদ ইয়াসাভির কবিতার কথা বলা যায়। ইয়াসাভি চীনের পূর্ব সীমান্তের পাশে তুরস্কের কাসবা সাইরাম এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং তরিকতপন্থী ঘরানার মানুষ। আধ্যাত্মিক বিষয়ে তাঁর লেখা বহু সৃষ্টিকর্ম এখনো অবশিষ্ট আছে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত আধ্যাত্মিক মনীষী শেখ ইউসুফ হামেদানির শিষ্য। ইরানের প্রথিতযশা কবি ফরিদুদ্দিন আত্তার তাঁর বইতে খাজা আহমদের ভূয়সি প্রশংসা করেছেন। খাজা আহমদের কবিতায় ঘুরে ফিরে কোরআনের আয়াতের ব্যবহার সহজেই লক্ষ্য করা যায়।
তাঁর লেখায় ধর্মীয় বিষয় বেশি স্থান পেয়েছে। এছাড়া ইসলামের আরো বিভিন্ন বিষয় যেমন তাফসির, আকায়েদ, ইসলামের হুকুম আহকাম ইত্যাদিও ছিল তাঁর আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এসবের মাঝে তৌহিদ, বিশ্বের বিশালত্ব, কিয়ামত, কিয়ামতের পরিস্থিতির বর্ণনা, গুনাহের স্মরণ এবং দ্রুত তওবা করার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সম্পর্কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুলতানুল আরেফিন নামে বিখ্যাত এই মনীষীর কবর কাজাখস্তানের 'ইয়াসেহ' শহরে অবস্থিত। যাই হোক সমকালীন লেখক ও কবিদের মাঝে বিখ্যাত আরেকজন হলেন 'মুহাম্মদ আকেফ এরসোয়ি'। এরসোয়ি ছিলেন একাধারে আলেম, সাহিত্যিক, ইসলামী চিন্তাদর্শের কবি এবং ওসমানিদের সংস্কারকামী। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করেন। 'সাফহাত' বা 'পৃষ্ঠাগুলো' নামে তাঁর যে বিখ্যাত বইটি ওসমানী সাহিত্যের ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষিত আছে সেটি আসলে সমগ্র মুসলিম সমাজেরই সম্পদ। তুর্কি সাহিত্যের আরেকটি ধারা হলো দিওয়ানি সাহিত্য। সাধারণত রাজদরবারের কবিগণ কিংবা বিদগ্ধজনদের সাহিত্যকর্মই এই ধারার অন্তর্ভুক্ত।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৪