মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪৯
গত কয়েকটি পর্বে আমরা ইসলামী ও অন্যান্য জ্ঞানের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে সেগুলোর প্রভাব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি।
সেই আলোচনায় এ বিষয়টি নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে অনৈসলামী জ্ঞানের বাইরে ইসলামী জ্ঞানও এক্ষেত্রে বেশ প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছিল। ইসলামী জ্ঞান বলতে সেইসব জ্ঞানকে বোঝায় যেসব জ্ঞানের বিষয়বস্তু ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। যেমন এলমে ক্বিরাত, তাফসিরে কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, উসূল, কালাম ইত্যাদি। আজকের আসরে আমরা এলমে ক্বিরাতের ক্ষেত্রে যেসব মনীষী অবদান রেখে গেছেন তাঁদের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব ইসলামী জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে 'এলমে ক্বিরাত' তাদের অন্যতম। ক্বিরাত শব্দের অর্থ হলো কোরআন পড়া। এটি এমন একটি জ্ঞান যার মাধ্যমে আল্লাহর কালামকে ছন্দোবদ্ধ বা সুশৃঙ্ক্ষলভাবে বিভিন্ন রীতিতে পড়া হয়।এ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য নিয়েও আলোচনা করা হয় এলমে ক্বিরাতে। ইসলামী জ্ঞানের মাঝে সবচেয়ে প্রাচীন জ্ঞান হলো এলমে ক্বিরাত। এই জ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল রাসূলে খোদা (সা) এর সময়ে যখন তাঁর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অহি বা কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কোরআনের ক্বিরাত শিল্পটির রূপকার বা গোড়াপত্তনকারী হলেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (সা)। তিনিই কোরআনের ক্বিরাতের ক্ষেত্রে সুন্দর,সুরেলা কণ্ঠে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ক্বিরাতের জন্যে মুসলমানদেরকে তিনি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।তাঁর পরে হযরত আলী (আ) এবং নবিজির আহলে বাইতের সন্তানগণ ছিলেন সুন্দর কণ্ঠে তিলাওয়াতকারীদের অন্তর্ভুক্ত।
রাসূলে খোদার ওফাতের পর সাহাবিদের যুগে এলমে ক্বিরাত চমৎকার আঙ্গিক ও বিশেষ বিশেষ রূপ লাভ করে। এই যুগে কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে অসংখ্য রীতি, সুর বা ঢঙের আবির্ভাব ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই ক্বারী এবং বর্ণনাকারীদের মাঝে কোরআনের বিভিন্ন শব্দ, বর্ণের উচ্চারণ রীতি ও পদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এই মতপার্থক্য ক্বারীদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়ে অব্যাহত গতি লাভ করেছে। অবশ্য ইসলামের বিজয়ের পর বিজয়ের ফলে মুসলমানগণ ইসলামী কেন্দ্রগুলোসহ এক এক প্রান্তে বিখ্যাত এক এক ক্বারীর স্টাইল অনুসরণ করেছেন। এর পরিণতিতে অন্তত পঞ্চাশটি ক্বিরাতের জন্ম হয়েছে। এগুলোর মাঝে 'ক্বারাআতে সাবআ' বা সপ্ত ক্বিরাত খুবই বিখ্যাত।
তুরস্কের বিখ্যাত ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও স্বনামখ্যাত ইতিহাসবিদ 'ফুয়াদ সাযগিন' কোরআনী শিক্ষা বিশেষ করে এলমে ক্বিরাতের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর গবেষণালব্ধ প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ এলমে ক্বিরাত সম্পর্কে সর্বপ্রাচীন যে বইটি লেখা হয়েছে, তা হলো ইয়াহিয়া বিন ইয়ামারের 'কিতাবুন ফিল ক্বেরাআ'। ইয়াহিয়া বিন ইয়ামার ছিলেন আবুল আসওয়াদ দুয়ালি'র ছাত্র। ইয়ামার ছিলেন ইরাকের অধিবাসী এবং ইমাম সাজ্জাদ (আ) এর সঙ্গী। তিনি 'কিতাবুন ফিল ক্বেরাআ' গ্রন্থটি হিজরি প্রথম শতাব্দির প্রথমার্ধে লিখেছিলেন। হিজরি চতুর্থ শতাব্দি পর্যন্ত এই গ্রন্থটি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হিসেবে পরিগণিত ছিল। সেযুগের বিভিন্ন পদ্ধতির ক্বিরাতের মধ্যে ইয়াহিয়া বিন ইয়ামারের ক্বিরাতটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ক্বিরাতগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্যে প্রয়োজন ছিল সকল ক্বিরাতকে এক জায়গায় সংকলিত করা। ক্বিরাতগুলো সংকলনের কাজ হিজরি প্রথম শতকেই রাসূলে আকরাম (সা) এর সাহাবাদের মাধ্যমে হয়েছিল। হযরত আলী (আ) কে ক্বিরাত সংগ্রহকারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম বলে মনে করা হয়। তাঁর পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন ক্বারীগণ ক্বিরাতগুলো সংগ্রহ ও সংকলনের চেষ্টা করেন।