মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৫০
গত পর্বে আমরা ইসলামী জ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা এলমে ক্বিরাতের ক্ষেত্রে যেসব মনীষী অবদান রেখে গেছেন তাঁদের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এ পর্বে ইসলামী জ্ঞানের অপর সমৃদ্ধ শাখা 'এলমে তাফসির' নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে জ্ঞানের যেসব শাখা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এলমে তাফসির তাদের অন্যতম। যাঁরা মুসলমান তাঁদের কোরআনে কারিমের অর্থ বোঝার জন্যে এলমে তাফসিরের প্রয়োজন। এলমে তাফসির নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা হলেন মুফাসসির। যুগে যুগে বহু মুফাসসিরে কোরআন ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন।
রাসূলে খোদা (সা) এর সময় আরব মুসলমানরা কোরআনের আয়াতগুলোর শানে নুযুল সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বলে এবং কোরআনের আয়াতগুলো তাঁদের মাতৃভাষায় নাযিল হয়েছিল বলে ঐশী এ গ্রন্থটির অর্থ বুঝে ওঠা তাদের জন্যে কষ্টকর ছিল না। তারপরও কখনো যদি কোনো ব্যাপারে তাঁদের মনে প্রশ্ন দেখা দিত,সাথে সাথে রাসূলে খোদার কাছ থেকে তার সমাধান জেনে নিতেন। কিন্তু নবীজীর ওফাতের পর মুসলমানরা বিশেষ করে অনারব অর্থাৎ আরবের বাইরের মানুষ যখন নতুন করে মুসলমান হলেন, কোরআন নাযিলের সময়টা ছিল তাঁদের সময় থেকে অনেক আগে। তার মানে কোরআন অবতীর্ণ হবার সময়ের সাথে তাঁদের সময়ের ব্যবধান অনেকখানি।
এই দূরত্বের কারণে কোরআনের অর্থ উপলব্ধির ক্ষেত্রে সমস্যা্এমনকি মতপার্থক্যও দেখা দেয়। এই বিষয়টি মুসলমানদেরকে সেই হিজরি প্রথম শতক থেকেই ভাবিয়ে তোলে। সেজন্যেই তাঁরা কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্যে তাফসির নামক শিক্ষার স্বতন্ত্র একটি বিষয়ের আবির্ভাব ঘটান এবং এর বিস্তারে ব্যাপক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালান। এলমে তাফসির জ্ঞানের এমন একটি শাখা যাতে আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে কোরআন নাযিল করেছেন সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে মানুষের বোধগম্য করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়।
তাফসির শব্দটি কোরআনে কারিমে একবার উচ্চারিত হয়েছে। সূরা ফোরকানের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ "তারা আপনার কাছে কোন সমস্যা উপস্থাপিত করলেই আমি আপনাকে তার সঠিক জওয়াব ও সুন্দর ব্যাখ্যা (তাফসির) দান করি।"তাফসির বিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো কোরআনের আয়াত বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে মুফাসসিরগণের বিচিত্র পদ্ধতির অনুসরণ। মুসলমান বড়ো বড়ো আলেম এবং মুফাসসিরগণের হাতে কোরআনের তাফসিরের বিচিত্র ফরমেট তৈরি হয়েছে। যেমনঃ কোরআন থেকে কোরআনের তাফসির, তাফসিরে ইজতেহাদি বা গবেষণামূলক তাফসির, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বর্ণনাধর্মী, প্রশিক্ষণমূলক, ফেকহি, কালামি, রহস্যধর্মী এবং আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাধর্মী তাফসির ইত্যাদি। তাফসিরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বড়ো বড়ো মুফাসসিরগণ এইসব পদ্ধতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছেন।
তবে কোরআনের তাফসিরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিটি হলো কোরআন থেকে কোরআনের তাফসির। এই পদ্ধতিটিই ছিল নবী করিম (সা) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের অনুসৃত পদ্ধতি।
