জানুয়ারি ১৮, ২০১৮ ১৯:৫৭ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪৮

এ পর্বে ভাষাতত্ত্ব এবং এক্ষেত্রে মুসলমান মনীষীদের অবদান নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাবো।

বর্তমানে সমগ্র বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ভাষাবিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি শাখা প্রশাখা রয়েছে। যেমন ফনেটিক্স বা ধ্বনিবিজ্ঞান, গ্রামার বা ব্যাকরণ এবং সেমান্টিক্স বা শব্দার্থবিজ্ঞান। ভাষাতত্ত্ব আগে জ্ঞানের স্বতন্ত্র কোনো বিষয় বা শাখা হিসেবে স্বীকৃত ছিল না, একটি প্রশাখা ছিল। ভাষাবিজ্ঞানের যে বিভাগে ধ্বনির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয় তাকে ফনেটিক্স বা ধ্বনিবিজ্ঞান বলা হয়। ধ্বনির সাথে উচ্চারণ নিবীড়ভাবে সম্পৃক্ত। উচ্চারণ করার জন্যে প্রয়োজন পড়ে জিহ্বার। আর জিহ্বার সাহায্যে ধ্বনি উচ্চারণ করার স্থানকে বলা হয় পয়েন্ট অব আর্টিকুলেশান। আবার উচ্চারণ করার বিভিন্ন রীতিকে বলা হয় ম্যানার অব আর্টিকুলেশান। এসব বিষয় নিয়ে ইসলামী জ্ঞানের জগতে লিখিত সর্বপ্রাচীন বইটি হলো 'সিবুইয়ে'র লেখা 'আল-কিতাব'। অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীই 'সিবুইয়ে'র অনুসরণ করেছেন এবং তাঁর দেওয়া পরিভাষাগুলো কিংবা বিভাজনগুলোর উল্লেখ করেছেন।

মুসলমান ধ্বনিবিজ্ঞানীদের মধ্যে আরো যাদের লেখাগুলো পড়ার কথা উল্লেখ করা যায় তারা হলেন ইবনে সিনা এবং খাজা নাসিরুদ্দিন তূসি। ধ্বনি বিজ্ঞানের ওপর ইবনে সিনার গুরুত্বপূর্ণ বই রয়েছে। আরবিতে লেখা তাঁর বইটির নাম হলো 'মাখারেজুল হরুফ'। বইটিতে একটি ভূমিকা এবং ছয়টি অধ্যায় রয়েছে।এটি হিজরি ৪১৪ সালের পর সংকলিত হয়েছে। ধ্বনি এবং বর্ণ বিষয়ক বিভিন্ন দিক নিয়ে এ বইটির সবকটি অধ্যায়ে আলাদা আলাদাভাবে সুন্দর করে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বইটিতে আরবি বর্ণের পাশাপাশি আরবি নয় কিন্তু আরবির মতো বর্ণের ব্যাপারেও আলোচনা করেছেন। ধ্বনি. ধ্বনির উচ্চারণ স্থান এবং রীতি সম্পর্কে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আলোচনা রয়েছে এ বইটিতে। এমনকি বিভন্ন বস্তু থেকে উৎপাদিত শব্দ নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে 'মাখারেজুল হরুফ' বইতে।

ধ্বনিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ বইটি হলো খাজা নাসিরুদ্দিন তূসির। বইটির নাম 'মি'ইয়ারুল আশআর' অর্থাৎ কবিতার ছন্দ বা পরিমাপ। প্রাচীন ফার্সি কবিতার ছন্দ ও অলংকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর অন্যতম এ বইটি। বর্ণের বিচিত্র চলনভঙ্গিকে খাজা এ বইটিতে শ্রেণীবিন্যস্ত করে আলোচনা করেছেন। তিনি আরবি এবং ফার্সি ভাষার ধ্বনিগুলোর মধ্যকার পার্থক্যকে চমৎকারভাবে তুলে ধরে ফার্সি ভাষার ধ্বনি পরিচিতির ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। খাজা নাসির যেসব তথ্য উপাত্ত দিয়েছেন ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে সেগুলো যে কতো গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা গেছে শত শত বছর পর বিংশ শতাব্দির শুরুতে যখন ভাষাতত্ত্ব নামে জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা রূপলাভ করেছে। বিশেষ করে মুসলিম ভূখণ্ডের মনীষীদের জ্ঞানের ওপর এগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম ভূখণ্ডের মনীষীদের মাঝে অভিধান রচনার ব্যাপারে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেয়। অভিধান রচনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যিনি শব্দের যথাযথ অর্থ করে এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন তিনি হলেন খলিল বিন আহমাদ ফারাহিদি। ইরানী এই অভিধান বিশেষজ্ঞ হিজরি ১৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। 'আল-এইন' নামে তিনি একটি অভিধান রচনা করেন। এই অভিধানে তিনি শব্দ বা ধ্বনির উচ্চারণ স্থানগুলো কণ্ঠনালীর একেবারে ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। মুসলিম বিশ্বে অভিধান রচনাকারী অপর বিখ্যাত মুসলমান মনীষী হিসেবে 'আবু তাহের মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব বিন মুহাম্মাদ ফিরোযাবাদি'র নাম উল্লেখ করা যায়। ফিরোযাবাদি একাধারে একজন অভিধানবিদ, সাহিত্যিক, মুফাসসির এবং ফকিহ। ইরানী এই মনীষী ছিলেন ফার্স প্রদেশের অধিবাসী। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শিরাযের একটি শহর কাযরুনে (کازرون) তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