তবে সর্বপ্রথম যিনি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ততার সাথে ক্বিরাতগুলোকে একটি গ্রন্থে সংকলিত করেছেন তিনি হলেন 'ইবনে সালাম'।ইবনে সালাম বিখ্যাত সাতটি ক্বিরাতসহ সকল ক্বিরাতকে সংক্ষিপ্ত করে পচিঁশটি ক্বিরাতে নিয়ে আসেন। তবে হিজরি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতকে ক্বিরাতের বহু শাখা প্রশাখা তৈরি হওয়ায় বহু আলেম ক্বিরাত সংরক্ষণ ও সংকলনে এগিয়ে আসেন। তাঁরা এ বিষয়ে অনেক বইও লিখেছেন। এ সময় এঁদের মধ্য থেকে এমন দশ জন ছিলেন যাঁদের প্রত্যেকেরই ক্বিরাত ছিল গ্রহণযোগ্য।
এঁদেরই একজন ছিলেন 'ফযল বিন শাজান'। ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আবু মুহাম্মাদ ফযল বিন শাজানের প্রচুর বই রয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন নামকরা ফকিহ, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও কালাম শাস্ত্রবিদ, মুফাসসির ও লেখক। তিনি চারজন নিষ্পাপ ইমামের কাছে শিক্ষা অর্জন করার মধ্য দিয়ে তাঁদের ছাত্র হবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। ইমাম হাসান আসকারী (আ) থেকে একটি বর্ণনা রয়েছে যাতে তিনি ফযল বিন শাজানের প্রতি তিনবার রহমত বর্ষণ করেছেন এবং তারপর বলেছেনঃ 'খোরাসানবাসীদের উচিত ফযলের মতো মর্যাদা বা সৌভাগ্য কামনা করা'। ফযল এলমে ক্বিরাত সম্পর্কে বহু গ্রন্থ লিখেছেন। এগুলোর মধ্য থেকে "আলকারাআত" গ্রন্থটি বিখ্যাত এই ক্বিরাতবিদের লেখা বইগুলোর মাঝে শ্রেষ্ঠস্থানীয়।
হিজরি পঞ্চম শতকেও কোরআনের আবৃত্তি বিষয়ক জ্ঞান এলমে ক্বিরাতের গুরুত্ব অক্ষুন্ন ছিল। স্পেন থেকে উজবেকিস্তান পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বজুড়ে বহু আলেম ওলামা কোরআনের ক্বিরাত নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন এবং এ বিষয়ে অসংখ্য বই লিখেছেন। কোরআনের ক্বিরাত সম্পর্কে স্পেনের বিখ্যাত লেখক 'আবু ওমর উসমান বিন সায়িদ দানি'অসংখ্য বই লিখেছেন।'আত্তাইসির' তাঁর লেখা বইগুলোর অন্যতম। ক্বিরাত বিষয়ে তাঁর পরবর্তী লেখক হলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ফকিহ, বিখ্যাত ক্বারী,হিজরি ষষ্ঠ শতকের ক্বারীকুল শিরোমণি এবং কোরআন ও সাহিত্যের শিক্ষক 'আবু মুহাম্মাদ শাতেবি।'হিজরি ৫৩৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।এলমে ক্বিরাত সংক্রান্ত তাঁর দুটি কসিদা রয়েছে। এগুলো হলো 'লামিয়া' এবং 'রায়িয়াহ'। তাঁর পরবর্তীকালে বিখ্যাত এই বইগুলোর ওপর অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে। শাতেবি ৫৯০ হিজরিতে মারা যান।
হিজরি চতুর্থ শতক থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে বিখ্যাত দু'জন আলেমের আবির্ভাব হয় যাঁরা এলমে ক্বিরাতের বিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখেন। এঁদের একজন হলেন 'ইউসুফ হামেদানি' এবং অপরজন 'ইউসুফ জাযরি'। জাযরির সময়ে এলমে ক্বিরাতের অবস্থান ম্লান হয়ে আসছিল। এ সময় তিনি এই বিদ্যাকে পুনর্জীবিত করেন। তাঁর লেখা 'আন্নাশ্র' এবং 'গায়াতুন নাহায়া' বই দুটো এলমে ক্বিরাতের ক্ষেত্রে বিশ্বকোষতুল্য। ইরানেও বড়ো বড়ো অনেক ক্বারীর আবির্ভাব ঘটেছে যাঁরা ক্বিরাতগুলোকে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। এঁদেরই একজন হলেন 'আবুল ফাযল মুহাম্মাদ বিন তিফুর সাজাবান্দি গাযনাভি'। এলমে ক্বিরাতের ক্ষেত্রে তিনি অনেক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাফসিরসহ কোরআন বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। এ ক্ষেত্রে তাঁর লেখা বইও রয়েছে। হিজরি দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে সাফাভিরা ক্ষমতায় আসার ফলে ইরানে দ্বীন এবং রাজনীতির সংশ্লেষ ঘটার মধ্য দিয়ে ইসলামী শিক্ষার জগতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময়কার একজন নামকরা ক্বারী হলেন 'ক্বাজি সায়িদ কোমি'। তিনি ছিলেন মোল্লা মোহসেন ফয়েজ কাশানি'র ছাত্র।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২০