কোরআন থেকে কোরআনের তাফসির করার পদ্ধতিটি বহু মুফাসসির অনুসরণ করেছেন। তাঁরা মনে করতেন কোরআন দিয়েই কোরআনকে বুঝতে হবে। সেজন্যে তাঁরা আল্লাহর কালামকে বোঝার জন্যে কোরআনেরই অন্য আয়াতের শরণাপন্ন হতেন। সূরায়ে কিয়ামতের ১৮ এবং ১৯ নম্বর আয়াত এই বক্তব্য বা পদ্ধতিকে সমর্থন করছে। বলা হয়েছেঃ "অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন। এরপর বিশদ বর্ণনা আমারই দায়িত্ব।"হযরত আলী (আ.) নিজেও কোরআনের তাফসির করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। নাহজুল বালাগা'র ১৩৩ নম্বর খুতবায় এসেছেঃ কোরআনের এক অংশ আরেক অংশ সম্পর্কে কথা বলে, ব্যাখ্যা দেয় এবং প্রমাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করে।
কোনো কোনো মুফাসসির আবার কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে গবেষণামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতিতে কোরআনের আয়াতের অর্থ যুক্তি,মূলনীতি এবং চিন্তা গবেষণাকে কাজে লাগানো হয়। এই পদ্ধতিও কোরআনের ভিত্তিমূলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাফসিরে 'আল-মিযানের' লেখক বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা 'সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ি' যেমনটি বলেছেনঃ" কোরআনে তিনশ'টি আয়াত রয়েছে যেগুলো বিচার-বিচেনা,বুদ্ধিবৃত্তি এবং স্মৃতিচারণমূলক। প্রকৃতপক্ষে কোরআন রাসূলে আকরাম (সা)কে তথ্য প্রমাণ দিয়ে শিখিয়েছে কীভাবে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় এবং বাতিলকে দূরীভূত করতে হয়।
আল্লাহ তায়ালা কোরআনে তাঁর বান্দাদেরকে এমনকি একটি আয়াতেও বলেননি না জেনে বুঝে তাঁর প্রতি কিংবা তাঁর পক্ষ থেকে যাকিছু এসেছে তার প্রতি ইমান আনতে কিংবা অন্ধভাবে তাঁকে অনুসরণ করতে।বিবেক-বুদ্ধি কিংবা গবেষণার মাধ্যমে কোরআনের তাফসির করার রীতি সাহাবায়ে কেরাম কিংবা তাবেয়িনদের মাঝে প্রচলিত ছিল না। তাঁরা বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাদিসের ওপর নির্ভর করতেন। তবে নিষ্পাপ ইমামদের মাঝে লক্ষ্য করা গেছে তাঁরা তাঁদের ছাত্রদেরকে তথ্য প্রমাণ সহকারে গবেষণার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।
এর ফলে ইমামদের সময়ে আধুনিককালের 'থিংক ট্যাঙ্ক' বলে খ্যাত গবেষকদের বেশকিছু দল গড়ে ওঠে।এ যুগেই ফিকাহ অর্থাৎ ইসলামী আইন-কানুন ও নীতিমালা এবং কোরআনে মাজিদের তাফসির বিষয়ে ব্যাপক গবেষণামূলক কার্যক্রম চলে। এ সময়কার একজন গবেষক বা মুজতাহিদ হলেন আলী (আ) এর ছাত্র 'মুজাহিদ বিন জাব্র মাক্কি'। মুজাহিদ তার মহান শিক্ষক হযরত আলী (আ) এর পদ্ধতি অনুসরণ করে তাফসিরে কোরআনের ক্ষেত্রে এমন একটি আদর্শ বা ধারা প্রতিষ্ঠিত করেন যার সাথে হিজরি প্রথম শতাব্দির তাফসিরের পার্থক্য ছিল সুস্পষ্ট।
কোনো কোনো মুফাসসির আবার তাঁদর তাফসিরের ক্ষেত্রে সাহিত্যিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। কোরআনের ভাষা যেহেতু আরবি,তাই স্বাভাবিকভাবেই কোরআনের অর্থ উপলব্ধি করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায় হলো আরবি ভাষার ব্যাকরণ,অলংকার শাস্ত্রসহ সাহিত্যিক জ্ঞানে সমৃদ্ধি।তাফসির বিদ্যার ইতিহাসে এই শ্রেণীর একজন বড়ো মুফাসসির হিসেবে 'আবুল কাসেম মাহমুদ যামাখশারি খাওয়ারেযমি'র নামটির উল্লেখ রয়েছে। তিনি ছিলেন ইরানের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় খাওয়ারেযমের অধিবাসী। তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর মক্কায় কাটানোর কারণে তাকেঁ 'জারুল্লাহ' বা আল্লাহর প্রতিবেশি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।বিখ্যাত তাফসিরে কোরআন 'কাশশাফ' খাওয়ারেযমির রচনা। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২৪