আট বছর বয়সে তিনি শিরাযে যান এবং সে সময়কার বড় বড় বিদ্বান আলেমগণের খেদমতে থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর তিনি যান বাগদাদ, মিশর, সিরিয়া, হেজাজ, ইয়েমেনসহ ভারতের মতো অন্যান্য প্রাচ্যদেশে। ফিরোযাবাদি প্রচুর বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্য থেকে অন্তত চল্লিশটি বই এখনো অবশিষ্ট আছে। এই বইগুলোর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই হলো 'কামুসুল্লোগাহ'। প্রাচ্যবিদদের অনেকেই নিজেদের আরবি অভিধান রচনার জন্যে ফিরোযাবাদির কামুসের ওপর নির্ভর করেছেন। আরবি ভাষায় কামুস অভিধানটির গুরুত্ব এবং খ্যাতি এতো বেশি যে 'কামুস' শব্দটি ব্যবহৃত হতে হতে 'অভিধানের' অর্থ ধারণ করেছে। বর্তমানে অভিধান গ্রন্থকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কামুস বলে অভিহিত করে থাকে।

এসবের বাইরেও ভাষার ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে মুসলমানরা ব্যাপক পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। মুসলিম বিশ্বে ব্যাকরণ রচনায় অবদানের ক্ষেত্রে যাঁর নামটি সবার আগে উঠে আসবে তিনি হলেন 'আবু বাশার ওমর বিন ওসমান বিন কানবার'। 'সিবুইয়ে' নামে পরিচিত এই মনীষী থেকেই মুসলিম বিশ্বে ব্যাকরণ রচনার ধারা সূচিত হয়। ইরানী এই বিশিষ্ট মনীষী ছিলেন ফার্সের অধিবাসী। তিনি বসরায় গিয়ে সেখানকার আলেমদের কাছে বিচিত্র জ্ঞানের পাঠ নেন। তাঁর লেখা 'আল-কিতাব' বইটি গুরুত্বের কারণে 'কোরআনুন নাহু' উপাধি লাভ করেছে। এ বইতে সিবুইয়ে শব্দকে বিশেষ্য, ক্রিয়া এবং অব্যয়ে ভাগ করেছেন এবং এগুলোর প্রত্যেকটির যথাযথ উদাহরণও দিয়েছেন।

মুসলমান মনীষীগণ ফার্সি ভাষাতত্ত্ব পরিচিতির জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এঁদের মধ্যে একজন হলেন হিজরি সপ্তম শতকের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সমালোচক 'শামস কেইস রাযি'। রেই শহরের অধিবাসী ছিলেন তিনি। তিনি খাওয়ারেযম, খোরাসান এবং উজবেকিস্তানে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত 'আলমু'জিমু ফি মাআবিরি আশআরুল আজাম' বইটি একটি মূল্যবান সম্ভার। এই বইতে তিনি ফার্সি ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। রাযি'র আলমুজাম একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে আজো তার অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রয়েছে। প্রাচীন ফার্সি শব্দ নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার জন্যে প্রাচীনতম উৎস এতে মজুদ রয়েছে। তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই হলো 'ফারহাঙ্গে মুহাম্মাদ বিন কেইস' অর্থাৎ মুহাম্মাদ বিন কেইসের অভিধান।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৮